গ্রামের ছেলে,বয়সে যুবক অথচ ডাব বা রস চুরির অভিজ্ঞতা নাই,সেকালে এরা ছিল রীতিমত যুবসমাজের কলঙ্ক।
এস এস সি পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে বেকার বসে আছি, ভাবলাম এই ফাঁকে কোর্সটা করে নিলে মন্দ হয়না। সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। আমাদের মত কলঙ্কিত কিছু যুবকের কালিমা মোচনে এগিয়ে এলো গবি। এ লাইনে তার ব্যাপক অভিজ্ঞতা! অন্যের খোঁয়াড়ের হাস,মুরগী নিজের গোলার ধান,চাল সরানো জাতীয় তস্কর বৃত্তিতে তার উচ্চতর ডিগ্রী ছিল। তাছাড়া সে গৌরেও আছে আবার শ্মশানেও আছে। আশপাশের দুচার গ্রামে এমন কোন ওয়াজ মাহফিল নাই যেখানে সে যায় না, আবার আশপাশের ১৫/২০ গ্রামে এমন কোন যাত্রার মেহফিল নাই যেখানে সে তাশরিফ রাখেনা। এরকম একজন কামেল আদমিকে প্রশিক্ষক হিসেবে পেয়ে আমরা পুলকিত।
সিদ্ধান্ত হল রাতে খেজুর রস চুরি করে শিরনী পাকানো হবে। আতপ চাল,নারিকেল,দা, পাতিল সহ আনুষঙ্গিক দ্রব্যাদী কাচারী ঘরে মওজুদ করা হল। আমরা সরাসরি প্রাকট্রিক্যালে চলে যেতে চাইলাম। ‘রাত বাড়ুক, আরো পরে’ ইত্যাদি বলে গবি সময়ক্ষেপণ করছিল। অগত্যা রাত বাড়ার অপেক্ষায় আছি, এই ফাঁকে চলছে আমাদের থিওরী ক্লাস।
-বুঝলি, ছোট গাছের রস কখনো চুরি করবিনা, ছোট গাছের রস খাওয়া আর পিসাব খাওয়া সমান, কোন টেস্ট নাই, একদম ‘পাইন্সা’। গাছ যত বড় রস তত মিষ্টি!
এই পয়েন্টে এসে আমি হতাশ বোধ করলাম। আমি আবার গাছে উঠতে পারিনা। আশা ছিল ছোট গাছ দিয়ে কাজটা হাতে কলমে শিখে নেব। সে গুড়ে কাঁকর!
গবি বলেই যাচ্ছে - যত বেশি শিত পড়বে রস হবে বেশি মিষ্টি। আর খেয়াল রাখবি, যেন আগ কাটালির রস হয়। (গাছিরা অনবরত রস সংগ্রহের এক পর্যায়ে গাছকে দু;তিন দিনের ব্রেক দেয়, ব্রেকের পরে প্রথম দিনের রসকে আগ কাটালি বলে) এই রস একেবারে পরিস্কার থাকে। আমি খবর নিয়েছি আজ উত্তর পাড়ার ছোবান মিয়ার গাছে আগ কাটালি। চল এবার কাজে বেরিয়ে পড়া যাক!
শুন, তোরা এ লাইনে নতুন তাই সন্ধ্যার পর থেকে আমাকে তাগাদা দিচ্ছিলি। আমি ‘রাত বাড়ুক, আরো পরে’ বলে তোদের বুঝ দিচ্ছিলাম, কেন জানিস?
