ছবি -- চলছে মুড়ি ভাজা ।
আমি অর্থনীতির বিশ্লেষক নই । আপনিও নন সম্ভবত । তবুও দেশ ও দশের অর্থনৈতিক হালচাল নিয়ে কিছুটা মাথা ঘামাই আমরা সময়ে – অসময়ে । পথ চলতে চলতে , প্রতিদিনের অনেক নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষ কিনতে গিয়ে , ক্ষনকালের অর্থনীতিবিদ হয়ে পড়ি । এই জিনিষটির দাম কেন বেশী, ওইটা কেন এতো সস্তা ! এই এই কম্পানীগুলো সাধারন মানুষের গলা কাটছে , এমনটা ও ভাবি । সুপারমলে প্যাকেটজাত জিনিষ দেখে বলে উঠি – “ বাহ্ বেশতো , ঝালমুড়ি ও পাওয়া যাচ্ছে প্যাকেটে !”
খুশি হই, সব তুচ্ছ তুচ্ছ অথচ অতি প্রয়োজনীয় জিনিষগুলি হাতের কাছেই আলাদা আদলে পেয়ে । রঙে ঢংয়ে আমরা ক্রেতা সাধারন “এগিয়ে যাচ্ছে দেশ ” এমনটা ভেবে উৎফুল্ল হই । কিন্তু আলোর প্রদীপের নীচেই যে অন্ধকার ক্রমাগত জমাট বাঁধে তা কি মনে থাকে আমাদের ?
এই যে অতি তুচ্ছ জিনিস যেমন হলুদ - মরিচ - ধনে সহ যাবতীয় মসলার গুড়ো, তেজপাতা, মুড়ি, ঝালমুড়ি, চিড়া-মুড়ির মোয়া, চিড়া ভাজা, বাদাম ভাজা, চানাচুর , ঘোল-দধি, সরষের তেল, ইত্যাদি হরেক রকমের নিত্য প্রয়োজনীয় ও ভোগ্যপণ্যের জন্যে আজকাল আর আপনাকে পথের দিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছেনা । অথচ একসময় এগুলো বানিয়ে বিক্রী করে জীবিকা নির্বাহ করতো লাখো পরিবার । এরা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী । বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীগুলোর কাছে প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়েছে তারা । ভাতে – কাপড়ে সমূলে মরে যাচ্ছে এরা । দেশের কর্মবাজারে এদের কর্ম সংস্থান এখন নিঃশেষ হয়ে গেছে । এদের আর চাহিদা নেই । এদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে আপনার জীবনে ।
কোথায় গেছে ঐ লাখো পরিবারের রুজি-রোজগারের রাস্তাটি ? ওরা তাহলে কোথায় গেছে ?
আমার জানা নেই , জানা নেই আপনারও । কোনও পরিসংখ্যানও নেই সম্ভবত ।
দেশে নতুন কোনও কর্ম সংস্থানের সুযোগ না থাকায় এবং কর্ম সৃষ্টি না হওয়ায় ধরে নিতেই হয় ঐসব পরিবার ঝরে গেছে বাপ-দাদার পেশা থেকে । নতুন পেশায় যাবার মতো কারিগরি দক্ষতা আর পুঁজি ওদের নেই বলে ওরা নব্য শিল্পগোষ্ঠীর মুড়ি ভাজা থেকে শুরু করে হলুদ-মরিচের গুড়োর ঝাঁজে চোখে সর্ষেফুল দেখছে । ওদের জন্যে কোন রকমের কর্মের সুযোগ না থাকায় পেশা গুটিয়ে হয় ওরা চুরি-ডাকাতি-রাহাজানিতে নেমে পড়ছে নতুবা ঢাকা মহানগরে এসে বস্তিবাসীর সংখ্যা বাড়িয়ে রিক্সাওয়ালাতে পরিনত হচ্ছে ।
জানিনা, এরকম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রান্তিক পেশাজীবিদের পেশা টিকিয়ে রাখতে রাষ্ট্রীয় কোন “নিরাপত্তা”র অঙ্গীকার আছে কিনা । আমাদের তো একটা বাজে অভ্যেস আছে, কেউ কোনও একটা কিছু শুরু করলে ঝাঁকেঝাঁকে সবাই সেই কিছুর দিকে ঝুঁকে পড়ে সেই কিছুর বারোটা বাজিয়ে না দেয়া পর্য্যন্ত থামেনা ! বানিজ্য বা শিল্প মন্ত্রনালয় কি এইসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পুঁজির ( বড়জোড় হাযার খানেক টাকা লগ্নিকৃত )শিল্পগুলিকে বাঁচিয়ে রাখতে কোটি কোটি টাকা ( যদিও আসলে তা ব্যাংকের কাছ থেকে ধার করা টাকা ) বিনিয়োগ করা বড় পুঁজিওয়ালাদের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারেন না ?
অর্থনীতির বই পুস্তকে লেখা সব নিয়মকানুনের ( থিওরী আর প্রাকটিক্যাল এক জিনিষ নয় ) বাইরে গিয়ে শুধু বলি – সরকার কি পারেননা বৃহৎ পুঁজিপতিদের প্রতি এরকম নিষেধাজ্ঞা জারী করতে যাতে তারা যেন আর ঐসব ছোটখাটো শিল্পে (মসলার গুড়ো, চিড়া ভাজা, বাদাম ভাজা, ঘোল-দধি, সরষের তেল ইত্যাদির মতো শত শত গৃহস্থী শিল্প ) হাত না বাড়ান ? তাদের উৎপাদন সামগ্রীকে সীমিত সংখ্যায় রাখেন ?
দারিদ্র উন্নয়নে কোনও পরিকল্পনায় টাকা খরচ ব্যতিরেকেই দেশে কর্মপরিবেশ আর সংস্থান তৈরী করে দারিদ্রতা দূরীকরনে সরকারের তরফ থেকে এরকম নিরাপত্তা কি নিশ্চিত করা যায়না , সব ধরনের উৎপাদনে সবার অধিকার থাকবেনা ? একচেটিয়া ভাবে সব ধরনের পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করার অনুমতি সবাইকে না দিয়ে পণ্যের শ্রেনীবিভাগ করে আলাদা আলাদা উৎপাদক গোষ্ঠী তৈরী করা কি যায়না ? বড়রা সব বড় বড় উৎপাদন কাজে নিয়োজিত থাকবেন আর ছোটরা সব ছোট ছোট উৎপাদনে যাতে উৎপাদন ও বিপণনের সমস্ত ক্ষেত্রে সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় ?
ছোটখাটো উদ্দ্যোক্তারা এতে সাহসী হবেন , ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে । হারানো পেশায় আবার ফিরে আসতে পারবেন তারা ।
এতে প্রান্তিক ঐসব ক্ষুদ্র পেশাজীবীরা ও যেমন বেঁচে থাকবেন তেমনি বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো মুড়ি- চানাচুরের মতো ছোটখাটো পণ্য উৎপাদন ও বিক্রয় না করতে পারলেও ভাতে কাপড়ে মরে যাবেন না নিশ্চয়ই ।
এ ভাবনা হয়তো আমার - বেকার ! তবুও আশায় থাকি, এরকম কিছু একটা হবে কোনদিন।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ১০:৫২