প্রবাসে বাংলাদেশের রক্তের উত্তরাধিকারী গুণীগন -পর্ব - ১৪৬
একজন বাংলাদেশী সাধককে সম্মানিত করার জন্য নিউইয়র্কের অভিজাত জ্যামাইকা অঞ্চলে একটি পথের নাম করণ করা হয়েছে শ্রীচিন্ময় স্ট্রিট।
নরওয়ের অসলোতে রয়েছে শ্রীচিন্ময়এর একটি পূর্ণাবয়ব মূর্তি ।
জাতিসংঘের সদর দপ্তরে রয়েছে তাঁর নামে স্থায়ী প্রার্থনাকক্ষ। পৃথিবীতে তাঁর অসংখ্য ভক্ত, অনুসারী।
পৃথিবীজুড়ে তিনি এক অধ্যাত্ম আন্দোলনের নেতৃত্বৃ দিয়েছেন। যিনি হার্ভার্ড, ইয়েল, কেমব্রিজ, অক্সফোর্ডের মতো শত শত বিশ্ববিদ্যালয় চষে বেড়িয়েছেন। কখনো নিউইয়র্কে, কখনো ওয়াশিংটনে অথবা লন্ডন, প্যারিস কিংবা স্টকহোমে চলে গেছেন। জাপান, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, সুইডেন এমনকি আফ্রিকার জাম্বিয়াতেও স্থাপন করেছেন মেডিটেশন সেন্টার।
সাইক্লিসট শ্রীচিন্ময়
ম্যারাথন দৌড়বিদ
চিন্ময়ের শৈশব কাটে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার শাকপুরায় । এখানেই ১৯৩১ সালের ২৭ আগস্ট তাঁর জন্ম । ৭ ভাই বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট ।
১৯৪৩ সালে পিতাকে হারান , তার কয়েক মাস পর ১৯৪৪ সালে মাও মারা যান । বড় দুই ভাই থাকতেন ভারতের পদুচেরির অরবিন্দ আশ্রমে। ১৯৪৪ সালেই ১২ বছরের মাতৃ পিতৃ হারা চিন্ময়কে ভাইয়েরা সাথে নিয়ে পদুচেরিতে আশ্রমের বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন ।
যৌবনে শ্রী চিন্ময়
লেখাপড়ার পাশাপাশি চলতে থাকল শরীরচর্চা, শিল্প ও সংগীতচর্চা। এই আশ্রমের জীবনে বালক চিন্ময়ের ভেতরে একধরনের পরিবর্তন হতে লাগল। বিদ্যালয়ের পাঠ্যবই পড়ার চেয়ে অন্য কোনো কিছু তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। পড়ার টেবিলে কাগজ-কলম নিয়ে বসেন। কিন্তু পাঠ্যসূচির কোনো কিছু চর্চা না করে খাতা ভরিয়ে ফেলেন গান লিখে। সেসব গানে থাকে প্রকৃতির কথা, মানুষের মনোবেদনার কথা। নতুন নতুন গান রচনার মোহ তাকে পেয়ে বসে। নতুন কিছু সৃষ্টির নেশায় তিনি বুঁদ হয়ে থাকেন।
নোবেল লরিয়েট ডেসমণ্ড টুটুর সাথে
সেই নিবিষ্টতা পরে ধীরে ধীরে আরও গভীরতা পেল। একসময় সেটি ধ্যানে পরিণত হলো। গভীর রাতে সবাই যখন ঘুমে মগ্ন তখন বালক চিন্ময় নতুন কথামালা সাজিয়ে গান লিখছে, নয়তো ধ্যানে মগ্ন থাকছে। ফলে প্রথাগত পড়ালেখা আর হলো না তার। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্তই। এরপর কখনো ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, কখনো ডিশ ধোয়ার কাজ, কখনো পেনসিল তৈরির কাজ, কখনো দপ্তরির কাজ করে দিন কাটে। যেই কাজই করুক না কেন চিন্ময়ের কলম থামেনি। থামেনি তাঁর ধ্যান।
মিখাইল গরভাচেভ এর সাথে
