ড. প্রফেসর অমিত চাকমা কানাডায় বাংলাদেশীদের কাছে একটি অহংকারের নাম। একটি গর্বের নাম। একটি অনুকরনীয় আদর্শের নাম। তিনি কানাডার ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি প্রেসিডেন্ট ও ভাইস চ্যান্সেলর। শুধু কানাডায় নয়, গোটা উত্তর আমেরিকার কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনিই প্রথম বাংলাদেশি উপাচার্য।
অমিত চাকমা কানাডায় গিয়েছিলেন উচ্চতর ডিগ্রি নিতে। তার আগে আলজেরিয়ার বিখ্যাত আলজেরিয়ান পেট্রোলিয়াম ইনস্টিটিউট থেকে ‘রাসায়নিক প্রকৌশল’ বিষয়ে প্রথম স্থান অধিকার করে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৮২ সালে। এরপরই কানাডায় চলে আসেন মাস্টার্স ও পিএইচডি করার জন্য । কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়া থেকে রাসায়নিক প্রকৌশল বিষয়ে পড়াশোনা শেষে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
শৈশবে অমিত চাকমা কিন্তু লেখাপড়ার প্রতি তেমন মনোযোগী ছিলেন না। তিনি পড়তেন রাঙ্গামাটি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে। অভিবাবক ও স্কুলের শিক্ষকরা তাকে নিয়ে মোটামুটি হতাশই ছিলেন। তিনি মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারবেন কি না সেটাই ছিল সবার আশংকা। কিন্তু সকলের আশংকাকে উড়িয়ে দিয়ে তিনি মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উর্ত্তীর্ণ হন। পরে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন ঢাকা কলেজ থেকে।
তখন জ্বালানি তেলের ওপর উচ্চশিক্ষা নিতে বৃত্তি দিচ্ছিল আলজেরিয়া সরকার। ১৯৭৭ সালে আলজেরিয়ান পেট্রোলিয়াম ইনস্টিটিউটের বৃত্তি নিয়ে সে দেশে চলে যান অমিত। আলজেরিয়ার বিখ্যাত আলজেরিয়ান পেট্রোলিয়াম ইনস্টিটিউট থেকে ‘রাসায়নিক প্রকৌশল’ বিষয়ে প্রথম স্থান অধিকার করে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৮২ সালে। এরপরই কানাডায় চলে আসেন মাস্টার্স ও পিএইচডি করার জন্য। কানাডার অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়া থেকে রাসায়নিক প্রকৌশল বিষয়ে পড়াশোনা শেষে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন ।
অবদান ও স্বীকৃতি -
শিক্ষা খাতে ও তাঁর নিজের গবেষণা ক্ষেত্রে নানা অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন একাধিক পুরষ্কার। ৪০ বছরের কম বয়সী যাঁরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তাঁদের বিশেষ পুরস্কার দেওয়া হয় কানাডায়। ১৯৯৮ সালে সেই পুরস্কারটি পেয়ে যান অমিত চাকমা। কানাডা সরকার তাঁকে ৪০-এর নিচে সেরা ৪০ বা ‘টপ ৪০ আন্ডার ৪০ অ্যাওয়ার্ডে’ ভূষিত করে। অমিত চাকমা কানাডার সর্ববৃহৎ ব্যাংক রয়েল ব্যাংক অব কানাডার ‘টপ ২৫ কানাডিয়ান ইমিগ্রেন্ট’পুরষ্কারে ভূষিত হন।
অমিত চাকমার গবেষণার মূল বিষয় প্রাকৃতিক গ্যাস প্রকৌশল এবং পেট্রোলিয়াম বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। তিনি পেট্রোলিয়াম রিসার্চ এবং এনার্জি ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে খ্যাতনামা একজন বিশেষজ্ঞ। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জার্নালে তাঁর শতাধিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া গ্যাস পৃৃথকীকরণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, জ্বালানি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, গ্রিন হাউস গ্যাস নিয়ন্ত্রণ কৌশল, এনার্জি ও পরিবেশ সিস্টেম মডেলিং গবেষণায় অন্যতম আগ্রহের বিষয়।
