ইওরোপে এসেছি, এবার ভালবাসার শহর প্যারিস তথা ফ্রান্স যেতে হবে। লুজান স্টেশনে গিয়ে টিকিট কিনলুম অগ্রীম, সুইজারল্যান্ডের লুজান থেকে ফ্রান্সের গার দ্যু লিয়ন মানে প্যারিসের প্রধান রেল স্টেশন। আমাদের ঢাকার কমলাপুর আর কি। অবশ্য কমলাপুরের সাথে ভুলেও তুলনা করতে যাচ্ছিনা গার দ্যু লিয়নের। টিকিট কাটার সময় , জিজ্ঞেস করাতে কাউন্টারের মহিলাটি বললেন, আপনার যাত্রা কয়েক ঘন্টার, সময়মত আসবেন। বাঙালী দেখেই বললেন কিনা কে জানে! সময়মত আসবেন?
তা সময় মতই এলুম আর টিভিজি ট্রেন ঠিক সময়েই ছাড়ল, আমি একা। ট্রনে খাবার বলতে শুধু চা বা কফি তবে কারণ এই ট্রেনে সব কিছুই একটু এক্সপেনসিভ। ভাল কথা, ফ্রান্স যাওয়া আসার টিকিটের দাম পড়ল ১৬০ ফ্রাংক, রিটার্ণ টিকিট। প্রায় পনেরো হাজার টাকা। ঘন্টা চারেকের যাত্রা। মন্দ না।
ট্রেনের চেহারা আর সীটের অবস্হা দেখেন নীচের ছবিতে আর মনে মনে আমাদের চট্টলা বা এগার সিন্দুরের সাথে মিলান। পাবলিকের সুবিধা বিন্দুমাত্র না বাড়লেও আমাদেের ট্রেনের ভাড়া অচিরেই বাড়ছে!
আমার স্টার্টিং পয়েন্ট লুজান থেকে ফ্রান্সের বর্ডার পর্যন্ত অনেক দুরের রাস্তা । সুইশ বর্ডার পার হলুম তারপরও ট্রেন চললো। দুজন চেকার এসে টিকিট দেখে গেল কিন্তু পাসপোর্ট দেখলনা। মাঝখানে আমি ভাগ্নেবৌ সিনথিয়ার দেওয়া নাস্তাটা খেয়ে প্যাকেটটা সীটের পাশেই ঢাকনা দেয়া বাকসে ফেললুম। নাহ জানালা দিয়ে সাঁই করে ফেলার কোন উপায় নেই আর মেঝেটা এত পরিষ্কার যে মেঝেতে ফেলার কথা ভাবতেই পালুমনা। খাসলত কাকে বলে! গিন্নী অবশ্য এসব করেনা তবে আমার ঢাকাইয়া ভাগ্নেরা ভাইস্তারা কোথায় ঠোঙা বা সিগারেটের প্যাকেট ফেলল জানেইনা! ঘন্টায় শ'দুয়েক কিলোমিটার স্পীডে ট্রেন চলছে কিন্তু বিন্দুমাত্র ঝাকুনী বা দুলুনি নেই, প্রায় টের পাওয়া যাচ্ছেনা যে ট্রেন অত দ্রুত দৌড়ুচ্ছে!! ট্রেন কিন্তু সব স্টেশনেই থামছে কিন্তু স্টেশনগুলো প্রত্যেকটাই একটা থেকে আরেকটা অনেক দূরে দূরে, মোটেই ভৈরব থেকে আশুগন্জ বা ব্রাম্মনবাড়িয়া নয়!