আমি বললাম- গেরস্থেরা যেন ঘুমিয়ে পড়ে এই জন্য।
গবি বলল- এক দেড় টাকা হাড়ির রস চুরি হলে গেরস্থরা তেমন গা করেনা, হাঁড়ি চুরি হলে কিছুটা হা হুতাশ করে বটে! তবে কারন সেটা নয়। রস পড়ার জন্য সময় দিতে হবেতো নাকি? এই কাজে যত বেশি রাতে যাবি তত বেশি রস পাবি।
তার বুদ্ধিতে শাগরেদরা মুগ্ধ হল।
কথায় কথায় কখন যে অপারেশন স্পটে চলে এসেছি খেয়াল নেই। গবির কথায় সম্বিৎ ফিরে পেলাম।
একটা বড় গাছ টার্গেট করে আমাকে বলল, এটাতে উঠ।
আমি বললাম- ভাই আপনি ভাল করেই জানেন আমি গাছে বুক না লাগিয়ে গাছে উঠতে পারিনা। খেজুর গাছে বুক লাগিয়ে উঠলে বুক চিরে যাবে।
গবি হতাশ, বলল- তুই তো বন্দুল চালানো না শিখে যুদ্ধে চলে এসেছিস! যাক তোকে পরে শিখিয়ে দেব।
এখন সেলিম উঠ।
সেলিম তর তর করে গাছে উঠে গেল। যথারীতি হাঁড়ি খুলে নিচের দিকে নামতেই বিপত্তিটা ঘটলো। গাছের সাথে বাড়ি খেয়ে হাঁড়ি চৌচির! সব রস পড়লো সেলিমের মাথায়। ভাঙ্গা হাঁড়ির বড় একটা পার্ট এসে পড়েছে গবির মাথায়। মাথা কেটে রক্তারক্তি অবস্থা। রিফিউজি লতা দিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসার পর রাগে গজরাতে গজরাতে গবি এই দুর্ঘটনার একটা ব্যাখ্যা দিল।
-বেয়াদ্দপ কোথাকার! তোরা জীবনেও কাজ শিখতে পারবিনা। সেলিমের বেয়াদ্দপির কারনেই আজকের এই বিপদ!
কাচুমাচু হয়ে সেলিম বলল – আমি আবার কি বেয়াদ্দপি করলাম?
-তুই কাজে নামার আগে ওস্তাদের পা ছুঁয়ে সালাম করেছিস?
দেখলাম অভিযোগ গুরুতর! সত্যিইতো সেতো আমাদের ওস্তাদই বটে ওস্তাদের চরণ ধুলি না নিয়ে 'বউনি করা'! এত বড় পাপ বিধাতা সইবে কেন?
পাপের কাটান দিতে জন্টু সহ আমরা তিনজনই গবির পায়ে হামলে পড়লাম। এখন আর এসবের দরকার নাই বলে গবি সরে গেল। পাপ কাটান দেয়া গেলনা।
ওস্তাদী ফলাতে গিয়ে এবার গবি নিজেই দ্রুত গতিতে পুকুরে হেলান দিয়ে থাকা একটা বড় গাছে উঠে পড়লো,এবং ততোধিক দ্রুত গতিতে গাছ থেকে পুকুরে পড়ে গেল।
ঘটনা বুঝতে আমাদের কিছু সময় লেগেছিল। প্রথমে ধারনা করেছিলাম হাত ফস্কে হাঁড়ি পড়ে গেছে। ততক্ষনে চাঁদ উঠে গেছে। আবছা আলোয় সাতরিয়ে কিনারে আসা দেখে বুঝলাম গবি নিজেই পড়ে গেছে। এদিকে ছোবান মিয়া ঘর থেকে চিৎকার করছে,’কেড়া? পুকুরে জাল মারে কেড়ারে?’
চার জন খেশারী খেতের মাঝ দিয়ে দিলাম দৌড়। কিছু দূর গিয়ে মনে পড়লো গাছ তলায় এলুমুনিয়ামের কলসি ফেলে এসছি। পেছন ফিরে দেখি সেটা শত্রু শিবিরের দখলে,ছোবান মিয়ার একহাতে হারিকেন এক হাতে কলসি।
দৌড় পর্ব শেষে এখন হাঁটা পর্ব চলছে। গবি শীতে কাঁপতে কাঁপতে তার পড়ে যাওয়ার কারণ যে খুবই যুক্তিযুক্ত তার বর্ননা দিচ্ছিল। তার মাথার উপর নাকি বিরাট এক ‘হানোক’ সাপ থাবা মেরেছিল। দুর্ঘটনা স্থল থেকে একটা বাদুর উড়ে যেতে দেখেছিলাম তাই আমার ধারণা রস খেতে থাকা বাদুর অনাহুত আগুন্তকের উপস্থিতি টের পেয়ে আচমকা উড়াল দিতে গিয়ে তার মাথায় বাড়ি খেয়েছিল।
কাচারী ঘরে এসে দেখি তেলেসমাতি কারবার ঘটে গেছে। সবাই অপারেশনে চলে গেছি, দুর্গ অরক্ষিত ছিল। এই সুযোগে কে যেন নারিকেল কোরানী আর লারকি গুলি রেখে বাকি সব মালামাল হাতিয়ে নিয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ৯:১৩