সকলের সুবিধার্থেঃ-
দেবীতত্ত্বের বৈদিক ভিত্তি দেবীসূক্ত এবং রাত্রি সূক্ত। দেবীসুক্তের দেবতা বাক্।অম্ভৃণ ঋষির কন্যা বাক্ নাম্নী কন্যার মুখে তিনি অচিন্তনীয় মহিমা এবং অপরিসীম শক্তি ও নীলার কথা ব্যক্ত করেছেন। তিনি সর্বাত্মিকা,সর্বশক্তি সমন্বিতা, সর্বব্যাপিনী এবং সর্বস্রষ্টি। তিনিই একাদশ রুদ্ররুপে বিচরণ করেন, তিনিই সমুদয় বসুগণকে এবং বিষ্ণু প্রভৃতি দ্বাদশ অদিত্যকে ধারণ করেন।
মার্কণ্ডেয় পুরাণোক্ত শ্রী শ্রী চণ্ডীতে দেবীর স্বমুখে উক্তি " একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়া কা মমাপরা"। এ জগতে একা আমিই আছি আমা ভিন্ন অতিরিক্ত কে আছে? পুরুষাবতারের ক্রিয়াশক্তিই এই দেবী দুর্গা।
বিজ্ঞানও বলে এক শক্তি বিভিন্নরুপে বিরাজিত। এই অদ্বৈত তত্ত্বই বেদ,পুরণ ও তন্ত্রোক্ত দেবী তত্ত্বের মূল প্রতিপাদ্য।
লক্ষী, সরস্বতী,জগদ্ধাত্রী,উমা পার্বতী,ভারতী,অম্বিকা,কালী,চণ্ডী,মাহেশ্বরী,বারাহী,কৌমারী,ভগবতী,গৌরী,ব্রহ্মাণী,কাত্যায়নী চামুণ্ডা প্রভৃতি নামে যে সকল দেবীর পূজা ও উপাসনা করা হয় তা সেই মহাদেবীরই ভিন্ন ভিন্ন রুপ ও নাম মাত্র। কালী, তারা,ষোড়শী,ভুবনেশ্বরী,ভৈরবী,ছিন্নমস্তা,ধূমাবতী,বগলা,মাতঙ্গী,কমলা-এই মহাদেবীরই দশটি রুপ।
শ্রী শ্রী চণ্ডীতে দেবীর তিনটি রুপ কল্পনা করা হয়েছে।। তমোগুণময়ী মহা কালী,রজোগুণময়ী মহালক্ষী এবং সত্ত্বগুণময়ী মহাসরস্বতী। মনসা,শীতলা,ষষ্ঠী,গন্ধেশ্বরী,সুবচণী,অন্নপূর্ণাদিও এই মহাশক্তিরই অংশভূতা। শক্তিবাদ এই দেবী দুর্গাকেই কেন্দ্র করে অঙ্কুরিত, পরিবর্ধিত ও পূর্ণতাপ্রাপ্ত।
৫১(একান্ন) শক্তিপীঠ:
শিব ভ্রমণ করতে লাগলেন। এদিকে শিবের শোকবিহ্বলতায় প্রলয় কাজে বিঘ্ন দেখা দিল। তখন শ্রী বিষ্ণু শিবের অগোচরে কাঁধোপরি সতীর দেহ খণ্ড খণ্ড করে ফেলতে লাগলেন।তাতেই সৃষ্টি হয় একান্ন শক্তি পীঠ। এগুলোর সবগুলো ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশ,ভারত,পাকিস্তান,নেপাল ও শ্রীলঙ্কায়। মহাশক্তি স্বরুপা জগজ্জননী এক ও অদ্বিতীয় হয়েও বহুরুপে বহু নামে শক্তির আধার রুপে বিভিন্ন দেশে অবস্থিত আছেন। সমগ্র উপমাহদেশই শক্তি তীর্থে, শক্তি সাধনায় মহাপীঠে পরিণত হয়েছে। শিব ও শক্তি অভিন্ন। তাই ৫১ টি মহাপীঠে দেবীর সাথে শিব ভৈরবরুপে অবস্থান করছেন।
দুর্গা নামের ব্যূৎপত্তি:
দৈত্যনাশার্থো বচনো দ-কার:পরিকীর্ত্তিত:।
উ-কারো বিঘ্ননাশস্য বাচকো বেদসম্মত:।।
রেফো রোগঘ্ন বচনো গশ্চ পাপঘ্নবাচক:।
ভয়শত্রুঘ্নবচনোশ্চাকার: পরিকীর্তিত:।। ---শব্দকল্পদ্রম।