গার দ্যু লিয়ন- ছবি নীচে
দুপুর নাগাদ প্যারিস মানে গার দ্যু লিয়ন পৌছলুম। স্টেশনে আমাকে নেয়ার জন্য আমার আরেক ছোটভাই কাম গাইড দেওয়ান সেবক আর ইমন হাজির ছিল। ভাষা আর জায়গা দুটোই অপরিচিত তাই ওরা ছাড়া চলাফেরা বেশ কঠিন। নামলুম স্টেশনে আমার সবেধন একখান ছোট ব্যাগ নিয়ে।
আন্তর্জাতিক ট্রেন চলাচল করে এখান থেকে, প্রায় সারা ইউরোপ যায়। স্টেশনটা মনে হল চার তলা। উপরে নীচে সবজায়গাতেই ট্রেন চলছে। নীচে মূলত লোকাল ট্রেনগুলো চলে, ফ্রান্সের ভেতরেই চলে, শত শত কিলোমিটার। প্রতি তিন চার মিনিটে একটা করে ট্রেন আসছে আর কয়েক মিনিট পরই ছেড়ে যাচ্ছে। আমরা লিয়ন স্টেশন থেকে বেরুবার আগে গেলুম একটা টিকিট কাউন্টারে, ৫-৬ দিনের কার্তে জুর্ণী কিনতে। আগেও এক জায়গাতে বলেছি ওসব টিকিট দিয়ে ঐ ৫ দিন বাস ট্রেন ট্রাম সবকিছুতেই বিনা টিকিটে চড়া যায়, খরচ কম পড়ে। আর আমি হলুম গিয়ে আদী অকৃত্রিম বাঙালি, যেখানে কম খরচ সেখানেই আমি। পাচ দিনের জন্য পন্চাশ ইউরো দিয়ে কিনলুম একখান টিকিট। আমার সঙ্গীদের আগেই টিকিট কাটা ছিল। টিকিট কেটে তারপর লিফটে করে দু তলা নীচে নেমে একটা ট্রেন ধরে গেলুম আমার আবাসস্হল 'পান্থান' এ। এখানে একটা তিন তারকা হোটেল 'হোটেল ইবিস', যেটা হবে আমার আগামী কয়েক হপ্তার নিবাস।
ছবি নীচে:
বেলা দুটোর দিকে গাইড কাম ছোট ভাই সেবক বলল চলুন লান্চ করে আসি। হোটেল থেকে বেরিয়ে আবার স্টেশন পান্থান, সেখান থেকে ট্রেনে করে লিয়ন নেমে একটা বাঙালি রেস্তোরাতে ঢুকলুম, দিশী বিরিয়ানী খাব। খাসীর মাংসের বিরিয়ানী। বিরিয়ানীর চেহারাটা ছিল ভয়ংকর রকমের ঝোল মাখানো হলদে। লোহার মত শক্ত চাল, জঘন্য স্বাদ, মুখে দিয়ে বুঝলুম পৃথিবীর নিকৃস্টতম বিরিয়ানী খেতে হবে আমাকে। দুতিন লোকমা খেয়ে একটু সালাদ খেয়েই উঠে পড়লুম। সেবককে কিছু বললুম না বেচারা লজ্জা পাবে ভেবে। আবার এটাও মনে রাখলুম এই খাবারই এরা প্রতিদিন খাচ্ছে। প্রতি প্লেট হাজার টাকা! ওর পর থেকে একটা অন্য দেশের রেস্তোরাতে মুরগী বা গরুর মাংশ দিয়ে তন্দুর রুটি খেয়েছি, খারাপ লাগেনি। বাঙালী ভাইকে আর পৃষ্ঠপোষকতা করা গেলনা! জান বাঁচান ফরজ!