একসময় আশ্রমের সচিব নলিনীকান্ত গুপ্ত তাঁকে একান্ত সহকারী হিসেবে নিয়োগ দিলেন। নলিনীকান্ত নিজে লেখক ছিলেন। তাঁর লেখাগুলোকে গুছিয়ে রাখা, অনুবাদ এবং টাইপ করাই ছিল তাঁর প্রধান কাজ। এর মধ্যে ১৮টা বছর কেটে গেল।
প্রিন্সেস ডায়নার সাথে
পদুচেরি ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্র: ১৯৬২ সাল। সে সময় স্যাম স্প্যানিয়ার নামে একজন মার্কিন দার্শনিক পদুচেরি এলেন। চিন্ময়ের লেখালেখি, আচার-আচরণ তাঁর ভালো লাগল। তিনি একদিন চিন্ময়কে বললেন, ‘তুমি আমেরিকায় যেতে চাইলে আমি তোমার স্পনসর হব।’ এর আগে এক অধ্যাপকের মুখে শুনেছিলেন আমেরিকার গুণগান। তিনি বলেছিলেন সুযোগ পেলেই আমেরিকা যেতে। তখন মনের ভেতর একটা ইচ্ছা জন্ম নিয়েছিল। কিন্তু তা সুপ্ত ছিল। স্প্যানিয়ারের প্রস্তাবে সেটিই যেন জেগে উঠল।
জ্ঞানী জইল শিং
চেষ্টা তদবির চলতে লাগল। পাসপোর্ট, পি ফর্ম ইত্যাকার নানা কিছু তৈরি করতে লাগলেন। নানা বাধা পেরিয়ে ১৯৬৪ সালের ১৩ এপ্রিল চিন্ময় ঘোষ যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে পৌঁছালেন। তাঁর আশ্রয়দাতা সেই স্যাম স্প্যানিয়ার। স্পনসর পেয়ে বিদেশ যাওয়া হলো। কিন্তু বিদেশ–বিভুঁইয়ে বেশিদিন টিকে থাকা তো কঠিন ব্যাপার। গ্রিনকার্ড না পেলে সেখানে স্থায়ী থাকা যায় না।
নেলসন ম্যানডেলা
কী করা যায়? শুভাকাঙ্ক্ষীরা বুদ্ধি দিলেন, যে করেই হোক ইন্ডিয়ান কনস্যুলেটে ঢুকতে হবে, নইলে সে দেশে থাকা যাবে না। ইন্ডিয়ান কনসাল ছিলেন তখন মিস্টার মেরহোত্রা। তিনি চিন্ময়ের একটি ইংরেজি প্রবন্ধ পড়ে খুব খুশি। তিনি চিন্ময়কে চাকরি দিলেন। যৎসামান্য বেতনে ঘরভাড়া ও মাসিক খরচ চলে না। তবু চিন্ময় খেয়ে না খেয়ে চাকরি করতে লাগলেন। তাঁর লেখালেখি, গান রচনা কিন্তু থেমে নেই। আর গভীর রাতের সেই সাধনা আর আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান সমান্তরালভাবে চলতে লাগল।
মাদার তেরেসা
বিশ্ববিখ্যাত সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশঙ্করের সঙ্গে ছিল বিশেষ সখ্য।
২০০২ সালে নিউইয়র্কের একটি অনুষ্ঠানে দুই গুরুর আলিঙ্গন, যে আলো ছড়িয়ে গেল সবখানে।
একবার এক ইহুদি সিনেগগ ইন্ডিয়ান কনসাল জেনারেল এস কে রায়ের কাছে এসে বললেন, তাঁরা ধর্ম নিয়ে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেছেন। সেখানে পাঁচটি ধর্ম নিয়ে আলোচনা হবে। এস কে রায় নিজে সেই বক্তৃতা না দিয়ে চিন্ময়কে দায়িত্ব দিলেন। বক্তৃতার বিষয়: হিন্দুধর্ম ও ভারত আত্মার তীর্থযাত্রা। এটাই বিদেশে চিন্ময়ের প্রথম বক্তৃতা। সেই বক্তৃতা সেখানে বিদগ্ধজনের মধ্যে সাড়া ফেলে দেয়। এর পরের গল্প নতুন এক চিন্ময়কে পাওয়ার।
