পর্নোগ্রাফি সংক্ষেপে হলো যৌন উদ্দীপনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে যৌনসংক্রান্ত বিষয়বস্তুর প্রতিকৃতি অঙ্কন বা পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা। পর্নোগ্রাফি বিভিন্ন মাধ্যমের সাহায্যে উপস্থাপন করা হতে পারে তার মধ্যে অর্ন্তভূক্ত রয়েছে, বই, সাময়িকী, পোষ্টকার্ড, আলোকচিত্র, ভাস্কর্য, অঙ্কন, পেইন্টিং, অ্যানিমেশন, সাউন্ড রেকর্ডিং চলচ্চিত্র, ভিডিও এবং ভিডিও গেম।
বিগত কয়েক দশকে পর্নোগ্রাফি উৎপাদন তথা ভোগ্যপণ্য হিসেবে ভোগকে কেন্দ্র করে একটি বিরাট শিল্প গড়ে উঠেছে। মূলত ভিসিআর, ডিভিডি ও ইন্টারনেটের ব্যাপক ব্যবহার এবং যৌন বিষয়বস্তুর প্রদর্শনে সমাজের অধিকতর উদার মনোভাব এই শিল্প গড়ে ওঠার অন্যতম কারন। পর্নোগ্রাফির অভিনেতাদের পর্নোগ্রাফিক অভিনেতা বা অভিনেত্রী বলা হয়ে থাকে। তারা সাধারণত পর্ন স্টার নামেই পরিচিত হন। মূলধারার অভিনেতা অভিনেত্রীদের তুলনায় তাদের অভিনয়ের গুণমানও সাধারণত পৃথক হয়। শখের পর্নোগ্রাফি এই শিল্পের জনপ্রিয় একটি ধারা এবং তা ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিনামূল্যে বিতরিত হয়ে থাকে।পর্নোগ্রাফির মাধ্যম একাধিক হতে পারে মুদ্রিত সাহিত্য, ফটোগ্রাফ, ভাস্কর্য, অঙ্কন, চিত্রকলা, অ্যানিমেশন, শব্দ রেকর্ডিং, পর্নোগ্রাফিক চলচ্চিত্র, ভিডিও, অথবা ভিডিও গেম। অবশ্য সরাসরি দর্শকদের সামনে যৌন ক্রিয়াকলাপ আচরিত হলে তাকে সংজ্ঞা অনুসারে পর্নোগ্রাফি বলা হয় না। কারণ পর্নোগ্রাফি বলতে উক্ত আচরণটিকে বোঝায় না বোঝায় উক্ত আচরণের বর্ণনাকে। এই কারণে সেক্স শো ও স্ট্রিপটিজ জাতীয় প্রদর্শনীকে পর্নোগ্রাফির পর্যায়ভুক্ত করা হয় না।দেশভেদে পর্নোগ্রাফি তথা শিল্পে নগ্নতার প্রদর্শনী ও ফটোগ্রাফির প্রতি সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও আইনগত দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।সাম্প্রতিককালে পর্নোগ্রাফির আসক্তি সৃষ্টিকারি বৈশিষ্টের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
লঘু পর্নোগ্রাফি হল বাণিজ্যিক নিশ্চল ফটোগ্রাফি বা ছবি যাতে অশ্লীল যৌন-উদ্দীপনামূলক বিষয়বস্তু থাকে কিন্তু তা পর্নোগ্রাফির মত সুস্পষ্ট নয়।এতে প্রধানত অর্ধনগ্ন ও নগ্ন কলাকুশলী ও যৌনদৃশ্যের মাধ্যমে যৌন-উদ্দীপনা সৃষ্টি করা হয়।[১] বিভিন্ন ম্যাগাজিন ও সমাচারপত্রে নগ্ন অভিনেতা বা মডেলদের ছবি সরাসরিই দেখানো হয়।তবে লঘু পর্নোগ্রাফিতে পুরুষ বা নারী যৌনাঙ্গ দেখানো হয় না। বিভিন্ন আর্ট ফিল্মে এই ধরনের নগ্নতাকে নান্দনিক দৃষ্টিকোণ থেকেও ব্যবহার করা হয়।