যাব বিখ্যাত প্রাসাদ ভার্সাই প্যালেস দেখতে। ভার্সাই যেতে আবার টিকিট কাটতে হল কারণ আমার কার্তে জুর্ণীর এলাকার বাইরে ভার্সাই, প্যারিস থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দুরে ট্রেনে করে ভার্সাই স্টেশন সেখান থেকে হেঁটে বেশ খানিকটা দুরে প্রাসাদ।বাস ছিৈল তবে হেঁটে যাওটাই ভাল মনে করলুম। প্রায় পুরো শহরটাই পর্যটকে ভর্তি। অপুর্ব সুন্দর প্রাসাদ, ভেতরে ঢুকতে আবার আমার প্রচুর টাকা লাগল। তবে একটা মজার ব্যাপার ঘটল।
প্রাসাদের বিভিন্ন জায়গাতে ঢুকতে ম্যালা টাকা লাগে তা যেমন ঠিক আবার উদার ফরাসীরা আপনাকে মাগনা ঢোকার প্রচুর বন্দোবস্ত করে রেখেছে! আপনি যদি ইইউ দেশের ১৮ বছরের নীচের নাগরিক হন, যদি আপনি বেকার হন বা স্কুল ছাত্র হন তাহলে আপনার কোন টাকাই লাগবেনা। আমার সাথের তরুন ছোট ভাইটি সত্যিকার অর্থে কোন রোজগেরে লোক না, তার তখন কোন স্হায়ী চাকরী ছিল না। । অবশ্য তার এসব তথ্য জানা ছিল না কারণ হাজার হাজার টাকা দিয়ে প্রাসাদ দেখার মত টাকার আর সময় তার ছিল না। তাই তাকে বললুম বাপু কাউন্টারে গিয়ে বল তুমি বেকার যথাযথ রোজগার করনা, হয়ত তোমার টিকিট নাও লাগতে পারে। সে আমতা আমতা করে কাউন্টারে গিয়ে আমার শেখানো কথাগুলো বলল। কাউন্টারের মহিলাটি খালি একবার তার হাতের কাগজটাতে চোখ বুলিয়ে বলল, যাও ঢুকে পড় তোমার টিকিট লাগবেনা। কোন প্রকার চ্যালেন্জ বা হৈ চৈ নেই।
দুনিয়াতে সবচাইতে বড় প্রাসাদ কোনটি তার জবাব সহজ নয়। সবচাইতে বড় ঠিক করার কতগুলো ক্রাইটেরিয়া আর প্যারামিটার আছে। দেয়াল দিয়ে ঘেরাও করা সবচাইতে বড় প্রসাদ এলাকা হচ্ছে চীনের নিষিদ্ধ শহর প্রায় ১৭৮ একর, ৯০০০ কামরা, ফ্লোর এরিয়া ১৬, ১৪, ৬০০ বর্গ ফুট। প্রায় চল্লিশ বছর আগে দেখেছিলুম পিকিং অধুনা বেইজিং এর ঐ নিষিদ্ধ শহর। আবার ফ্লোর এরিয়া ধরলে সবচাইতে বড় হল রুমানিয়ার বুখারেস্টের প্যালেস অফ দি পার্লামেন্ট । কিন্তু যদি রাজপ্রাসাদের অধীন সর্বাধিক বা সবচাইতে বড় সম্পত্তি ধরা হয় তাহলে দুনিয়ার সবচাইতে বড় প্রাসাদ হল গিয়ে আমার সামনের ঐ প্যালেস অফ ভার্সাই বা শাঁতো অফ ভার্সাই। ভার্সাই এর ভুমির পরিমান ২০১৪ একর, এর শুধু প্রাসাদের ফ্লোর এরিয়া হল ৭,২১, ২০৬ বর্গফুট। আমার জীবনে দেখা সবচাইতে সুন্দর প্রাসাদের ছবি দেখুন:
ফরাসী সম্রাট ত্রয়োদশ লুই থেকে চতুর্দশ লুইএর সময় প্রাসাদ বানানো হয়, সপ্তদশ শতাব্দী থেকে উনবিংশ শতাব্দী এর মধ্যে। ১৩শ লুইওর হান্টিং লজ হয়ে যায় পৃথিবীখ্যাত প্রাসাদ। পরে ফরাসী বিপ্লবের পর এটাকে আরো সুন্দর আর পরিপুর্ণ করা হয়, নতুন ডিজাইনার দিয়ে।
চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবেননা ভার্সাই প্রাাসাদ কত সুন্দর!
আগামীতে আইফেল টাওয়ার।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৫২