চার বছরের বাংলাদেশি আইনস্টাইন - সুবর্ণ!!
চার বছর বয়সে একটি শিশু সর্বোচ্চ কী করতে পারে? তার পছন্দের খেলনাগুলো ভাঙতে পারে, মা-বাবার কাছে নতুন খেলনার জন্য আবদার করতে পারে। যদিও আইনস্টাইনের কথা ভিন্ন। তিনি তো চার বছর পর্যন্ত কোন কথাই বলেননি। আইনস্টাইনের বাবা-মা ভেবেছিলেন আইনস্টাইন মনে হয় বোবা হয়ে জন্ম নিয়েছে। চার বছর বয়সে স্যুপ খাওয়ানোর সময় গরম অনুভব হওয়াতে তিনি প্রথমবার কথা বলেছিলেন। আর আইনস্টাইনকে চেনে না এমন মানুষ এখন খুঁজে পাওয়াই ভার।
আর যদি শোনেন সেই চার বছর বয়সেই কোনো শিশু ইংরেজি, জ্যামিতি, অ্যালজেবরা এবং রসায়নে সমান পারদর্শী তাহলে? ভাবছেন তা কিভাবে হয়? হ্যাঁ, সত্যি সত্যিই এই বিস্ময় বালকের নাম সুবর্ণ আইজ্যাক বারী।
যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশি দম্পতি রাশেদুল বারি ও শাহেদা বারির সন্তান সে। সুবর্ণের জন্ম ২০১২ সালের ৯ এপ্রিল। তার পুরো নাম সুবর্ণ আইজ্যাক বারি। তার স্বপ্ন ১০ বছর বয়সেই সে হার্ভার্ডে ভর্তি হবে। সে এখন তার বাবার ল্যাবরেটরিতে যাচ্ছে এবং অঙ্কশাস্ত্র ছাড়াও রসায়নের বিভিন্ন বিভাগ সম্পর্কে ধারণা নিচ্ছে।
যদিও তার নামের সঙ্গে আইজ্যাক রয়েছে। কিন্তু তাকে বলা হচ্ছে ভবিষ্যতের আইনস্টাইন। কেননা এ বয়সেই সে ইংরেজি, অ্যালজেবরা, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা ও জ্যামিতিতে সমান পারদর্শী। স্কুলের আঙিনায় পা রাখার আগেই জ্যামিতি, অ্যালজেবরা, রসায়নের জটিল বিষয়ের সহজ সমাধান দিচ্ছে।
সুবর্ণ ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হইচই ফেলে দিয়েছে। অক্ষরজ্ঞানের প্রাতিষ্ঠানিক কোনো প্রক্রিয়া অবলম্বন করা ছাড়াই কীভাবে সে ইংরেজি বই অবলীলায় পড়ছে! তাই কৌতূহলের অন্ত নেই বিস্ময়শিশু সুবর্ণকে ঘিরে।
মাত্র দেড় বছর বয়সে রসায়নের পর্যায় সারণি তথা কেমিস্ট্রি পিরিয়ডিক টেবিল মুখস্থ, দুই বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের কলেজে সাক্ষাৎকার, ভয়েস অব আমেরিকাকে সাক্ষাৎকার, তিন বছর বয়সে লেবুর সাহায্যে ব্যাটারি এক্সপেরিমেন্ট এবং সাড়ে তিন বছর বয়সে খ্যাতনামা একটি কলেজের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের আমন্ত্রণ! সত্যি চোখ কপালে ওঠার মতো ব্যাপারই।
অত্যন্ত মেধাবী এই ছেলের প্রতিভা সম্পর্কে বাবা-মা প্রথম বুঝতে পারেন ২০১৩ সালে যখন তার বয়স মাত্র এক বছর। তখন সুবর্ণ নিউইয়র্কের একটি হাসপাতালের বিছানায় জ্বরে কাতরাচ্ছিল। সেখানে একদিন তার বাবা রাশীদুল বারি তাকে বললেন, ‘আই লাভ ইউ মোর দ্যান এনিথিং ইন দ্য ইউনিভার্স’।(আমি তোমাকে মহাবিশ্বের সবকিছুর চেয়ে বেশি ভালোবাসি) সুবর্ণ তখন বলল, ‘ইউনিভার্স অর মাল্টিভার্স?( মহাবিশ্ব না বহুবিশ্ব?)’ এতে চমকে গেলেন কলেজশিক্ষক রাশেদুল বারি। কিন্তু তখনো তিনি জানতেন না এই সুবর্ণ তিন বছর বয়সে অঙ্ক, পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নে দক্ষতা দেখিয়ে সাড়া ফেলবে।
