সেই ছোটবেলা থেকেই পুরাণের গল্পে রামায়ণ মহাভারতে কাহিনীগুলোতে অপ্সরাদের কথা শুনে আসছি ।আজ তাই নিজেও কিছু লেখার জন্য বসলাম ।
অপ্সরা হচ্ছে হিন্দু এবং বৌদ্ধ পুরাণ অনুসারে মেঘ এবং জল থেকে উদ্ভুদ্ধ এক নারীর আত্মা।
একজন অপ্সরা সংস্কৃত ভাষায় কখনও বহুবচন বুঝিয়েছেন আবার তাছাড়াও খেমের অনুসারে বিদ্যাধারী পালি বা ভিয়েতনামি, বিদ্যাধারী অন্যদিকে ইন্দোনেশীয় এবং মালয় ভাষা একে Biraddali,Tausug, বা হপ্সরী অথবা Widodari জাভানীয় এবং অপ্সন হিসাবেও পরিচিত বা বুঝানো হয়েছে অথবা ডাকা হয় । অপ্সরা শব্দের ইংরেজি অনুবাদ হল জলপরী অনেকে একে স্বর্গীয় জলপরী এবং স্বর্গীয় কুমারী বলেও অন্তর্ভুক্ত করে থাকেন।
সংস্কৃত শব্দ অপ্স বাংলায় এর অর্থ জল বা পানি হতে এদের উৎপত্তি তাই এদের অপ্সরা বলা হয়। এরা নাচে গানে পারদর্শী ছিলেন। এই কারণেই তাদের ইন্দ্রের সভা গায়িকা এবং নর্তকী হিসেবে দেখা যায়। অপ্সরাদের অধিপতি ছিলেন কামদেব। অপ্সরাদের সংখ্যা মোটামুটি ভাবে প্রায় ৬০ কোটি হবে।
যাই হোক এসব অপ্সরাদের কথা যে শুধু আমি শুনেছি আমি ভাবসি তাই না, আমার মত আরো অনেকেই আছেন যারা অপ্সরাদের নিয়ে ভাবেন এমন কি অপ্সরাদের মতো সুন্দরী সঙ্গিনীও অনেকেই চান। কিন্তু অপ্সরাদের সম্পর্কে অনেককিছুই আমরা অনেকে জানি না, তাই চলুন অপ্সরাদের সম্পর্কে আগে কিছু অজানা তথ্য জেনে নিইঃ
(১) অপ্সরারা হলেন এক ধরনের উপদেবী।
(২) দুই ধরনের অপ্সরা আছেন (ক) লৌকিক এবং(খ) দৈবিক। লৌকিক অপ্সরারা সংখ্যায় ৩৪ এবং দৈবিক অপ্সরারা সংখ্যায় মোটামুটি ১০ জনের মত হবে।
(৩) একটি মত অনুযায়ী ইন্দ্রের সভায় ২৬ জন অপ্সরা রয়েছেন এবং তারা প্রত্যেকেই এক একটি শিল্পকলায় পারদর্শী।
(৪) শুধু হিন্দুধর্ম নয়, বৌদ্ধধর্মেও অপ্সরাদের উল্লেখ রয়েছে।
(৫) ঋগ্বেদ অনুযায়ী অপ্সরা হলেন গন্ধর্বের স্ত্রী। বেদে একমাত্র উর্বশীর নামেরই উল্লেখ রয়েছে। পরবর্তীকালের অন্যান্য পৌরাণিক গল্পে ইন্দ্রের সভানর্তকীদের সবাইকেই অপ্সরা বলা হয়েছে।
(৬) এদেশে যারা অপ্সরা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তারাই হল ‘বিদাদরি’। সংস্কৃত বিদ্যাধারা থেকেই শব্দটি উৎপন্ন বলে মনে করা হয়। এর অর্থ জ্ঞানের ভাণ্ডার।
(৭) কম্বোডিয়ার একটি বিখ্যাত নৃত্যকলা রয়েছে যা পশ্চিমে ‘অপ্সরা ডান্স’ নামে পরিচিত।