দীর্ঘদিনের সাধনা, ধ্যান, জ্ঞানচর্চায় নিজের গহিনে যে আলো জ্বলেছে তা সবখানে ছড়িয়ে গেল। প্রথম বক্তৃতা দেওয়ার জন্য যে চালক চিন্ময়কে অনুষ্ঠানস্থলে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর নাম ক্লাইভ ওয়েনম্যান। তিনি একজন ইহুদি। এই ওয়েনম্যানই বিদেশে চিন্ময়ের প্রথম শিষ্য বা অনুসারী। সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল চিন্ময়ের কথা। তাঁর বক্তব্য শুনতে আগ্রহী হতে লাগল মানুষ। অনেকে তাঁর সঙ্গে ধ্যানে যেতে আগ্রহ দেখালেন। এভাবে বাড়তে থাকল ভক্তের সংখ্যা। শুধু তা–ই নয়, যাঁরা তাঁর কাছে আসছেন তাঁদের অনেকেই নিজের নাম পরিবর্তন করে বাংলা নাম নিচ্ছেন। সে রকম একজন ভক্তের নাম রোজ। নতুন বাংলা নাম মুক্তি।
ভক্ত মুক্তি
মুক্তির সহায়তায় আমেরিকায় স্থায়ীভাবে থাকার গ্রিনকার্ড হলো তাঁর। সেটা ১৯৬৭ সালের কথা। সে বছর জুন মাসে ভারতীয় কনস্যুলেটের চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। তার পর থেকে লেগে যান নিজের অধ্যাত্ম সাধনায়। ২০০৭ সালের ১১ অক্টোবর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ পর্যন্ত সেই সাধনা অক্ষুণ্ন রেখেছেন। গান রচনা করেছেন দুই সহস্রধিক। অসংখ্য রচনা লিখেছেন হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, স্কটল্যান্ডের ডানডিসহ পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। এসব বক্তৃতার বিষয় এবং ভাষা শ্রোতাদের মধ্যে হইচই ফেলে দেয়। অনুরাগীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে লাগল। বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠতে লাগল চিন্ময় সেন্টার। তাঁর ভাষণ, চিন্তা লিখিতভাবে বা মুখে মুখে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে গেল। মরণের পরও বিশ্বব্যাপী এক অভূতপূর্ব স্বীকৃতি পেতে লাগলেন তিনি।
অধ্যাত্ম পুরুষ শ্রী চিন্ময় ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী । একাধারে তিনি চিত্রকর , সংগীত রচয়িতা , কবি , ম্যারাথন দৌড়বিদ ,
বংশী বাদক ,
বেহালা বাদক,
সাইক্লিস্ট , ভারোত্তুলক । ব্যক্তি জবনে পেয়েছেন বহু পদক ও সন্মাননা ।
১৯৯০ সালে এম্বাসেডর অফ ইউনিভার্সাল পিচ এ্যাওয়ার্ড ।
১৯৯৪ সালে মহাত্মা গান্ধী ইউনিভার্সাল হারমনি এ্যাওয়ার্ড ।
১৯৯৬ ফ্রেড লিবও এ্যাওয়ার্ড ।
১৯৯৮ পিল্গ্রিম অফ পিচ প্রাইজ ।
২০০১ সালে মাদার তেরেসা এ্যাওয়ার্ড ।
২০০৫ সালে অনারারী ডক্টরেট অফ হিউমিনিটিস ইন পিচ । (ক্যাম্বোডিয়া'স ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি)
নিজের কর্মে, সাধনায় বিশ্বব্যাপী এক বিশাল মনোরাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা , অভূতপূর্ব বিশ্বজয়ী শ্রী চিন্ময় ঘোষ ২০০৭ সালের ১১ই অক্টোবর , ৭৬ বছর বয়সে নিউইয়র্কে পরলোক গমন করেন ।
প্রবাসে বাংলাদেশের রক্তের উত্তরাধিকারী গুণীগন,পর্ব ১ হইতে ১৪৫ এখানে।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১২:২৯