১৯৮৮ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ইউনিভার্সিটি অব ক্যালগেরির রাসায়নিক প্রকৌশল বিভাগে অধ্যাপনা করেন। এরপর ইউনিভার্সিটি অব রিজাইনাতে রাসায়নিক প্রকৌশল বিভাগের প্রধান নিযুক্ত হন। ১৯৯৯ থেকে ২০০১ পর্যন্ত ইউনিভারসিটি অব রিজাইনার ভাইস প্রেসিডেন্ট রিসার্চ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ২০০১ সালে ইউনিভার্সিটি অব ওয়াটার লু’র একাডেমিক ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং প্রভোস্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
২০০৮ সালে তিনি কানাডিয়ান একাডেমী অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ফেলো পদে ভূষিত হন। বর্তমানে তিনি ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব কানাডার সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি অন্টারিও সেন্টার অব এক্সিলেন্সের বোর্ড অব ডিরেক্টরসের একজন সদস্য । কানাডার সায়েন্স, টেকনোলজি অ্যান্ড ইনোভেশন কাউন্সিলের সদস্যও তিনি। একই সঙ্গে কানাডার ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন স্ট্যাটেজি-বিষয়ক উপদেষ্টা প্যানেল কমিটির সভাপতির দায়িত্বও পালন করছেন। কানাডায় উচ্চশিক্ষায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১২ সালে পেয়েছেন কুইন্স ডায়মন্ড জুবিলি মেডেল।
নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং চীনের হুনান, পিকিং ও হুয়াজং বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে ডাক পড়ে তাঁর। ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য দিতে যান নিয়মিত। কাজ করছেন কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের প্রায় দেড় শ বিজ্ঞান এবং জ্বালানিবিষয়ক গবেষণা সংস্থা ও সংগঠনের পরিচালনা পর্ষদ ও উপদেষ্টা হিসেবে।
এত সব প্রতিষ্ঠান বাদে শুধু ওয়েস্টার্ন ইউনিভারসিটি থেকেই তিনি সন্মানি পান অর্ধ মিলিয়ন ডলার ।
এত সাফল্যের পরও অমিত চাকমা কিন্তু দেশকে ভুলে যাননি। ফেলে আসা দেশ, আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব এদের জন্য এখনো তার মন কাঁদে। এখনো দেশের কথা মনে করে কখনো কখনো ইমোশনাল হয়ে যান , তখন দেশের গান শুনে সান্ত্বনা পান ।
দেশকে তিনি যে ভুলে যাননি তার আরেকটি প্রমাণ- চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব উইমেন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া । সময় সুযোগ পেলেই তিনি ছুটে আসেন জন্মভূমি বাংলা দেশে।
অমিত চাকমার বাবা প্রভাত কুমার চাকমা ছিলেন সার্কেল অফিসার। তিনি মৃত্যুবরণ করেন ১৯৮৭ সালে। অমিত চাকমারা তিন ভাই ও এক বোন। সবার বড় অমিত চাকমা। ছোট দুই ভাইয়ের একজন অরুনাভ চাকমা। থাকেন আমেরিকায়। একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। আরেক ভাই স্মরণাভ চাকমা থাকেন টরন্টোতে। স্থানীয় একটি ফর্মাসিউসিটিক্যাল কোম্পানীর কর্মকর্তা । একমাত্র বোন হ্যাপি চাকমা ১৯৮৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে ক্যান্সারে মারা যান।
অমিত চাকমা বিয়ে করেন ১৯৮৭ সালে। স্ত্রী মীনা চাকমা। অমিত ও মীনা দম্পত্তির বড় ছেলে ক্যালিফোর্নিয়ায় চাকরী করেন। ছোটটি এখনো ছাত্র।
প্রবাসে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করা এই গুণী মানুষটির জন্য শুভ কামনা ।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুলাই, ২০১৫ সকাল ১১:৪৭