চারিদিকে নুয়ে প'ড়ে ফলেছে ফসল ....... [ ছবি ও লেখা ব্লগ ]
[ তৃতীয় পর্ব ]
আকাশের নীলিমা যখোন ফিকে হয়ে আসে ধীরে ধীরে, মাঠের গায়ে তখন আড়মোড়া ভাঙে সোনালী রঙের ঝলমলে দিন । বন্যার গভীর জলের সমাধি থেকে জেগে ওঠে পোয়াতি মাটি । ভর-ভরন্ত শরীরে পলিমাটির ছোঁয়ায় ফসলের কচি কিশলয় মাথা তোলে । আসে ফসলের মধুমাস । হেমন্তের দিন মেলতে শুরু করে তার ফড়িঙ ডানা । মাঠের পর আরও সুদূরের মাঠে দোলা দিয়ে যায় আঘ্রানী বাতাস । মিহি মিহি কুয়াশা ডানায় মেখে নীড়ে ফেরে সব পাখি । বাতাসে বাতাসে ছড়িয়ে যায় ধানের শরীরের মহুয়া গন্ধ । ঘাসের ডগায় জেগে থাকে শিশির বিন্দু । শীতল জলের মুকুরে ছায়া ফেলে হাসে শাপলা –শালুক । হেমন্ত আসে রঙ-বাহারী শাড়ী পড়ে । বসন্ত বাতাসের আগে এ যেন প্রকৃতির পূর্বরাগ ।
প্রথম ফসলের ঘ্রানে ভেজা জলে
ছায়া ফেলে , ভীরু সন্তরনে ভেসে
রৌদ্র ঝিলিমিল হৈমন্তী সকালে
এক নবীন সূর্য্য
এই পৃথিবীর কাছে হেটে আসে ......
কর্ষনে কর্ষনে মাটির বুক চিরে
স্নেহের ফল্গুধারা তুলে আনি ধীরে
তা-ই যোগাবে সংবৎসর
তোমাদের মুখের আহার ।
শ্রমে কাতর আমি সেই জন
সহস্র বছর ধরে এমনি করে
বাঙলার বুকে রই জেগে
তোমাদের ফসলের তরে ।
যেতে হবে ঐ দূর তেপান্তর
যেথায় শ্রান্ত বাজান মোর
ফসলের মাঠে ক্ষুধায় কাতর - শ্রমে
আমারি অপেক্ষায় পথে রেখে আঁখি ।
তারি লাগি দু'মুঠো অন্নজল
নিয়ে পথ ভাঙি -
কুসুমে কুসুমে ভরা পথে
কালের হৈমন্তী রথে
চরণচিহ্ন রাখি .......
এভাবেই শুরু হৈমন্তী দিনের । ফসলের দিন ।
শুরু হয় ফসলের গান ........
ধরার আঁচল ভরে দিলে প্রচুর সোনার ধানে
দিগঙ্গনার অঙ্গন আজ পূর্ণ তোমার দানে । ( রবীন্দ্রনাথ )
সোনালী ধানের গান ঝরিতেছে
ঝরঝর উঠোনের পরে ,
আঘ্রানের সোমত্ত সময়টুকু ঘিরে
এলোচুলে কৃষকের ঘরে
ধানেরা উলুঝুলু মরিতেছে ........
শরীরে শ্রমের ঘ্রান নিয়ে
ক্লান্তি আসে ঘিরে,
দু’দন্ড জিরোবার ছলে
যাই ফিরে ফিরে
এক স্নেহময় প্রশান্তির কোলে .........
শেষ ধানটুকু ঝেড়ে নেয়া গেছে
উঠোনের কোলাহল নিঃশ্চল , নিঃশ্চুপ,
রহিছে পড়িয়া শুধু সোনালী খড়ের স্তুপ .......
ও ধান ভানি , ভানিরে ঢেঁকিতে পার দিয়া
ঢেঁকি নাচে আমি নাচি হেলিয়া দুলিয়া ।
ধান বেঁচিয়া কইতে নারি
টিয়া রঙের কিনবো শাড়ী .......