"দ" অক্ষরটি দৈত্যনাশক,উকার বিঘ্ননাশক,রেফ রোগঘ্ন, গ অক্ষর পাপঘ্ন, আকার ভয় শত্রুঘ্ন। দৈত্য,বিঘ্ন,রোগ,পাপ, এবং ভয় ও শত্রু হতে যিনি রক্ষা করেন তিনিই দুর্গা।
দেবী দুর্গার প্রনাম মন্ত্র:
সর্ব মঙ্গলমঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থ সাধিকে।
শরণ্যে ত্রাম্বকে গৌরী নারায়ণী নমোহস্তুতে।।
ধ্যানাশ্রিত মূর্তি:
দেবী দুর্গা: কেশরাজি সমাযুক্তা, অর্ধেন্দুকৃত শেখরা এবং ত্রিনয়না।
তাঁর বদন পূর্ণ চন্দ্রের ন্যায় সুন্দর,বর্ণ অতসী ফুলের মত হরিদ্রাভ। তিনি ত্রিলোকে সুপ্রতিষ্ঠাতা,নবযৌবন সম্পন্না,সর্বাভরণ-ভূষিতা,সুচারু-দশনা,পীনোন্নত-পয়োধরা। তাঁর বামজানু কটি ও গ্রীবা এই স্থানত্রয় একটু বঙ্কিমভাবে স্থাপিত। তিনি মহিষাসুর মর্দিনী এবং মৃনালের ন্যায় দশবাহু সমন্বিত।
তাঁর দক্ষিণ পঞ্চকরে উর্ধ্ব-অধ:ক্রমে ত্রিশূল,খড়গ,চক্র,তীক্ষ্ণবাণ ও শক্তি এবং বাম করে ঐরুপক্রমে খেটক ধেনু,পাশ,অঙ্কুশ,ঘন্টা, পরশু শোভিত।দেবীর পদতলে ছিন্ন-স্কন্ধ মহিষ। উক্ত মহিষ থেকে উদ্ভূত এক খড়গপাণি দানব। দেবীর নিক্ষিপ্ত শূল ঐ দৈত্যর হৃদয় বিদীর্ণ করেছে। তাতে দৈত্যর দেহ রুধিরাক্ত,চক্ষু রোষ কষায়িত। দেবী নাগপাশযুক্ত,তাতে দৈত্যের কেশ আকর্ষণ করে আছেন।তাতে দৈত্যের রুধির বমন ও দ্রুকুটিতে ভীষণ দর্শণ হয়েছে। দেবীর দক্ষিণপদ সিংহোপরি এবং বামপদ দৈত্যের কাঁধে অবস্থিত। দেবী অষ্টশক্তি যথা উগ্রচণ্ডা,প্রচণ্ডা,চণ্ডোগ্রা,চণ্ড নায়িকা,চণ্ডা,চণ্ডাবতী,চণ্ডরুপা ও অতিচণ্ডিকা পরিবেষ্টিতা। দেবী ধর্ম, অর্থ,কাম ও মোক্ষ এই চতুর্বর্গ ফলদাত্রী এবং জগদ্ধাত্রী।
দেবীপূজার দুটি ধারা:
একদিকে তিনি অতি সৌম্যা মাতৃরুপা স্নেহ বাৎসল্যে জগত পালন করেন। আশ্রিত, ভক্ত, সাধক, সন্তানকে দান করেন ভয় ও অভয়। ভীষণা মূতি হয়ে তঁার সংহার নীলা-আসুরিক শক্তির বিরুদ্ধে কালান্তক অভিযান। দেবী পূজার ফলও দ্বিবিধ-ভক্তি ও মুক্তি। রাজা সুরথ,রামচন্দ্র, অর্জুন,শিবাজী রাণা প্রতাপ, গোবিন্দ সিং প্রমুখ অভ্যূদয়কামী রাজণ্যবর্গ ও স্বদেশপ্রেমী সাধকগণ দেবীর ভীষণা মূর্তির সাধনা করেন- বীর্য,ঐশ্বর্য,রাজ্য, শত্রুবধ, বিজয়, স্বাধীনতা লাভ করেছেন। অপর দিকে সমাধি বৈশ্য, রামপ্রসাদ, কমলা কান্ত, বামাক্ষ্যাপা,রামকৃষ্ণ প্রমূখ ভাব সাধকগণ দেবীর করুণাময়ী, দয়াময়ী, সৌম্যামূর্তির সাধনা, উপাসনা করে লাভ করেছেন প্রেম ভক্তি, জ্ঞান, বৈরাগ্য-মহামুক্তি। রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য পূজা করেছিলেন উত্তরায়ণে বসন্তকালে। উত্তরায়নই দেবদেবীর পূজার প্রকৃষ্ট সময়। দু’জনই দেবী পূজায় স্ব স্ব অভীষ্ট ফল লাভ করেছিলেন। রাজা সুরথ রাজ্য ফিরে পেয়েছিলেন আর সমাধি বৈশ্য পেয়েছিলেন মহামুক্তি।