এর কয়েক মাস পর একদিন সুবর্ণকে তার মা অঙ্ক শেখাচ্ছিলেন। হঠাৎ সুবর্ণ তার মাকে বলল, “If 1 + 1 = 2, then n + n must be 2n; if 2 x 2 = 4, then n x n must be …”
রাশেদুল বারি বলেন, স্ত্রীর কাছ থেকে এ কথা শুনে অভিভূত হয়ে পড়েন তিনি। আনন্দে তার চোখে জল এসে যায়। স্ত্রী জানতে চাইলেন, কাঁদছ কেন? দেড় বছরের ছেলের অঙ্কশাস্ত্র প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে রাশেদুল তাকে অ্যাডভান্সড ম্যাথ অ্যান্ড সায়েন্সের পাঠ দেওয়া শুরু করেন। আর এভাবেই মাত্র দুই বছর বয়সে সুবর্ণ রসায়নের পিরিয়ডিক টেবিল মুখস্থ করে ফেলে।
এদিকে এই অবিশ্বাস্য ও বিস্ময়কর প্রতিভাধর শিশুর কথা সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের ছাত্র-শিক্ষকদের মাঝে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এ অবস্থায় মেডগার এভার্স কলেজের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড পোজম্যান সুবর্ণর মেধা যাচাই করতে চান। সুবর্ণ পর্যায় সারণির সবগুলো এলিমেন্ট বলে পোজম্যানকে অবাক করে দেয়। সেদিন তিনি এতই মুগ্ধ হন যে তাকে তিনি ‘মোজার্ট অব কেমিস্ট্রি’ বলে অভিহিত করেন।
বিস্ময়কর প্রতিভার সুবর্ণর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর একদিন ডাক পড়ে তার ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগ থেকে। বাবা রাশেদুল বারি তাকে নিয়ে যান ওয়াশিংটন ডিসিতে ভয়েস অব আমেরিকার স্টুডিওতে। সেখানে সাবরিনা চৌধুরী ডোনা তার সাক্ষাৎকার নেন এবং বছরের সেরা সাক্ষাৎকার হিসেবে তারা এটা বাছাই করে নববর্ষে পুনঃপ্রচার করে।
ওই সাক্ষাৎকারেও সে নির্ভুলভাবে সব রাসায়নিক সংকেতগুলো বলে যায়। একটি আপেল কেটে সে সহজে বুঝিয়ে দেয় এটম তত্ত্ব। পরমাণুর বিভাজন (ইলেকট্রন, নিউট্রন, প্রোটন) বর্ণনা করে সে। কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে যখন আড়াই বছরের এই শিশু পর্যায় সারণির সব এলিমেন্টের নাম বলে যাচ্ছিল অবলীলায়।
ছোট্ট সুবর্ণ এরই মধ্যে অনেকগুলো সায়েন্টিফিক এক্সপেরিমেন্ট করেছে। যার একটি ইলেকট্রিক ব্যাটারি। সে জন্য সে আবার পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন অধ্যয়ন করছে। বিভিন্ন রকম ব্যাটারি সে বানাচ্ছে। তার একটি হচ্ছে লেমন ব্যাটারি। যেটা বানাতে তার দরকার হয় চারটি লেবু, চারটি পেরেক, চারটি মুদ্রা এবং পাঁচটি এলিগেটর কিপ। এগুলো দিয়ে সে ইলেকট্রিক সার্কিট বানিয়ে পোটেনশিয়াল ডিফারেন্স সৃষ্টি করে লাইট জ্বালাতে পারে। ২০১৫ সালের ১২ জুন লিমন কলেজের ফিজিক্সের চেয়ারম্যান ড. ড্যানিয়েল কাবাট সুবর্ণর এই প্রতিভা দেখার জন্য তাকে লিমন কলেজে আমন্ত্রণ জানান এবং সুবর্ণ ব্যাটারি বানিয়ে তাকে মুগ্ধ করে।
সুবর্ণের লেমন ব্যাটারি দেখে বিস্মিত হয়েছেন খোদ দ্য সিটি কলেজ অব নিউইয়র্কের প্রেসিডেন্ট লিসা কইকো। তিনি নিজেই এই শিশুর পরীক্ষা নেন। যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশি অনলাইন টেলিভিশন টাইম টেলিভিশনে তার একটি সাক্ষাৎকার ছাপানো হয়। এই সাক্ষাৎকারে দেখা যায়, বিস্ময় বালক সুবর্ণ একটি কলমকে লাঠির মতো ধরে সমাধান করে যাচ্ছে একের পর এক কঠিন গণিত, জ্যামিতি, পদার্থ বিজ্ঞানের সমাধান। রাসায়নিক সংকেতগুলো কোনো ভুল না করেই অনর্গল বলে যায়।
