শীতের কুয়াসার অবগুন্ঠন সরিয়ে প্রকৃতি হেসে উঠবে ধীরে , অতি ধীরে । নির্ঝরের স্বপ্ন ভেঙে গাছে গাছে , পত্র-পল্লবে ছড়িয়ে যাবে সে হাসি রঙের রোশনাই মেলে । গাছেদের শীতকাতুরে ঘুমচোখে আলতো চুমুর পরশ দিয়ে দখিনা বাতাস বলে যাবে ...খোলো খোলো দ্বার / রাখিওনা আর বাহিরে আমায় দাঁড়ায়ে ।
সবে মাতাল হয়ে উঠতে শুরু করা বসন্ত বাতাস গেয়ে যাবে -
এসেছি আমি এসেছি
দূর থেকে বহুদূরে
পথে পথে ঘুরে ঘুরে
এসেছি আমি এসেছি...............
বসন্ত কড়া নেড়ে বলে যাবে , এসে গেছে শিমুল পলাশের দিন । ফাগুনের মধুমাস । শীতের পিঠে উৎসবের ভাঙা হাটের স্তব্ধ ধূসরতা সরিয়ে রঙ আর চিরযৌবনের বারতা নিয়ে বসন্ত জেগে উঠবে আপনারই দুয়ারে, সকালের কুসুমরঙা আদর গায়ে মেখে মেখে ।
ঋতুরাজ বসন্তের এই কাব্য লিখতে গিয়ে মনে হলো , কী বলিহারী সাহস আমার ! বসন্ত বিলাসে কালের দিগ্বিজয়ী মানুষগুলোর কাছে কি অসহায় আমি ! মনের অলিতে গলিতে বিলাসী শব্দ খুঁজি , মেলেনা । যা মেলে, তা তাঁদেরই গাঁথা পূজোর মালার ফেলে রাখা ফুল । যেন আমারই বাগান থেকে কতোকাল আগেই চুরি হয়ে যাওয়া শব্দফুলগুলি । তাই আমার ভাঙা কলমের ভেতরে থেকে কাউকে মুগ্ধ করার মতো আস্ত এক-একখানা নিজস্ব শব্দ বসন্ত বাতাসে পাখনা মেলে দেবে এমনটা দুরাশা হয়েই রইলো !
তবুও কিছু কিছু শব্দের দোয়েল টুক করে ডেকে উঠে পশ্চিমে উড়ে যেতে চায়। মনের মাঝপুকুরে টুপ করে ঘাই মারে যেন শব্দের পোনামাছ । সে ঘাই জলের বুকে তরঙ্গ তুলে ফাগুনের বাতাসে কাঁপন ধরায় । সে কাঁপন যেন আমাকেই দোলা দিয়ে যায় ।
যায় হয়তো আপনাকেও । মাতাল করে তোলে । আপনার সমগ্র স্বত্তা জুড়ে সমর্পনের স্তোত্র অস্ফুটে ঝরে –
আমারে ফিরায়ে লহো
সেই সর্ব-মাঝে যেথা হতে অহরহ
অঙ্কুরিছে মুকুলিছে মুঞ্জরিছে প্রান
শতেক সহস্র রূপে, গুঞ্জরিছে গান
শতলক্ষ সুরে , উচ্ছসি উঠিছে নৃত্য
অসংখ্য ভঙ্গিতে .......
সমর্পনের কাব্য যদি কিছু থেকে থাকে মনমাঝারে তবে এখনি সময়- শীতের বিদায়ী শিশিরে ভিজে ভিজে তরতাজা হয়ে ওঠা বাঙলার আরণ্যক সবুজে ফুঁটে ওঠা জুঁই , চামেলী, বকুল, বেলী, পলাশ আর শিমুলের ছোঁপ ছোঁপ মুগ্ধতার কাছে নিজেকে নিবেদনের । সোনার খাঁচায় এ দিন রইবেনা তো বন্দী হয়ে চিরকাল! রাতের রজনীগন্ধার মতো সুবাস ছড়িয়ে চলে যাবে আরেক বছরের কাছে । ঘুরে যাবে সময়ের চাকা যেমন যায় রোজ। শুধু পড়ে থাকবে সময়-চাকার দাগ কারো মনে ! কোথাও গভীর হয়ে, কোথাও বেশ অগভীর............
“অঞ্জলি লহো মোর সঙ্গীতে...” নয়
লহো পুষ্পে পুষ্পে,
ঝরা শিমুলের রক্তিম চুম্বন অর্ঘ
কে নেবে, দেবো কাকে !