(৮) চিনের বিখ্যাত বৌদ্ধ গুহাগুলি যেমন মোগাও কেভ, ইউলিন কেভ, ইয়ুংগাং এবং লংমেন গ্রোটোস ইত্যাদির গুহাচিত্রে বহু অপ্সরা অঙ্কিত রয়েছে।
(৯) প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী অপ্সরারা ইচ্ছে মতো রূপ ধারণ করতে পারেন এবং তারা জুয়া খেলায় ভাগ্য নির্ধারণ করেন।
(১০) উর্বশী সবচেয়ে নামী অপ্সরা হলেও অপ্সরাদের রানি কিন্তু রম্ভা। রামায়ণে রাবণ রম্ভাকে অসম্মান করেছিলেন এবং তার পরেই ব্রহ্মা তাকে শাপ দিয়ে বলেন যে, যদি আর একজন নারীর অসম্মান তিনি করেন- তবে মাথা ফেটে তিনি মারা যাবেন। শেষ পর্যন্ত সেই শাপই সত্য হয়। সীতাকে অপহরণ এবং রামের হাতে রাবণের মৃত্যু, এই সবকিছুর মূলে কিন্তু ছিল রম্ভার সম্মানহনন।
(১১) তবে অন্য একটি মত অনুযায়ী রম্ভা হলেন কুবের-এর ছেলে নলকুবের-এর স্ত্রী এবং তিনিই শাপ দিয়েছিলেন রাবণকে।
দেবাসুরের সমুদ্র মন্থনের সময়ে এরা সমুদ্রের ভিতর থেকে অসংখ্য নারীর সথে উঠে আসেন। কিন্তু কোন দেবদানবই তাদের গ্রহণ করতে রাজী হন নাই তাই তারা সাধারণ নারী হিসেবেই গণ্য হতে থাকেন। তাছাড়াও মনুসংহিতায় তাদের জন্ম সম্পর্কে বলা হয়েছে যে সাতজন মনুর সৃষ্টি তারা।(মনুসংহিতা) আবার অন্যদিকে ঋগ্বেদ অনুযায়ী অপ্সরা হচ্ছেন গন্ধর্বের স্ত্রী। বেদে একমাত্র উর্বশীর নামেরই উল্লেখ রয়েছে। পরবর্তীকালের অন্যান্য পৌরাণিক গল্পে ইন্দ্রের সভানর্তকীদের সবাইকেই অপ্সরা বলা হয়েছে। অপ্সরাদের সৌন্দর্য কথা সব সময়ে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়। অপ্সরারা মায়ারূপীনী, সেইজন্য নিজেদের দেহের পরিবর্তন করতে পারতো। কম্বোডিয়ার একটি বিখ্যাত নৃত্যকলা রয়েছে যা পশ্চিমে অপ্সরা ডান্স নামে পরিচিত। চিনের বিখ্যাত বৌদ্ধ গুহাগুলি যেমন মোগাও কেভ, ইউলিন কেভ, ইয়ুংগাং এবং লংমেন গ্রোটোস ইত্যাদির গুহাচিত্রে বহু অপ্সরা অঙ্কিত রয়েছে। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী অপ্সরারা ইচ্ছে মতো রূপ ধারণ করতে পারেন এবং তারা জুয়া খেলায় ভাগ্য নির্ধারণ করেন।
একটি মত অনুযায়ী ইন্দ্রের সভায় ২৬ জন অপ্সরা রয়েছেন এবং এরা প্রত্যেকেই এক একটি শিল্পকলায় পারদর্শী।