নাকের নোলক, চুলের ফিতা
কিনবো গলার মালা
কানের পাশা, রেশমী রুমাল
আরও হাতের বালা .......... ( গান )
হেমন্তের অপরাহ্নে হিজলের তলে
নবান্নের ডালা সেজে ওঠে করকমলে ।
পিঠা-পুলি ঘ্রানে, এই অঘ্রানে
বাংলার মধুকর ডিঙ্গা ভাসে,
নতুন ধানের কোমল উচ্ছাসে .........
সবে কুয়াশা ঘনায়
দূর দিগন্তে সন্ধ্যার গায়,
হেথা হেমন্তের গোধূলি মঞ্জরী
উচ্ছসিত আলোয় গুঞ্জরী
ধেঁয়ে চলে ভীরু পায় .......
ভিজে হয়ে আসে এ হেমন্তের বেলা
নিঃশ্চুপ ফসলের ক্ষেত তারি চোখে উদ্ভাসি
কোন সে বালিকার মনে
একাকী করে যায় খেলা .....
বিজন ঘাসের পরে, শিশিরে
কি হিরন্ময় কনক আভা ফোঁটে
হেমন্তের প্রথম সকালে ,
ভীরু শামুকের খোলে
লাগে তারি ঘ্রান ...
এই পড় পড় , কচুর পাতায়
টলোটলো শিশির বিন্দু ,
কাহারো মনে দোদুল দোল
উথলি ওঠে যে সিন্ধু ......
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশির বিন্দু ........ ( রবীন্দ্রনাথ )
চারিদিকে নুয়ে প’ড়ে ফলেছে ফসল
তাদের স্তনের থেকে পড়িতেছে শিশিরের জল
প্রচুর শস্যের গন্ধ থেকে – থেকে আসিতেছে ভেসে
পেঁচা আর ইঁদুরের ঘ্রানে আমাদের ভাঁড়ারের দেশে ....... ( জীবনানন্দ দাশ )
স্নিগ্ধ নরম জলে
মাথা তুলে, কি কথা তাহার সাথে
ললিত নৃত্যে কয়ে যাও অনায়াস -
হে চিরন্তন পুষ্পরাজি কবেকার
হেমন্তের ছায়া ফেলে ফেলে
কি নিষ্পাপ কিশোরীর কোলে
হৃদয় মথিয়া জাগাও
শাপলা শালুকের মধুমাস .....
আজ আর পুরোনো দিনের মতো মহাসমারোহে হেমন্ত আসেনা বাংলার মাঠে । সে ফসল আজ আর কৃষকের ঘরে ওঠেনা । মহাজনী গোলায় বাড়ে তার শোভা । ধানের সোঁদা গন্ধে কৃষকের বুক জুড়োয় না আগের মতোন , কেবলি দুঃখের বাতাস হু-হু বয়ে যায় বুকে ।
ফসলের মাঠ ছোট হয়ে আসে দিনে দিনে । সোনালী ধানের শীষে ঢেউ তুলে যায় দুখিনী বাতাস ।
তবুও তারি মাঝে জীবন বয়ে চলে আশা-নিরাশার দোলে ................
চলবে ..........
প্রথম পর্ব - Click This Link
দ্বিতীয় পর্ব - Click This Link
[ এই ছবি ও লেখা ব্লগটি সাজানো হয়েছে কয়েকটি অধ্যায়ে – বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত আর গ্রীষ্ণ নিয়ে ঋতুচক্র – পালাবদলের দিন, নিঃস্বর্গ, দেশ ও জীবন গাঁথা ; এমন করে। ]
ছবি – ইন্টারনেট থেকে ।
প্রতিটি ছবির জন্যে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি তাঁদেরই যারা ছবিগুলোর প্রকৃত দাবীদার ।
আর স্বনামধন্য যে সব কবি-লেখকের দু’একটি চরন তুলে এনেছি, কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি সেই মহাগুনীজনদের ও ।
এদের সকলের কাছেই ঋনী হয়ে রইলুম ।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৩:০৭