কালিম্পংএর পর ঘুরে এলুম দার্জিলীং
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
কালিম্পং এর পালা শেষ করে আমরা যাবো দার্জিলীং। ড্রাইভার রাজেশকে বলে দিলুম সকালে ন'টার দিকে এসে আমাদের নিয়ে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে নামিয়ে দিতে। সে সেলাম দিয়ে বলল আসবে। সকালে সব মালপত্র গুছিয়ে বেয়ারাকে বললুম নাস্তা দিতে। লুচি আর আলুর দম সাথে চা। খেয়ে দেয়ে বাক্স পেটরা নিয়ে তৈরী হলুম, ঠিক ন'টায় ড্রাইভার রাজেশ হাজির। গাড়ীতে চেপে চলে এলুম ট্যাক্সি স্ট্যান্ড। বাস টাস ও এখান থেকেই ছাড়ে আর এখানেই আসে।
একটা টাটা সুমো গাড়ী যাবে দার্জিলীং। ভাড়া মাথা পিছু একশ কুড়ি টাকা। কোন টানাটানি নেই, হাক ডাক নেই, ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরেও এর চাইতে বেশী শব্দ হয়।
আমরা দুজন সামনের সীটে বসলুম, পেছনের সিটে আরো জনা ছ'য়েক যাত্রী। গাড়ী চলল। পাহাড়ী পথ একপাশে গভীর খাদ বহু নীচে সরু খাল আর অন্য পাশে পাহাড়, ভয় আর মজা দুটোই ছিল।
কালিম্পং টু দার্জিলীং রাস্তা, দারুন সুন্দর।
প্রথম দিকে শুধুই নামা, সমতলের দিকে।
ঘন্টা দেড়েক চলার পর এক জায়গাতে গাড়ি থামল, না সেই মোমো খেতে, এবারেরটা অন্য একটা হোটেল। দার্জিলীংএ বেশ কাছেই। এখানকার মোমোটা একটু বেটার মনে হলো। সহযাত্রী বললেন দার্জিলীং এর মোমোর তূলনা নেই।
জায়গা জায়গাতে রাস্তার মেরামতের বা উন্নয়নের কাজ চলছে।
কিছুক্ষন পর পাহাড়ে চড়া শুরু হল।
বেলা দেড়টা নাগাদ পৌছলুম দার্জিলীং। পথে প্রচুর ভিড় দেখলুম। পর্যটকে ভর্তি শহর। সব রংএর বহু ধরনের পর্যটকই আছে। ভাল লাগল। বহু ভাষাভাষির এক মিলন মেলা। অবশ্য অধিকাংশই ভারতীয়।
ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে আবার সেই হোটেলে যাবার সমস্যা। এক ট্যাক্সিওয়ালা বলল ঐযে আপনাদের হোটেল দেখা যায় হেঁটে চলে যান। পরে বুঝেছিলুম ওটা একটা সদুপদেশ ছিল্
যাহোক তাকিয়ে দেখি আমরা যেখানে দাড়িয়ে ছিলুম সেখান থেকে কমসে কম আড়াইশ ফুট উচুতে ঐ হোটেল, মালপত্র নিয়ে যাওয়া এই বয়সে সম্ভব না। একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে এলুম হোটেলে।
চমৎকার জায়গাতে হোটেলটা। রুমটাও চমৎকার।
খেয়ে দেয়ে ওয়েটারের কাছ থেকে উপদেশ আর টিপস নিয়ে বেরুলুম শহর দেখতে।
ছোট্ট শহর, মানুষে গিজ গিজ করছে, অধিকাংশই বাইরের, পর্যটক।
দার্জিলীংবাসীর অভিযোগ তাদের চাইতে পর্যটকের সংখ্যা বেশি।
ওরা ভুলে গেছে যে এই শহরের প্রধান আয় হলো এই পর্যটকদের ব্যায়।
এখানে আছে কিছু খাবারের দোকান চা'পাতার দোকান আর আছে কাপড়ের দোকান।
রাত বাড়ার সাথে সাথে ঠান্ডা বাড়তে শুরু করল। হি হি করে কাঁপতে শুরু করলুম দুজনে। ঠান্ডা লাগবে জানতুম তবে তার পরিমানটা আন্দাজ করতে পারিনি।
রাতের খাবার খেতে একটা রেস্তোরাতে বসলুম।
হোটেলের খাবারের চাইতে বাইরের খাবারটা সুস্বাদু মনে হলো। হালকা খেয়ে নিলুম।