অপ্সরাদের মধ্যে অন্যতমা হলেন উর্বশী, মেনকা, রম্ভা, তিলোত্তমা। তাছাড়া ঘৃতাচী, অলম্বুষা, মিশ্রকেশী্, জানপদী এবং বিদ্যুৎপর্ণা, অদ্রিকা, পঞ্চচূড়া, সোমা, মরীচি, শুচিকা, অম্বিকা, ক্ষেমা, অসিতা, সুবাহু, সুপ্রিয়া, সুগন্ধা, সুরসা, বিশ্বাচী, পূর্বচিত্তি, প্রম্লোচা, বর্গা, প্রমথিনী, কাম্যা, শারদ্বতী, গুণবরা, ঋতুস্থলা, বুদ্বুদা, সৌরভেয়ী, ইরা, চিত্রাসেনা, সমীচী, চারুনেত্রা, পুঞ্জিকস্থলা, শুচিস্মিতা, বিশালনয়নার নামও নানা স্থানে উল্লেখিত হয়েছে।দেবরাজ ইন্দ্র প্রায়েই অপ্সরাদের মর্তে পাঠাতেন মুনি ঋষিদের প্রলোভিত করে ধ্যান ভঙ্গ করার জন্য। কারণ ধ্যান সমাপ্ত হলে তারা প্রবল পরাক্রান্ত হয়ে ওর ইন্দ্রত্ব দাবী করে বসতে পারেন ।
উর্বশী অপ্সরা
সুন্দরীশ্রেষ্ঠা ও অনন্তযৌবনা অপ্সরাবিশেষ।উর্বশী অপরূপ রূপলাবণ্যময়ী স্বর্গের অপ্সরী।উর্বশীর কি ভাবে জন্ম হয়েছে তা নিয়ে নানা ধরনের মত প্রচলিত আছে। কারো কারো মতে উর্বশী নারায়ণের উরু ভেদ করে জন্মগ্রহণ করেন তাই তার নাম উর্বশী। আবার একথাও বলা হয় সমুদ্র হতে উর্বশীর জন্ম। এটাও প্রচলিত যে উর্বশী সাতজন মনুর সৃষ্টি।
ঋগ্বেদে উর্বশী
ঋগ্বেদে উর্বশী ও পুরূরবার প্রেম কাহিনী সম্পর্কে অল্পবিস্তর জানা যায়। কিন্তু সম্পূর্ণ কাহিনী পাওয়া যায় শতপথব্রাহ্মণে।একদিন ইন্দ্রের নৃত্যসভায় রাজা পু্রূরবা আমন্ত্রিত হন। নৃত্যের জন্য উবর্শীকে অনুরোধ করলে তিনি নৃত্য শুরু করেন। কিন্তু উর্বশী রাজা পুরূরবার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তার দিকে দৃষ্টি দিলে উর্বশীর নৃত্যের ছন্দ ভঙ্গ হয়। ফলে ইন্দ্র উর্বশীকে অভিশাপ দেন। এবং তাকে পৃথিবীতে সাধারণ মানুষ হিসেবে বসবাস করতে হবে।উর্বশী এই অভিশাপ শোনার পরে দেবতা ইন্দ্রের কাছে একটি আর্জি করেন। উর্বশী মর্ত্যলোকে পু্রূরবার স্ত্রী হিসেবে থাকতে চান। দেবতা ইন্দ্র তার এই মনোবাসনা পুরণ করেন কিন্তু এখানে ইন্দ্র কয়েকটি শর্ত দিয়ে দেন। শর্তগুলো অনেকটা এই রকম যে দিনে তিনবার পুরূরবা উর্বশীকে আলিঙ্গন করতে পারবে। উর্বশীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে পুরূরবা কখনো উর্বশীর সাথে মিলিত হতে পারবেন না এবং উর্বশী কখনো পুরূরবাকে নগ্ন অবস্থায় দেখতে পারবে না।উর্বশী এই শর্তগুলো মেনে নিয়ে মর্ত্যলোকে পুরূরবার স্ত্রী হিসেবে বসবাস করতে রাজী হলেন। এই ভাবে পুরূরবার স্ত্রী হিসেবে উবর্শী বহু বছর পার করে দেন। বহু বছর গত হবার পর স্বর্গের সভাসদগন স্বর্গে উর্বশীর অভাব অনুভব করলেন। এখন কি ভাবে তাকে ফিরিয়ে আনা যায় সেই পথ খুঁজতে থাকেন। অনেক চিন্তা ভাবনার পরে তারা একটি বুদ্ধি বের