পর্নোগ্রাফি আসক্তি একটি প্রস্তাবিত মনোবৈজ্ঞানিক মডেল, যার সাহায্যে নেতিবাচক শারীরিক, মানসিক, সামাজিক অথবা আর্থিক পরিণতি ঘটা সত্ত্বেও, কোনো ব্যক্তির পর্নোগ্রাফি সংশ্লিষ্ট ভোগ্যপণ্যের ব্যবহার দ্বারা তাড়িত অমোঘ যৌন ক্রিয়াকলাপকে ব্যাখ্যা করা হয়। ইঙ্গিতনির্ভর প্রতিক্রিয়া পরীক্ষার মাধ্যমে সাইবারসেক্সের পারিতোষণ ও ক্রমশ আকর্ষণ শক্তিশালীকরণমূলক বৈশিষ্টের প্রমাণ পাওয়া গেছে।সমস্যাপ্রবণ ইন্টারনেট পর্নোগ্রাফি দেখা বলতে বোঝায় এমন কোন উপায়ে পর্নোগ্রাফি দেখা যেটি একজন ব্যক্তির জন্য ব্যক্তিগত বা সামাজিক দিক থেকে ক্ষতিকর এবং সমাজের অন্যান্য সদস্যদের সাথে মিথস্ক্রিয়ার জন্য বরাদ্দকৃত মূল্যবান সময় সেটি দেখার পেছনে ব্যয়িত হয়। আসক্ত ব্যক্তিরা হয়ত বিষণ্নতা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, চাকরি হারানো, বেকারত্ব অথবা তাদের সামাজিক জীবনের উপর পর্নোগ্রাফির কুপ্রভাবের কারণে আর্থিক সংকটসহ নানাবিধ অসুবিধায় ভুগতে পারেন।পর্নোগ্রাফি আসক্তি বা সমস্যাপ্রবণ পর্নোগ্রাফি দেখাকে রোগ হিসেবে শনাক্তকরণের জন্য কোন সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত রোগ নির্ণয়ের মানদন্ড নেই।২০১৩ সালে প্রকাশিত Diagnostic and Statistical Manual of Mental Disorders এর পঞ্চম সংস্করণে DSM-5 এ আচরণিক আসক্তি হিসেবে শুধুমাত্র সমস্যাপ্রবণ জুয়া খেলা নির্ণয়ের মানদন্ড নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি অনেকটা মাদকাসক্তি নির্ণয়ের মানদন্ডের ধারাসমূহ যেমন নির্দিষ্ট আচরণ সম্পর্কে সার্বক্ষণিক চিন্তাবিষ্টতা, আচরণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কমে যাওয়া, মাদক সহনশীলতা, মাদক নির্ভরশীলতা, মাদক প্রত্যাহার উপসর্গ এবং প্রতিকূল মনোসামাজিক পরিণতি প্রভৃতির অনুরূপ। তবে অন্যান্য আচরণিক আসক্তি নির্ণয়ের জন্য রোগ নির্ণয়ের মানদন্ড নির্ধারণ করা হয়েছে, যেগুলো মূলত মাদকাসক্তি নির্ণয়ের প্রচলিত মানদন্ডের উপর প্রতিষ্ঠিত।
পর্নোগ্রাফি দেখার কারনে ক্ষয়ক্ষতিঃ
পর্নোগ্রাফি দেখার কুফল অনেক। নিয়মিত পর্নো ছবি দেখার মাধ্যমে নিজের অজান্তেই নিজের ক্ষতি করে ফেলছেন অসংখ্য পুরুষ।প্রথমত পর্নো আসক্ত পুরুষদের সাধারণত রুচিশীল নারীরা হীনম্মন্য ও চরিত্রহীন মনে করে। নারীরা যখন জানতে পারে তার পরিচিত কোনো পুরুষ নিয়মিত পর্নো ছবি দেখে, তখন তার সম্পর্কে খারাপ মনোভাব জন্ম নেয়। এবং তাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে।