যে আমার তরে প্রতীক্ষিয়া থাকে
বেলোয়ারী চুড়ি হাতে , তাকে
দিতে চাই; যে আমারে ভালোবাসে
ফাগুনের এই মধুমাসে ।
দ্যুলোকে ভূলোকে তাই জেগে ওঠে কুসুমে কুসুমে চরণচিহ্ন রেখে যাবার আয়োজন । ভ্রমর প্রজাপতি মরে পথ ভুলে ভুলে । ফুলেদের কানে কানে কয়ে যায় কী গোপন বাণী ! দখিনা হাওয়ায় ভাসে পরাগ রেনু । গর্ভসঞ্চারের কাল । মধুমাছি তাড়িত হয়ে ফেরে ফুলে ফুলে .........
শীতের ঘুম শেষে
আকাশ জুড়িয়া জাগিছে
রোদের কলস্বর ,
দিগচক্রবালে উড়ে যায় পাখি
কুসুমে কুসুমে মধুকর ।
ফাগুনের আগুন আপনার মনে শীত শেষের উষ্ণতার ছোঁয়া দিয়ে যাবেই যদি তেমন একখানা দিগন্ত খোলা মন থাকে আপনার । শিমুল পলাশের দিন ঘুম ভাঙিয়ে রাঙিয়ে দিয়ে যাবে আপনার মন । সে মনে ঢেউ তুলে যাবে, না-বলা কথারা ----
ও পলাশ , ও শিমুল কেন এ মন মোর রাঙালে /
জানিনা আমার ও ঘুম কেন ভাঙালে................
শরম অরুণ রাগে গোপন ঝংকারে বেজে বেজে যাবে তা । যার পথ চেয়ে দিন গুনে গুনে গেছেন তারই পদধ্বনী আপনার মনের আকাশে মেঘের মতো ছায়া ফেলে ফেলে যাবে । হৃদয়ে অনেক কবিতা নিয়ে কিশোরী হয়ে যাবে পৃথিবী । কথা কইবার আকুল তৃষ্ণা উঠবে উদ্বেলিয়া ......
অপরিমেয় অদেখার খোঁজে
ফুলে ফুলে পত্র পল্লব সারে
মুখোমুখি বসি ....
চেয়ে চেয়ে দেখি
সে তো আমারি মতো আকুল
কথা বলিবারে ।
কাঠ গোলাপের রঙ বুকে নিয়ে এক বসন্ত সকালে জেগে উঠবে আপনার ঘুমন্ত শহর । গভীরভাবে আন্দোলিত বনে বনে অদ্ভুত জাগতিক হয়ে আসবে ঝরা বকুলের গন্ধ । কামিনী বনে প্রথম ধরা কলি, শুভ্রতার আঁচল উড়িয়ে ধীরে ধীরে হয়ে উঠবে পূর্ণ যৌবনা । প্রান্তরব্যাপী ছড়িয়ে যাবে সর্ষে হলুদের তুমুল রঙের কোলাহল । বাঙলার মাঠ-প্রান্তর আপনাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে দখিন হাওয়ার স্রোতে । রজনীর শেষ গন্ধ গায়ে মেখে ফোঁটা ফুল আপনার মনে গুনগুন করে গেয়ে উঠবে - ও রজনীগন্ধা, তোমার গন্ধ সুধা ঢালো ...........
অনিমিখে রাখি চোখ
বকের ডানার মতো সাদা সাদা ফুলে ।
ঘুম থেকে জেগে ওঠা বাঙলার প্রান্তরে,
উতলায় হৃদয়াবেগে মাঠের পরে
জুঁই , চামেলী, বেলী ও বকুলে
শেষ রজনীর গন্ধ যেন ওঠে দুলে
তারি গায়ে ।
বকুলের দিন সাজে বধূয়ার সাজ
আজও চোখে ধরে রাখি তার
নম্র , শ্বেত-শুভ্র কামিনী লাজ
বসন্ত বায়ে ।
কৃষ্ণচুড়ার, রাধাচুড়ার আগুন ছড়িয়ে যাবে সবখানে । ভেসে যাবে চৈতালী । প্রকৃতির শরীরে লেগে যাবে দোল পূর্ণিমার লাল-হলুদ ছোঁপ । পাগল হাওয়ার মতো আপনার মনখানিও হারিয়ে যাবে সেই লাল-হলুদের মেলায় । বাউরী বাতাস তবুও ডেকে ডেকে যাবে আপনাকে , জড়িয়ে নেবে কী জানি কী সুখে ! পাবলো নেরুদার মতো আপনারও মনে হবে , সব ফুল ফোঁটা যদি থেমেও যায় তবুও বসন্তকে থামাবো কি করে ................
আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে । কে ফেরাবে তারে ! খোঁপায় বাঁধা ফুল আর বাসন্তী রঙের শাড়ীতে, লাল পাঞ্জাবীর মিছিল দেখে মনে হবে , আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে ! ...........................
তবুও এই পোড়া চোখ থমকাবে, ধূলি ধুসরিত পথ-প্রান্তরে । বায়ু দূষনে সবুজ রঙ হারিয়ে, গায়ে গতরে এক প্রস্থ ধূলো মেখে পড়ে থাকা গাছে গাছে ! বসন্ত ধূসর হয়ে রবে পাতায় পাতায় । দেখে যাবো কঠিন অমেয় এই সব দিন রাতে প্রকৃতির নান্দনিকতার উপরে উঠতে গিয়ে আমাদের অমানবিক, অসংলগ্ন , অবিমৃষ্যকারী , অমিতচারী সব আয়োজনে অত্যাচারিত ধরনীর মরনের অপরিমেয় ছটা ! দেখে যেতে হবে হয়তো একদিন !
হারিয়ে যাবে একলা বড়
জীবন থেকে ফাগুন হাওয়া
ছিনিয়ে সন্ধ্যে বেলা !
সকল খেলা সাঙ্গ করে
বুকের ঐ গহীন তলে
রাখবে তুমি বসন্তেরই মেলা ।
তবুও শত মাইল অভাবী মনে একমাইল প্রাচুর্য্য নিয়ে পড়ে থাকা বসন্তের আড়বাঁশির সুর ঠিকানা পেরিয়ে কেন যে জিরোয় আমাদেরই একটুকরো উঠোনে !!!! মন খারাপের ট্রেন কেন যে হুশ করে ঢুকে যায় বসন্ত ষ্টেশনে !!!! চিত্রার্পিত প্রকৃতি কবির খাতা থেকে কেন যে উঠে আসে অনায়াসে একাকী সাম্পানের মতো জল কেটে কেটে !!!
গাহি ফাগুনের গান বসন্ত উৎসবে,
রমনার বটমূলে ফুলসাজে সাজি
অযুত নৃত্যের ভঙ্গিমায় আজি
জাগিয়া উঠিবে অগণন প্রান,
ফুলে ফুলে ভরিয়া রবে
এ দেশের যতো বটতল এমন সৌরভে ।
মনে হবে -
হাযার বছর ধরে
জেগে আছি মোরা এক সোনা-প্রান্তরে ।
তারপর একদিন থেমে যাবে ফাগুনের সব কোলাহল । বসন্তের বাউড়ী বাতাস গাইবেনা আর গান । নিঃশব্দে বদলে যাবে অনেক কথার দুপুর । দিন বদলের পালায় বদলে যাবে দিন .....
থেমে গেছে কি গান,
সুর নাহি কেন বাজে !
হৃদয় মাঝে, অহর্নিশ ব্যথা ঝংকারে
তবুও ফিরি বারেবারে,
দুটো চোখ তবু খুঁজে ফেরে কারে
উদাস ফাগুনের শেষ দুপুরে ....
চলবে ..........
প্রথম পর্ব - প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব – দ্বিতীয় পর্ব –
তৃতীয় পর্ব - তৃতীয় পর্ব -
চতুর্থ পর্ব - চতুর্থ পর্ব -
[ এই ছবি ও লেখা ব্লগটি সাজানো হয়েছে কয়েকটি অধ্যায়ে – বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত আর গ্রীষ্ণ নিয়ে ঋতুচক্র – পালাবদলের দিন, নিঃস্বর্গ, দেশ ও জীবন গাঁথা ; এমন করে। ]
ছবি – ইন্টারনেট থেকে ।
প্রতিটি ছবির জন্যে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি তাঁদেরই যারা ছবিগুলোর প্রকৃত দাবীদার ।
আর স্বনামধন্য যে সব কবি-লেখকের দু’একটি চরন তুলে এনেছি, কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি সেই মহাগুনীজনদের ও ।
এদের সকলের কাছেই ঋনী হয়ে রইলুম ।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ১১:৩১