করলেন। তো স্বর্গের সভাসদরা উর্বশীর শয়ন কক্ষে দুইটি মেষশাবক বেঁধে দিয়ে যান স্বর্গের উপহার হিসেবে। এই মেষশাবক দুইটি সবসময়ই উর্বশীর শয়ন কক্ষেই থাকত। তো একদিন রাতে এই দুইটি মেষশাবকের মধ্যে একটি চুরি করে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করেন স্বর্গের সভাসদরা। মেষশাবক চুরি করার সময় উর্বশী টের পেয়ে যান। উর্বশী রাজাকে অনুরোধ করেন চোর ধরে আনার জন্য। রাজা উর্বশীর কথায় হন্তদন্ত হয়ে নিদ্রা থেকে উঠে পরেন। এই সময় রাজা উলঙ্গ অবস্থায় ছিলেন। রাত ছিল বিধায় রাজার উলঙ্গ অবস্থা উর্বশী দেখতে পাচ্ছিলেন না। সে সময় স্বর্গের সভাসদরা সেটা বুঝতে পেরে দ্রুত বজ্রের সাহায্যে বিদ্যুতের সৃষ্টি করলেন এবং তার আলোয় ঘর ভরে উঠল। সে সময় উর্বশী রাজার নগ্ন অবস্থা দেখে ফেলে। ফলে উর্বশী তার শাপ মুক্ত হয়ে সাথে সাথে অদৃশ্য হয়ে যান।
এটা সমুদ্র হতে উঠে আসা একজন উর্বরশী অপ্সরার ছবি ।
উর্বশীকে হারানোর শোকে রাজা পুরূরবা দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। ধীরে ধীরে উর্বশীকে পুনরায় পাবার আশা ক্ষীণ হতে লাগল। কিন্তু একদিন কুরুক্ষেত্রের নিকটে আরো চারজন অপ্সরীর সাথে উর্বশীকে দেখতে পেলেন স্নানরত অবস্থায়। রাজা উর্বশীকে বার বার অনুরোধ করতে লাগলেন ফিরে আসার জন্য। কিন্তু উর্বশী কোন ভাবেই রাজী হচ্ছিল না। এই ভাবে বেশ কয়েক দিন যাওয়ার পর একদিন উর্বশী বলেন বছরের শেষ রাতে আসলে আমি তোমার সাথে শয্যা গ্রহণ করব। এর ফলে আমাদের একটি পুত্র সন্তান জন্ম হবে। তো রাজা পুরূরবা বছরের শেষ রাত্রিতে এসে উর্বশীর সাথে শয্যা গ্রহণ করলেন এবং তাদের একটি পুত্র সন্তান জন্ম গ্রহণ করল। এভাবে প্রতিবছরের শেষ দিন উর্বশী ও পুরূরবার মিলন হতে থাকল এবং প্রতিবছর একটি করে পুত্র সন্তান জন্ম নিতে থাকল। বলা হয় যে উর্বশী এবং পুরূরবার পুত্র সন্তানের সংখ্যা পাঁচ জন।একদিন উর্বশী এসে পুরূরবাকে বললেন যে- দেবতা তোমার মনের ইচ্ছে পুরণ করবে, তবে একটা শর্ত আছে। পুরুরবা শর্ত শুনতে চাইলেন। উর্বশী বলল স্থায়ী ভাবে মর্ত্যলোক ছেড়ে স্বর্গলোকে এসে সাধারণ ভাবে জীবন যাপন করতে হবে। এই জন্য তাকে একবার মৃত্যুকে গ্রহণ করতে হবে। পুরূরবা এই শর্তে রাজী হয়ে গেলেন। এরপর থেকে উর্বশী এবং পুরূরবা এক সাথে আবার বসবাস শুরু করলেন।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ভোর ৪:২৬