দ্বিতীয়ত, রুচিবোধের অধঃপতন হয়। যারা নিয়মিত পর্নো সিনেমা দেখেন তাদের রুচি বিকৃত হয়ে যায়। জীবনের স্বাভাবিক সম্পর্কগুলোতেও নিজের অজান্তে বিকৃতি খোঁজে তাদের চোখ।তৃতীয়ত নিয়মিত পর্নো ছবি দেখতে দেখতে পুরুষরা বাস্তবতাকেই হারিয়ে ফেলেন। বাস্তব জীবনেও তারা তেমন সঙ্গীই আশা করে। সাধারণ নারীদের তখন আর তাদের যথেষ্ট মনে হয় না। ফলে জীবনের সুখ শান্তি হারিয়ে যায় তাদের।পর্নো নায়িকাদের সৌন্দর্য কৃত্রিম আচরণও কৃত্রিম। মেকআপ, লাইট ও ক্যামেরার কারসাজিতে তাদের মোহনীয়ভাবে দেখানো হয় যা বাস্তব জীবনে খুঁজে পাওয়া সম্ভব না। তাই পর্নো আসক্তরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিঃসঙ্গ থেকে যায় অথবা সংসারে অসুখী হয়।চতুর্থত নিয়মিত পর্নো ছবি যারা দেখেন তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে বিকৃত অভ্যাস যার অতিরিক্ত প্রয়োগে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বাড়ে এবং যৌন জীবনে নানান সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়।পঞ্চমত এটি এক ভয়াল নেশা। পর্নো সিনেমার নেশা মাদকের নেশার মতোই ভয়ংকর। মাদকাসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়া যেমন কষ্টসাধ্য পর্নো আসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়াও দুরূহ ব্যাপার। পর্নো আসক্তির কারণে পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়, পড়াশোনায় ক্ষতি হয় এমনকি নিজের মধ্যেও হীনম্মন্যতার সৃষ্টি হয়।ষষ্ঠতঃ পর্নো আসক্তদের মোবাইল ফোনে, কম্পিউটারে, পেনড্রাইভে সবখানেই পর্নো ছবি থাকে। অনেক সময় এসব অনৈতিক বিষয় পরিবারের কাছে ধরা পড়ে যায়। ফলে পর্নো-আসক্ত ব্যক্তিকে হেয় হতে হয়। এ ছাড়া হারাতে হয় ভালো বন্ধু-সার্কেলকেও।
পর্নোগ্রাফি নারী ও পুরুষ উভয়ের মধ্যেই যৌন উৎকল্পনার খোরাক যোগায়। তবে এক্স রেটেড ইমেজ এবং ফিল্ম উৎকাল্পনিক ইন্দ্রিয় সুখ দেয়ার পাশাপাশি স্বাস্থ্যেরও অনেক ক্ষতি করে ফেলে।মানসিক অবস্থার উপর বিভিন্ন ধরনের প্রভাব ফেলতে সক্ষম ও হরমোন নিঃসরণের পাশাপাশি আসক্তিমূলক প্রবণতাও সৃষ্টি করতে পারে পর্নোগ্রাফি। ফলে আমাদের মস্তিষ্কে পর্নোগ্রাফির মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাবও পড়তে পারে। আপনি যত বেশি পর্নগ্রাফি দেখবেন ততই আপনার মন দেখতে চাইবে। স্বাভাবিক যৌন সহবাস এবং পর্ন মুভি দেখা উভয়ের মাধ্যমেই মস্তিষ্কে ডোপামিন নামের হরমোন নিঃসরিত হয়। এই হরমোনের প্রভাবেই আমাদের মস্তিষ্কে আনন্দের অনুভুতি বা ইন্দ্রিয় সুখানুভুতির সৃষ্টি হয়।কিন্তু নিয়মিত পর্ন দেখার ফলে স্বল্পবিরতিতে বারবার ডোপামিন নিঃসরণের ফলে মস্তিষ্ক এই হরমোনটির কার্যকারীতার প্রতি সংবেদনশীলতা হারিয়ে ফেলতে পারে। জেএমএ সাইকিয়াট্রি নামের জার্নালে ২০১৪ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দাবি করা হয় নিয়িমিত পর্ণ মুভি দেখলে একটা সময়ে এসে যৌনতার প্রতি মস্তিষ্কের উদ্দীপনায় ঘাটতি নেমে আসতে পারে।