দেবীর কল্পারম্ভ অর্থ সঙ্কল্প। সঙ্কল্প অর্থ দেবী বা দেব পূজার উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্যই মানুষকে দেব বা দেবীপূজায় নিয়োজিত করে। সংকল্প যেখানে স্থির, গভীর একাগ্র, শ্রদ্ধযুক্ত পূজা সেখানেই সার্থকতা মণ্ডিত। সকল দেবদেবী পূজাতেই সংকল্প আছে। কিন্ত দুর্গা পূজার সঙ্কল্প একটু বৈশিষ্টপূর্ণ। দুর্গা পূজার সঙ্কল্প সাত প্রকার। কৃষ্ণানবমী, প্রতিপদ,যষ্ঠী,সপ্তমী,অষ্টমী বা নবমীতেও সংকল্প করে পূজা করতে পারেন। কল্পারম্ভ বা সংকল্প করা মানে চণ্ডীর ঘটস্থাপণ করে যথাশক্তি পূজা।
বোধন অর্থে দেবীকে জাগ্রত করে আহ্ববান করা। পৃথিবীর এক বছর(ছয় মাস দিন ও ছয় মাস রাত্রি) দেবগণের একদিন।অর্থাৎ পৃথিবীর এক বছর দেবগণের একদিন। শ্রাবণ থেকে পৌষ দেবগণের রাত্রি এবং মাঘ থেকে আষাঢ় দেবগণের দিন। শ্রী হরির শয়ণ থেকে উত্থান পর্যন্ত রাত্রি। তাই শ্রাবণ থেকে পৌষ দেবদেবীর পূজায় বোধণ অপরিহার্য। শারদীয় দুর্গোৎসব দেবদেবিগণের রাত্রি বিধায় বোধন করতে হয়। এ সময়টাকে দক্ষিনায়ন বা পিতৃপক্ষও বলে। তাই দেবীর আবাহনের পূর্বে পিতৃপক্ষ অনুযায়ী তর্পণাদির ব্যবস্থা আছে। অনুষ্ঠানের নাম “মহালয়া পার্বণ শ্রাদ্ধম”।
দেবীপূজা জাতি গঠনের প্রেরণা। সংহতিই জাতি গঠন বা রাষ্ট্র গঠনের মূল ভিত্তি। এই সংহতিকে জাতির কল্যাণে সার্থক প্রয়োগেই রাষ্ট্র নির্মাণ পূণাঙ্গ হয়। বৈদিক সূক্তে দেবী নিজেই বলেছেন ‘অহং রাষ্ট্রী’। আমি এই বিশ্ব রাজ্যের অধীশ্বরী। দেবী প্রতিমায় আমরা যে পূজা করি তার দিকে দৃষ্টি দিলে এই রাষ্ট্র পরিকল্পনার নিখুঁত দিকটি কি প্রকাশিত হয় না? প্রত্যেক রাষ্ট্রে চারটি শ্রেণীর মানুষ দেখা যায়। বুদ্ধিজীবী, বীর্যজীবী,বৃত্তিজীবী, ও শ্রমজীবী। এ চার শক্তির পূর্ণ অভিব্যক্তি ও পরস্পরের সাহচর্য যেখানে অবিঘ্নিত সে জাতি বা রাষ্ট্র অপ্রতিহত গতিতে তার লক্ষ্যপথে এগিয়ে যেতে সর্মথ। পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্র ভাবনা থেকেই এ দেশে সৃষ্টি হয়েছিল ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয়,বৈশ্য ও শূদ্র চার বর্ণ বিভাগ। এ বিভাগ ভেদ-বুদ্ধি প্রণোদিত নয়।
দেবীর দক্ষিণে লক্ষী ও গণেশ বামে সরস্বতী ও কার্তিকেয়। লক্ষী ধনশক্তি বা বৈশ্য শক্তি। গণেশ জনশক্তি,শূদ্রশক্তি বা শ্রমশক্তি। সবস্বতী জ্ঞানশক্তি বা ব্রহ্মণ্যশক্তি এবং দেব সেনাপতি কার্তিকেয় ক্ষাত্রশক্তির দেবতা।