পৃথিবীর বিখ্যাত ‘অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর LouiseRichardson শিশু বিজ্ঞানী সুবর্ণ আইজ্যাক বারীর ৫ম জন্মদিনে গিফট পাঠিয়েছেন। তাকে চিঠি লিখে অভিবাদন জানিয়েছেন। তার মেধার প্রশংসা করেছেন। তার ভবিষ্যত সম্ভাবনাকে উৎসাহিত করেছেন। সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।
সুবর্ণর কর্মকাণ্ডে মুগ্ধ হয়ে গত ২ নভেম্বর ২০১৬ তাকে একটি চিঠি লিখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।
চিঠিতে বারাক ওবামা লিখেছেন, ‘’প্রিয় সুবর্ণ, আশা করছি তুমি তোমার কঠোর পরিশ্রম এবং অর্জনের জন্য গর্ব অনুভব করো। তোমার মতো শিক্ষার্থী আমেরিকায় আরো দরকার, যারা স্কুলে কঠোর পরিশ্রম করার চেষ্টা করে, বড় স্বপ্ন দেখে এবং আমাদের সমাজের পরিবর্তন ঘটায়। আমাদের দেশ অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। কিন্তু আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ হই তাহলে এসব মোকাবিলা করা কোনো ব্যাপারই নয়। তুমি তোমার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাও, আমি তোমার সঙ্গে আছি। তোমার কাছে আমি অনেক বড় কিছু প্রত্যাশা করি।‘’ ’
চট্টগ্রামের সন্তান রাশেদুল বারির জন্ম ১৯৭৯ সালে। উচ্চশিক্ষার জন্য নিউইয়র্কে আসার পর তিনি ব্রঙ্কসের লিমন কলেজে অধ্যয়ন করেছেন। বর্তমানে তিনি নিউইয়র্ক সিটি ইউনিভার্সিটির বারুখ কলেজে অঙ্কের খণ্ডকালীন অধ্যাপক এবং নিউ ভিশন চার্টার হাইস্কুল ফর অ্যাডভান্সড ম্যাথ অ্যান্ড সায়েন্সে পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক।
জেরুজালেম পোস্টে তিনি নিয়মিত কলাম লেখেন। রাষ্ট্রনীতি, গণিত, অর্থনীতিসহ পাঁচটি বিষয়ে তার স্নাতক ডিগ্রি রয়েছে। তার লেখা বই জার্মান সোশ্যাল বিজনেস মডেল আন্তর্জাতিক পরিচিত পেয়েছে। বর্তমানে তিনি ডক্টর ড্যানিয়েল কাবাতের সঙ্গে যৌথভাবে ম্যাথমেটিক্যাল ল’জ অব ফিজিক্স নামে একটি বই লিখছেন।
সুবর্ণর বড় ভাই রিফাত আলবার্ট বারির বয়স ১২। সে-ও অসাধারণ মেধাবী। সপ্তম গ্রেডে পড়ছে সে। হাইস্কুলে না গিয়েই বিশ্বখ্যাত হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে চায় রিফাত। এ জন্য সে তিনবার এসএটিও দিয়েছে।
সুবর্ণর মা শাহেদা বারি রেমন বারি ব্রঙ্কস কমিউনিটি কলেজ থেকে হিসাববিজ্ঞানে ডিগ্রি নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের সন্তানের মেধার জন্য আমরা গর্বিত।
আমাদের সন্তান, বাংলাদেশের রক্তের উত্তরাধিকারী, ভবিষ্যৎ আইনস্টাইন সুবর্ণ'র জন্য শুভ কামনা।
(ক্ষুদে জিনিয়াস'দের কথা গ্রন্থ থেকে)
প্রবাসে বাংলাদেশের রক্তের উত্তরাধিকারী গুণীগন,পর্ব ১ হইতে ১৫৫ এখানে।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মার্চ, ২০১৭ দুপুর ১:০১