তার মানে আগের মতো স্বাভাবিক মাত্রার যৌন উদ্দীপনা ধরে রাখতে হলে আরো বেশি হারে ডোপামিন নিঃসরণের দরকার পড়বে। তার জন্য আবার আরো বেশি বেশি পর্ন মুভি দেখার প্রয়োজন পড়বে। গবেষণায় এমনটাই প্রমাণ পেয়েছেন জার্মান বিশেষজ্ঞরা। সাইকোলজি টুডেতে প্রকাশিত ২০১১ সালের আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে এভাবে অতিরিক্ত ডোপামিনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়ার মানে হল যারা পর্ন মুভি দেখেন তাদের যৌন উত্তেজনা বা উদ্দীপনা সৃষ্টি হওয়ার জন্য উত্তোরত্তর চরম অভিজ্ঞতামূলক পরিস্থিতির প্রয়োজন পড়বে।পর্ন মুভিতে অমন অস্বাভাবিক যৌনাচরণ দেখার ফলে পুরুষরা ক্রমান্বয়ে যৌন সংবেদনশীলতা হারাতে থাকে এবং স্বাভাবিকভাবে যৌন উত্তেজনার সক্ষমতাও হারাতে থাকে।পর্নোগ্রাফি এমন একটি তরুণ প্রজন্ম সৃষ্টি করে যারা বেডরুমে হতাশায় ভোগে। পর্ন মস্তিষ্ককে সংকুচিত করে যারা নিয়মিত পর্ন মুভি দেখেন সম্ভবত তাদের মস্তিষ্ক সংকুচিত হয়ে আসতে থাকে। ওই জার্মান গবেষকরা এমনটাই আবিষ্কার করেছেন।মস্তিষ্কের যে অংশটুকুতে যৌন উদ্দীপনা ও ইন্দ্রিয় সুখানুভুতি সৃষ্টি হয় অতিরিক্ত পর্ন মুভি দেখার ফলে সে অংশটুকেু ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হয়ে আসতে থাকে।ওই গবেষণায়ই সর্বপ্রথম গবেষকরা নিয়মিত পর্ন মুভি দেখার সঙ্গে শারীরিক ক্ষয়ক্ষতির সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন। তবে এমন সম্ভাবনাও রয়েছে যারা বেশি বেশি পর্ন মুভি দেখেন তারা হয়তো একটি বিশেষ ধরনের মস্তিষ্ক নিয়েই জন্মগ্রহণ করেন। পর্ন আসক্তদের মন ড্রাগ আসক্তদের মতোই হয়ে পড়ে ।২০১৩ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে পর্ন আসক্তরা যখনই পর্ন মুভি দেখতে বসে তাদের মস্তিষ্কে স্ক্যান মেশিনের মতো আলো জ্বলে ওঠে।যেসব তরুণ অনলাইন পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত তারা উত্তেজক ছবি দেখামাত্রই তাদের মস্তিষ্কে ক্রিসমাস ট্রির মতো আলো জ্বলে ওঠে। সম্প্রতি এক গবেষণায় এমনটিই দেখা গেছে।মস্তিষ্কের যে অংশে উৎসাহ উদ্দীপনা ও ইন্দ্রিয় সুখানুভুতি সৃষ্টি হয় সে অংশটি ড্রাগ আসক্ত এবং পর্ন আসক্ত উভয়ের বেলায়ই সমান উচ্চহারে সক্রিয় থাকে।এর এক বছর পর একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে যারা অল্প বয়স থেকেই পর্ন মুভি দেখায় অভ্যস্থ হয়ে পড়ে তাদের মস্তিষ্কের তিনটি অংশ যারা পর্নআসক্ত নয় তাদের চেয়ে অনেক বেশি সক্রিয় থাকে।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা আগস্ট, ২০১৬ সকাল ১১:০৭