দেবী দুর্গা যখন আমাদের মধ্যে অবতীর্ণ হোন তখন তিনি একা আসেন না। পুত্রকন্যা স্বরুপ চার শক্তিকে নিয়েই আসেন। দেবীর প্রতিমা দর্শনে লব্ধ জ্ঞানই রাষ্ট্রীয় জ্ঞান বা রাষ্ট্রীয় বিজ্ঞান। বস্তুত দুর্গা প্রতিমাই জাতীয় প্রতিমা। দেবী পূজায় সমাজের সকল স্তরের লোকই প্রয়োজন। হাত কর্মের প্রতীক। আলস্য, নিদ্রা,তন্দ্রা,জড়তা,নিবীর্যতার মহাপাপ দূরীভূত করে জাতির মধ্যে সর্বত:প্রসারি কর্মশক্তি জাগিয়ে তোলার জন্যই তিনি দশভূজা। দশে মিলে কাজ করার, কল্যাণ করার, সুন্দর সমাজ গড়ার কাজ নিয়েছেন বলেই তিনি দশভূজা। জাতির সকল প্রকার অশুভ বিনাশ করার জন্যই তিনি দশ প্রহরণধারিণী।
পশুরাজ সিংহ কেন দেবীর বাহন?
কালিকা পুরাণ মতে শ্রী হরি দেবিকে বহন করছেন। হরি শব্দের এক অর্থ সিংহ। শ্রী শ্রী চণ্ডীতে উল্লেখ আছে গিরিরাজ হিমালয় দেবীকে সিংহ দান করেন। শিবপুরান বলেন ব্রহ্মা দুর্গাকে বাহনরুপে সিংহ দান করেছেন শুম্ভ ও নিশুম্ভ বধের সুবিধার্থে। দেবীর বাহ্য লক্ষণের সাথে সিংহের লক্ষণগুলো মিলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে দেবীর বাহন রুপে সিংহ কেন? দেবী নিখিল বিশ্বে রাষ্ট্রী বা সম্রাজ্ঞী। সিংহ পশু রাজ্যের সম্রাট। দেবী অস্ত্রধারিণী, সিংহও দন্ত-নখরধারী। দেবী জটাজুট সমাযুক্ত, সিংহ কেশরী। দেবী মহিষাসুর মর্দিনী, সিংহ মহিষের সাথে যুদ্ধ বিজয়ী। সিংহর থাবায় এমন শক্তি যে এক থাবায় মহিষের খুলি মস্তক থেকে ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। সিংহ একটি মহাবীর্যবান পশু।
আধ্যাত্বিকতার দিক থেকেও বিচার করা যেতে পারে। অসীম শক্তি শালী সিংহের কাছে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে আত্মসর্মপণের। দেবীর পদতলে নিত্য শরনাগত। জীব মাত্রই পশু। পশু চায় পশুত্ব থেকে মুক্তি,চায় দেবত্বে উন্নীত হতে। তাই মাতৃচরণে ঐকান্তিক শরণাগতি। সিংহ পশু শ্রেষ্ঠ হয়েও দেবশক্তির আধার হয়েছেন শুধু দেবির শরণাগতির প্রভাবেই। অপরদিকে দেবীর লক্ষ্য লোক কল্যাণ। সত্ত্বগুণময়ী মা রজোগুণোময়ী সিংহকে বাহন নিয়ন্ত্রন করে লোকস্থিতি রক্ষা করছেন। রজোগুণের সংঙ্গে তমোগুণের সমন্বয় ঘটলে লোককল্যাণ না হয়ে হবে লোকসংহার। তাতে আসুরিকতা ও পাশবিকতার জয় হবে। এই পাশবিকতা ও আসুরিকতার সংহার করে, উচ্ছেদ করে লোকস্থিতি ও সমাজ কল্যাণকর কাজ সমাধা করতে চাই রজোগুণাত্বক শক্তির সাধনা। তাই দেবি সত্ত্বগুণময়ী হয়ে রজোগুণাত্মক সিংহকে করেছেন বাহন, অর্থাৎ অনুগত আজ্ঞাবহ ভৃত্য।
লিংক
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০১১ রাত ৯:১৫