রাতে গোর্খাল্যান্ড এর আয়োজনে একটা খোলা জায়গার মন্চে চমৎকার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখলুম অনেকক্ষন। মনটা ভরে গেল।
দার্জিলীংএর গোলচক্কর। দুরেই মন্চ।
নাচগুলো সবই নেপালি সংস্কৃতির আদলে। আবার ঘোষক দার্জিলীং কথাটি কখনো বলেননি বলছিলেন 'গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল এডমিনিস্ট্রেশন' বা জিটিএ। গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার নেতা বিমল গুরুং এলেন প্রচুর অস্ত্রধারী প্রহরী বেস্টিত অবস্হায়। তরুন ভদ্রলোক, ভাল লাগল তাকে দেখে।
সবার সঙ্গেই মাঠের একটা চেয়ারে বসলেন।
অবশ্যই কাউকে বিরক্ত করলেননা। নীচে ছবিতে বিমল গুরুং।
দার্জিলীংএ নেপালী ভাষাভাষীর সংখ্যাই বেশী, মানে প্রায় সবই ।
রাজনৈতিক দল 'গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট' এর নেতা সুভাষ ঘিষিং এর নেতৃত্বে এরা বেশ কিছু কাল অন্য রাজ্যের মত স্বায়ত্বশাসনের জন্য তথা প্রদেশের মর্যাদা পাবার জন্য লড়াই করে। নামকরণ চায় গোর্খাল্যান্ড। ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত আন্দোলন আর মারামারি চলে।
মারা যায় ১২০০ মানুষ।
এরপর ভারতের কেন্দ্র, পশ্চিমবঙ্গ সরকার আর পাহাড়ের মোর্চার মধ্যে এক ত্রিপক্ষিয় চুক্তি হয়।
চুক্তি মোতাবেক দার্জিলীংএর নতুন নাম করা হবে 'গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল এডমিনিস্ট্রেশন' যার জন্য একটা আলাদা আধা স্বায়ত্বশাসিত প্রশাসনিক ব্যাক্তিবর্গ (বডি) থাকবেন। সেই বডিটার প্রশাসনিক ক্ষমতা, কার্যনির্বাহী ক্ষমতা আর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থাকবে তবে আইন করার ক্ষমতা থাকবেনা।
এখন সেই বডিতে আছেন 'গোরখা জনমুক্তি মোর্চা'র নেতা বিমল গুরুং, কালিম্পংএর এমএলএ, ডুয়ার্সের এমএলএ। সুভাষ ঘিষিং ২০০৫ এর নির্বাচনে হেরে যান বিমলের কাছে। এখন বিমল গুরুংই নেতা।
অবশ্য দার্জিলীংবাসীর দাবী আজও পুরো মানা হয়েছে বলে মনে হয় না। কেন্দ্র বা পশ্চিম বঙ্গ তেমন কিছু বলেনা।
তাছাড়া এ নিয়ে বিতর্ক আছে।
পরদিন সকালে হোটেলের ফ্রী নাশতা খেয়ে বেরুলুম দর্শনীয় জায়গা দেখার জন্য।
ভাল কথা প্রতিদিন ভোরে মানে রাত তিনটার দিকে পর্যটকরা গাড়ীতে করে টাইগার হিল নামক একটা পাহাড়ে সুর্যোদয় দেখতে যায়। সাথে আরো দুটো জায়গা দেখে। ভাবলুম আমরাও যাই।
সেইদিন রাত তিনটার দিকে ট্যাক্সির ড্রাইভার যখন দরজায় ডাকতে শুরু করলো তখন বাইরে টেম্পারেচার মনে হয় ৫-৬ ডিগ্রী হবে। ঐ কনকনে ঠান্ডায় খালি সুরুয দেখার জন্য ঘন্টা চারেক বাইরে ঘোরাঘুরিটা বহুদেশ ঘোরা এই প্রৌঢ়ের জন্য ভায়েবল মনে হলোনা। ড্রাইভারকে বলে দিলুম - 'যাবোনা', বলে আবার শুয়ে পড়লুম।
ভাবলুম দুর, সুর্য্য তো রোজই উঠে, না হয় বাসায় গিয়ে ছাদে উঠে আবার দেখে নেব, তবু এই শীতে বেরুতে পারবনা।
মাথা খারাপ!
