সাত দশকেরও আগের কথা | আমিন সাহেব পিতামাতার একমাত্র ছেলে | তাঁর বাবার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তেমন ছিলো না; তবে, প্রকৃতি এবং পরিবেশ থেকে শিখেছেন বিস্তর | স্বশিক্ষিত মানুষের এক উজ্বল দৃষ্টান্ত তিনি | নির্লোভ, নির্মোহ চিন্তাশীল এক মানুষ |
আমিন সাহেবের এক চাচা ছিলেন | এ চাচার দু'ছেলে | তাঁরা দু'জন আর আমিন সাহেব কেবল চাচাতো-জেঠাতো ভাইই নয়, বন্ধুও ছিলেন একে অন্যের | তখন ষষ্ঠ কি সপ্তম শ্রেণীতে পড়তেন তাঁরা | স্বভাবতই:, নিয়মিত স্কুলে যেতে মন চাইতো না তিন কিশোরের | চাচাতো ভাইরা পরস্পর শলাপরামর্শ করে স্কুলে না যাবার এক বুদ্ধি খুঁজে বের করলেন | আমিন সাহেবের সাথে তাঁদের এ অসাধারণ বুদ্ধি শেয়ার করতেই তিনি তাতে রাজি হয়ে গেলেন | পরিকল্পনামতো শুরু হলো কাজ |
পরদিন স্কুলে যাবার সময় হলে তাঁরা তিনজনই বাড়ি ছেড়ে যান | চাচাতো ভাইদের দুজন পুকুর পাড়ের লম্বামতো দুটো গাছের রীতিমতো মগডালে চড়ে বসেছেন, আর ওদিকে, আমিন সাহেব একটা খালি কলসি নিয়ে দিঘীসদৃশ পুকুরের নাভিমূলে অবস্থান নেন | আমিন সাহেব গাছে চড়তে জানতেন না বলেই তাঁর পুকুরের গভীর জলে নামা | এসবই তাঁদের আগের দিনের পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়ন |
এদিকে স্কুলে যাবার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে দেখে চাচা এসে তাঁর দুছেলেকে গাছ থেকে নেমে স্কুলে যাবার তাগাদা দিতেই তারা হুমকি দিতে শুরু করলেন এ বলে, আমরা আর স্কুলে যাবো না, যেতে বললে গাছ থেকে লাফ দিয়ে মাটিতে পড়ে প্রাণ দেবো ..
জন্মদাতা পিতার মন বলে কথা | জোড় হাতে মাফ চাইলেন ছেলেদের কাছে এ প্রতিজ্ঞা করে, জীবনে আর কোনোদিনও তাঁদের স্কুলে যেতে বলবেন না | আশ্বাস পেয়ে দু'ভাই ধীরে ধীরে গাছ থেকে মাটিতে নেমে পড়লেন | বাঁধভাঙ্গা স্নেহ-ভালোবাসায় পিতৃহৃদয় ক্ষত-বিক্ষত হলো; পরস্পর জড়িয়ে ধরে মনখুলে কাঁদলেন তাঁরা তিনজন | স্কুলে যাবার বিড়ম্বনা কেটেছে দুজনের; সারাজীবনের জন্য |
আর ওদিকে, আমিন সাহেবের জন্মদাতা পিতা ইস্পাতদৃঢ় কণ্ঠে চিৎকার করে তাঁর ছেলেকে স্কুলে যেতে শাসিয়ে চলেছেন | আমিন সাহেব গলায় কলসি বেঁধে পানিতে ডুবে মরার হুমকি দিতেই তাঁর পিতা কাছে থাকা লম্বা এক বাঁশ হাতে নিয়ে তাঁর দিকে তাক করে বললেন, আমিন, তোমার সামনে কেবল দুটি পথ খোলা: হয় স্কুলে যাবে; না হয় পানিতে ডুবে মরবে, তৃতীয় কোনো পথ খোলা নেই | আর এ সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমি এক থেকে বিশ পর্যন্ত গণনা শেষ করার আগেই | তা না হলে আমি এখান থেকে এ বাঁশ নিক্ষেপ করে তোমাকে মেরে বাকি জীবন জেলে কাটাবো ..
এরই মাঝে আমিন সাহেবের চাচাসহ অন্য মুরুব্বিরা এগিয়ে এসে তাঁর বাবাকে ছেলের স্কুলে যাওয়া নিয়ে এমন কঠোর অবস্থান থেকে সরে আসার জন্য অনুরোধ জানাতে লাগলেন | তিনি তাঁদের কথা মানলেন না; বরং, তাঁদের উদ্দেশ্য করে বললেন, "আমার তো এ একমাত্র ছেলে, মানুষের মতো মানুষ হয়ে গড়ে না উঠলে তাঁর বরং এ কম বয়সেই পৃথিবী থেকে চলে যাওয়া উত্তম মনে করি আমি | তোমরা আমাকে বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করো না |" কথাগুলো বলতে বলতে তিনি ছেলের দিকে লম্বা বাঁশটি আবারো তাক করে গুনতে শুরু করলেন, এক, দুই, তিন .. | অবাক বিস্ময়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছেন উপস্থিত সবাই |
সম্ভবত: দশ পর্যন্ত তাঁকে গুনতে হয়েছিলো | এরই মাঝে আমিন সাহেব কলসি ছেড়ে মাঝপুকুর থেকে সাঁতরিয়ে কিনারায় চলে আসলেন দ্রুত, তড়িঘড়ি করে চলে গেলেন স্কুলে, যাতে বেশি দেরি না হয় | সেই থেকে আর কোনোদিনও স্কুল কামাই করেননি তিনি |
এই আমিন সাহেব তাঁর আশপাশের কয়েকটি গ্রামে সে আমলের প্রথম এট্রান্স (আজকের দিনের এসএসসি) পাশ | তখনকার দিনে মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা ছিলো হাতেগোনা | জাতীয় অধ্যাপক মরহুম ডাক্তার নুরুল ইসলামও তাঁকে মুরুব্বি মানতেন | এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাশের জন্য বিশেষ সম্মানস্বরূপ গ্রামবাসী আমিন সাহেবকে ঘোড়ায় চড়িয়েছিলেন; আজকাল ডবল, বা ট্রিপল পিএইচডি করলেও যা আশা করা যায় না |
এই যে প্রায় শতবছর আগের সীমাহীন গোঁয়ার, একরোখা, অসাধারণ শিক্ষানুরাগী মানুষটি, তাঁর নাম ছিলো বাচা মিয়া | তিনি এ নগণ্যের পরম শ্রদ্ধেয় পিতামহ |
ML Gani @ facebook
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ৮:৩১