সুইজারল্যান্ডে একটা অপুর্ব সুন্দর জায়গার নাম ইন্টারলাকেন। ওটাকে পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর প্রাকৃতিক স্হান বলা যেতে পারে। টিকিট কিনলুম আমার আবাসস্হল লুজানে বসে, একদিনের টিকিট । ঐ একদিনের টিকিটে লুজান থেকে ট্রেনে ইন্টারলাকেন যাওয়া সেখানে জাহাজে ঘোরা আবার ট্রেনে ফেরৎ আসা। মানে ঐদিন রাত বারোটা অবধি যেকোন যানবাহনে ফ্রী ঘুরতে পারবেন
টিকিটটাকে বলা হয় কার্তে জুখনি। এবারে একাই যাবো, বাসার সবাই বহুবার ওখানে গেছে তাছাড়া ওদের অফিস আছে কাজ কর্ম আছে তাই।
সকাল ৫ টায় রওয়ানা হলুম লুজান স্টেশনের দিকে, কাঁধে ছোট একটা ব্যাগে কিছু খাবার আর একটা তোয়ালে। মনে রাখবেন সুইজারল্যান্ডে সবজায়গাতে আপনার পছন্দসই খাবার পাবেন এমন চান্স কম। ট্রেন বা জাহাজে খাসীর বিরিয়ানী বা ইলিশ মাছের দোপেঁয়াজা পাওয়া যায় না। বড়জোর তিনশো টাকা দামের এক কাপ কফি!
বাইরের খাবার আমার কিন্চিৎ অপছন্দ কারণ আমি ঝাল খাই, প্রচুর ঝাল খাই, আর সুইশরা গরুর মাংশেও চকলেট দিতে চায়!
জেনেভাতে জাতিসংঘের অফিস
১৩০০০ ফুট উঁচুতে টপ অফ ইউরোপ
সকালে ব্যাগ হাতে লুজান রেলস্টেশনে পৌছলুম সকাল সাড়ে পাঁচটা। ট্রেন ছাড়বে ৬ টা ১২ মিনিটে।
প্রথমে ভাবলুম ৬-১২ মিনিট কোন টাইম হলো? ব্যাটা সাড়ে ছটা লিখবে আর যাবে সাত আটটার দিকে। ও খোদা ট্রেনটা আসল ৬ টা ৮ মিনিটে আর ছাড়ল কাঁটায় কাঁটায় ৬-১২ মিনিটে!! মাথা খারাপ নাকি! কুত্তার পেটে ঘী সয় না! আমারও তাই অত্তো সুন্দর টাইমিং মানে সময়ানুবর্তিতা বেখাপ্পা অস্বস্তিকর লাগছিল!
ঘড়ির সময় মিলাতে হলে নাকি ইউরোপের ট্রেন দেখে মিলানো যায়! আমাদের রেলমন্ত্রীরা সারা বছর বিদেশ ভ্রমন করেন অথচ ট্রেনের সেবার উন্নতি কিভাবে করতে হয় তা নিয়ে কখনোই ভাবেন বলে মনে হয় না!
প্রথমে পৌছলুম মনথ্রো। সেখান থেকে গাড়ি বদল করে গোল্ডেন পাশ নামের একটা চমৎকার ট্রেনে চেপে ইন্টারলাকেন পর্যন্ত পাহাড়ী পথে যাওয়া। ট্রেনটার উপরে আর দু পাশ খোলা, আপনি ইচ্ছামত চারিদিক দেখতে পারেন, উপভোগ করতে পারেন অপুর্ব প্রকৃতিকে। কযেক ঘন্টার যাত্রা সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা, জীবনে ভোলার নয়!
আমাকে টিকিট কিনতে হয় নি সারাদিনের জার্ণী ফ্রি। টিকিটটার নাম 'কার্তে জুখনী'।
ইন্টার লাকেনে ট্রেন থেকে নেমে জাহাজে ঘন্টা দেড়েক বেড়ানো। এমনিতে জাহাজের ভাড়া পন্চাশ ফ্রাঁংক, আমার ঐ কার্তে জুখনী' কাটা ছিল তাই টিকিট কাটার ঝামেলাতে যেতে হয় নি।
জাহাজটা ভর্তি পর্যটক, অধিকাংশই জাপানী আর চীনা, বাইরেরও ছিল তবে বঙ্গসন্তান একমাত্র এই আমি। প্রত্যেকের হাতি দামী ক্যামেরা।
সবার পোষাক আষাক চাল চলণ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল প্রত্যেকে অসম্ভব বড়লোক, ভয়ংকর ধনী।
জাহাজে ঘোরাটা এক সুন্দর অভিজ্ঞতা। টলটলে নীল পানি কেটে আগাচ্ছিল আমাদের মাঝারি আকারের জাহাজ, দুপাশে ঘাসে মোড়া বনভুমি মাঝে মাঝে বাড়িঘর। দেখে মনে হবে স্বর্গ তো এখানেই আরে এখানেই।
পৃথিবীর অন্যতম সেরা সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে সবাই অভিভুত, আবেগাপ্লুত। প্রকৃতি সুইজারল্যান্ডকে উজার করে দিয়েছে আর সুইশরা সেটাকে আরো সুন্দর করে বাঁচিয়ে রেখেছে--- রাখছে। ঐ টলটলে স্বচ্ছ পানিতে কোনকিছু মানে চিপসের প্যাকেট পানির বোতল বা সিগারেটের প্যাকেট ফেলার সাহসই কারো হবেনা। যদি কিছু ভুলেও পানিতে পড়ে যায় ব্যাস কপালে খারাবি আছে। কয়েকশ ফ্রাংক জরিমানা সহ অনেক ঝামেলা! মাস্তানী করবেন, পরে দিবেন? উঁহু পারবেননা, ভুলে যান।
জাহাজে বসেই এক ফাকে ভাগ্নেবৌ সিনথীয়ার দেয়া চমৎকার খাবারটির সদ্ব্যাবহার করলুম। না আমি একা না আরো অনেকেই সঙ্গে আনা খাবার খেয়ে নিচ্ছিল। বিব্রত হবার কিছু নেই। জাহাজে কোন প্রকার খাবার নেই, শুধু কফি, পাঁচ ফ্রাংক! লান্চ করে এক কাপ কফি খেলুম। বেশ ভাল বোধ করলুম।
মনে মনে আমাদের ঢাকার বুড়িগঙ্গার কথা ভাবছিলুম। কি ভয়াবহ অবস্হা এখন! অথচ এই তো সেদিনও পন্চাশের দশকে সদরঘাট ওয়াইজঘাট সোয়ারিঘাটের পন্টুন থেকে পানিতে লাফ দিয়ে সাঁতরেছি, ইন্টারলাকেনের মতই টলটলে স্বচ্ছ পরিষ্কার ছিল সেই পানি।
খুন করে ফেলেছি সেই প্রিয় বুড়িগঙ্গাকে!
ঘন্টা কয়েক বেড়ানোর পর জাহাজটা আমাদের ঐ ইন্টারলাকেন স্টেশনে নামিয়ে দিল। কি অদ্ভুত টাইমিং, আমরা জাহাজ থেকে নেমে হেঁটে ট্রেনে বসলুম তার পাঁচ মিনিটেই ট্রেন ছাড়লো। না ওটাই ট্রেনটার সময়, জাহাজার সাথে বা আমাদের আসার সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। অবশ্য আধ ঘন্টা পর পর ট্রেন আছে, আপনি যেকোনটাতে যেতে পারবেন, রাত বারোটার আগে ট্রেনে উঠতে হবে। বারোটা হয়ে গেলে ঐ কার্তে জুখনী টিকিট বাতিল হয়ে যাবে।
তবে পুরো সুইজারল্যান্ডে ট্রেন বাসের একটা জিনিস আছে। বাস প্রতি কুড়ি মিনিট পর পর আসবে আর ট্রেন প্রতি এক বা দুঘন্টা পর পর আসবে যাবে। লোকাল ট্রেন মানে সুইজারল্যান্ডের ভিতরে যাতায়াতের ট্রেন মিস করার কোন ব্যাপার নেই। মানে সুইজারল্যান্ডে ভিতরে আপনি শ্টেশনে এলেই হলো, যেতে পারবেন আপনি, আগে আর পরে।
সিট? আরে ট্রেনগুলোর প্রায় তিনভাগের একভাগ সিট খালি থাকে। অবশ্য আন্তর্জাতিক ট্রেনগুলোর সময়সুচী আর সিস্টেম আলাদা। সেটা পরে বলব।
সন্ধ্যে নাগাদ বাসায় ফিরলুম, মনে একরাশ আনন্দ, ঐ সুন্দরতম প্রকৃতিকে কি কখনো ভোলা যায়!
তবে এও জানি আড়াইকোটি লোকের শহর ঢাকা শহরের হৈ চৈ শোরগোল ট্রাকের ভয়াবহ ভেপুর শব্দ বাসের বেপরোয়া চালকের গজগজ বা হেলপারের চিৎকার 'বায়ে চাইপা' শব্দ সাথে জঘন্য ধুলোবালির মাঝে এই অল্প সময়ের নির্মল আনন্দ কোথায় হারিয়ে যাবে!
হয়ত ঠিক.. হয়ত না।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই অক্টোবর, ২০১৫ বিকাল ৩:১৩