যাহোক আগের প্রসঙ্গে ফিরে আসি।
গাড়িতে দার্জিলীংএর দর্শনীয় জায়গা দেখার জন্য প্যাকেজ আছে, দামটাও অনেক রকম। আমরা ৭ টা স্পট দেখার জন্য দরদস্তুর করে একটা ছো্ট্ট হাইওনদাই সান্ত্রো কারে উঠে পড়লুম দুজনেই।
ঘন্টা পাঁচেকের ভ্রমন।
দেখা হলো জাপানিজ মন্দির,
টেম্পল অফ পিস,
চিড়িয়াখানা আর একটা শিক্ষাপ্রতিস্ঠান
শেরপা তেনজিং নোরগের মুর্তিসমেত যাদুঘর,
রোপওয়েতে ভ্রমন
মাউন্টেনয়ারিং
চাবাগানে চাগাছ দেখা,
আরো কিছু দেখার জায়গা দেখে বাড়ী ফিরলুম সন্ধ্যে নাগাদ। একটু পরেই আবার এলুম গোর্খাদের মাসব্যাপি সাংস্কৃতিক মাস দেখার জন্য।
পরদিন আবার ফেরৎ চলে আসতে হবে কোলকাতা। রাত ন'টায় ট্রেন। হোটেল থেকে বেরিয়ে চলে এলুম ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে। শেয়ারে একটা ট্যাক্সিতে চড়ে বসলুম, গন্তব্য এনজেপি মানে নিউজলপাইগুড়ি।
একটু গোল বাধলো শিলিগুড়ি আসার পর কারণ এনজেপি থেকে শিলিগুড়ি আধ ঘন্টার পথ। মনে নেই যে আসার সময় ট্যাক্সিওয়ালা শুধু শিলিগুড়ির কথা বলেছিল এনজেপির কথা বলেনি। যাত্রীরা সবাই আমাকে বলল ফায়সলা করতে।
আমি চালককে বললুম বাপু তুমি আর কত টাকা চাএ? সে বলল দেড়শ টাকার বদলে মাথাপিছু দুশ টাকা করে লাগবে। আমি রাজি হলুম কারণ মাল পত্তর নিয়ে অন্য কোন গাড়িতে যাওয়া অনেক ঝামেলার ব্যাপার। সবাই মিলে আবার চললুম এনজেপি। বেলা তিনটার মধ্যে আমরা এনজেপি স্টেশনে। বসে পড়লুম ওয়েটিং রুমে। বিশাল বড় আর বেশ বিলাসবহুল ওয়েটিং রুম, এসি চলছিল্ চেয়ারে নীচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে লোকেরা বসেছে। গোলমাল নেই, মৃদু কথাবার্তা হচ্ছে। কেউ ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে। কাছেই চমৎকার একটা খাবার ক্যান্টিন,বহু রকমের খাবার পাওয়া যায়। আমরা কিছু খাবার কিনে এনে দুজনে খেয়ে নিলুম। আমাদের ট্রেন রাত ন'টায় এত্তো আগে এসে পড়েছি! পরে দেখলুম আরো বহু যাত্রী আমাদের ঐ ট্রেনেই যাবে এসেছে পাচ ছ ঘন্টা আগে!
এতো আগে আসবার কারনটা হলো হোটেল থেকে চেক আউট করতে হয় বেলা ১১ টার মধ্যে সুতরাং আপনাকে ঐ সময়ে রওয়ানা হলে দুটো তিনটের মধ্যেই স্টেশনে এসে পড়বেন। নাহলে ১১ টার পরে রওয়ানা হলে আবার আরেকদিনের ভাড়া গুনতে হবে। সমস্যা আরো আছে, পাহাড়ে সন্ধ্যের পর গাড়ি চলেনা, বিপদ্জ্জনক রাস্তা।
যাহোক রাত ন'টায় ট্রেন চাড়লো, ঠিক ন'টায়।
আমাদের ঘুমোবার বার্থ নিয়ে সমস্যা হলো। আমাদের দুজনেরই সীট পড়েছে উপরের বার্থে, আর গিন্নীর পক্ষে উপরে উঠা সম্ভব না।
প্যাসেন্জারদের মধ্যে এক তরুন ছিল যার ছিল নীচের বার্থ। তাকে সমস্যাটার কথা বলে বললুম বাবা তুমি যদি দয়া করে উপরে ঘুমাও তাহলে আমাদের বড়ই উপকার হত। সুদর্শন পান্জাবী তরুণ হালকা খাবার খেয়ে বিনা বাক্য ব্যায়ে উপরে উঠে গেল। মায় আমাদের খেতে সাধলোও, আমরা বিনয়ের সাথে ধন্যবাদ দিয়ে বললুম 'তুমি খাও'।
আমরা নীচে বিছানা করে বসলুম। ১১ টা নাগাদ ঘুম ।
পরদিন সকাল ন'টায় শেয়ালদা স্টেশন।
৩৮টি মন্তব্য ৩৮টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন
জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন
এখানে সেরা ইগো কার?
ব্লগারদের মাঝে কাদের ইগো জনিত সমস্যা আছে? ইগোককে আঘাত লাগলে কেউ কেউ আদিম রোমান শিল্ড ব্যবহার করে,নাহয় পুতিনের মত প্রটেকটেড বুলেটপ্রুফ গাড়ি ব্যবহার করে।ইগো আপনাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছে, টের পেয়েছেন... ...বাকিটুকু পড়ুন
এবং আপনারা যারা কবিতা শুনতে জানেন না।
‘August is the cruelest month’ বিশ্বখ্যাত কবি টিএস এলিয়টের কালজয়ী কাব্যগ্রন্থ ‘The Westland’-র এ অমোঘ বাণী যে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এমন করে এক অনিবার্য নিয়তির মতো সত্য হয়ে উঠবে, তা বাঙালি... ...বাকিটুকু পড়ুন
=বেলা যে যায় চলে=
রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।
সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন
মার্কিন নির্বাচনে এবার থাকছে বাংলা ব্যালট পেপার
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলার উজ্জ্বল উপস্থিতি। একমাত্র এশীয় ভাষা হিসাবে ব্যালট পেপারে স্থান করে নিল বাংলা।সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের ব্যালট পেপারে অন্য ভাষার সঙ্গে রয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন