কতিপয় শব্দের গাঁটছড়া
গতরাতে একটা স্ফীত উদর নিয়ে যখোন চাঁদ উঠলো তখোন আমার মনে হলো, সে বোধহয় একটা সূর্য্যের জন্ম দেবে এখোনই । এমনি একটা বৃহৎ পরিপূর্ণতার সম্ভাবনা নিয়ে আকাশের কার্নিশে ঝুলে ছিলো সে । যেমনই ঝুলে ছিলো নিলীমা এ্যাদ্দিন । তখোনই মন্ত্রোচ্চারনের মতো বিড়বিড় করে জোড়াঠোট সেই পরিপূর্ণতার বিষয়-আশয় উগরে দিলো...
"তথাস্তু । নিজেকে ছড়াও... ছাপিয়ে ওঠো নশ্বর দেহমন ।"
চালধোঁয়া পানির মতো নিলীমা আমার যাবতীয় দিনযাপনের সুখগুলো নর্দমায় ঢেলে দিলে , আমি তাই গড়িয়ে যেতে থাকি সুনীল সমুদ্রের দিকে । নিজেকে ছড়াতে । সমুদ্র নাকি অসীম ! তার বুকে ডুব দিয়ে সসীম কালিমাগুলো নাকি নির্বান লাভ করে !
আমি নির্বাণ লাভে লোভাতুর হলে গড়াতে থাকি ব্লগীয় এক সারগোসা সাগরের খোঁজে ।
" জুন " এর মতো পেড়িয়ে যেতে থাকি দেশ --দেশান্তর । উত্তরে সুমেরু থেকে দক্ষিন গোলার্ধে । মিশরের ধু-ধু মরুভূমির উষ্ণতা পেড়িয়ে ছেরাদ্বীপ প্রবালের শীতল জলের কাছে । ব্যারেন্ট সী'তে ডৃবে যাওয়া কুরষ্ক জাহাজের নাবিকের মতো দুমুঠো বাতাসের জন্যে হাপিয়ে উঠি । আল-আকসার সুউচ্চ আযান আমার শোনিতবিষ শুষে নিলে বুঝি, মধ্যদিন আর অনন্ত বেঁচে থাকার প্রদমিত কৌতুকের মতো দুঃখেরা দীর্ঘ মিনার বেয়ে গুটি গুটি হেটে আসে কাছে । বুঝে উঠি, দ্রৌপদীর নৃত্যের মতো সবচেয়ে দ্রুতগামী এই দুঃখ-প্রানীই আমাকে বয়ে নিয়ে যাবে পূর্ণতার পানে । ভেতরের আমি বলে --- ওঁম শান্তি ........ । আমি তথাগত হই ।
"হাসান মাহবুবের" অমোন মৃত্যু সার্টিফিকেট আমার চাইনে এ অবেলায় । দীর্ঘ লাইনে যারা যারা স্বর্গ বা নরকের মাঝে নির্বান লাভে লোভাতুর আমি তাদের সযত্নে পরিহার করি । ছিঁড়ে ফেলি ইচ্ছে দুপুরের নেতিবাচক চিন্তাসূতো । আত্ম হননের ইচ্ছায় মরে যাওয়ার মতো বহুল চর্চিত অভ্যাসশিল্পে দক্ষ হয়ে ওঠা মানুষগুলোর মতো আমার সূচিবায়ু নেই । নিহিলার মতো নিলীমাও আমার কন্ঠনালী ধারালো ব্লেডে ক্ষতবিক্ষত করে দিতে চাইলে "অপর্ণা মম্ময়" এর মতো নিরবে ঘুলঘুলির এস্রাজ বাজাতে থাকি । তাতেই দুরে কোথাও বেজে ওঠে নৈঃশব্দের জলনূপুর । কৌমুদী তৃষ্ণায় নিলীমার বুকছাতি কেঁপে কেঁপে উঠলেও চন্দ্রাহত হয়না আমার দৃষ্টি প্রদীপ । আমি তথাগত হয়ে উঠার প্রথম ধাঁপে পা রেখে "স্বপ্নবাজ অভি"র মতো কবিতার শেষ প্যারা শুনিয়ে দেই নিলীমাকে। কানে কানে বলি, নিলীমা নৈঃশব্দে কান পেতে শুনে নাও সহস্র নির্ঘুম রাতের নিরাকার যন্ত্রনা কি ভয়ানক ! আলোকিত সূর্য্যজ্ঞান দেখা দেয়া বালিকার মতো কোচড়ে সামলে রাখি গোপন নৈরাশ্যে গেয়ে ওঠা নিরাশার গান । এ গানের কবিতারা ছুঁয়ে যায় আকাশ, যেমন যায় " মামুন রশীদ "এর কবিতারা । আমিও ছুঁতে চাই নিলীমাকে । কোনও এক অবসন্ন দুপুরে ধীরে ধীরে ধীরে বয়ে যাওয়া উতল হাওয়ার মতো কবিতারা আবার ফিরে আসে চুপিচুপি । পারমিতা ফিরেছিলো কিনা জানিনে । নিলীমা ফেরেনি । তাই বুঝি আমার এই "বোকামন " এর ভেতর ঝাঁকে ঝাঁকে একলা প্রহর ঘাই মেরে যায় । তখোনই কাগজের ঝুড়ি থেকে কতিপয় শব্দ নির্বাণ লাভে বৃথা আস্ফালনে মুখ তোলে তার । নিলীমার বিষগন্ধা শরীরের শব্দগুলো টুপুর টুপুর ঝরে এক-দুই করে । পুকুরঘাটে জলের ছাপে সিঁড়ির ধারাপাত দেখতে দেখতে ....... দেখতে দেখতে " সেলিম আনোয়ার "এর মনের ভেতর যেমোন , তেমন অদ্ভুত আঁধার ভর করে আমার সবখানে । ভেবেছিলাম এই ধারাপাত হবে সুন্দর, প্রতিটি বর্ণে প্রাণ হবে কিশোরীর মতন । হয়না । চেয়ে থাকতে হয় দারুণ উৎকন্ঠা নিয়ে । ঘুণ ধরা বিবেক আর অস্থিমজ্জায় শৈবালেরা যেন মাথা তোলে । প্রানের শিহরন লাগে বদ্ধ জলে । আমার নির্বাণ লাভ তেজস্বী হতে থাকে ক্রমে । শুঁয়োপোকার মতোন গুটিগুটি প্রজাপতি ডানা মেলে এক বোধিসত্ত্ব জন্ম নিতে থাকে ভেতরে ভেতরে । শরীরী অহংকে ছাড়িয়ে সে প্রজাপতি উড়ে যায় বোধ এর দিকচক্রবালে ।
আর তাতেই অন্নকামিগন যেমোন কূপকে সেচন করে তেমনি নশ্বর মানুষের জন্যে শতকর্মা হয়ে উঠি ।
হে শোভনকর্ম বিশিষ্ট মানবকূল; তোমাদের গোষ্ঠ ঘৃতপূর্ণ করো ! পৃথিবী মধুময় করো ! জেনে নাও, " মানুষ " একটি অবস্থা ... অস্থি-চর্ম-মাংশের আবরনে ঢাকা শ্রেষ্ঠতর আর ক্রুদ্ধ এক প্রানী । নিষ্ঠুর এবং ভয়ঙ্কর ।
নিজেকে আর মানুষকে তাই ভালোবাসা সমর্পণে স্থিত হতে হবে আমায় । জগতের সার সত্য খুঁড়ে খুঁড়ে বেছে নিতে হবে ঠিকঠাক চাষের দানাটি । বাদামের খোসা ভাঙ্গার মতো শব্দ তুলে জ্ঞানের কাছে নিজেকে মুখর করে তুলতে হবে, উঠতে হবে ভগবান তথাগত হয়ে । অজ্ঞানের দুঃখ শুষে শুষে নীলকন্ঠ হতে হবে আমায় । বিলোতে হবে আত্মার প্রসাদ - শাশ্বত বোধ । আমার এহেন সর্বাঙ্গের ইচ্ছেকে ধ্বনিত করে তুলতে হবে । এক একক, নির্দোষ, অবিচল, স্বয়ংসিদ্ধ, অক্ষয় এক পরমাত্মাকে ধারন করতে হবে । যে সমুদ্র ধরবে কলুষিত নদীকে কিন্তু নিজে হবেনা কলুষিত এমোন এক মহা সমূদ্র হয়ে উঠতে হবে আমায় । আত্মার রুপান্তর ঘটাতে হবে ত্রিবিধ উপায়ে । অগ্নি– ঈষান- নৈঋত এমতো ছড়াতে হবে ইচ্ছের শেকড় । শুষে নিতে হবে ধরিত্রীর মাদকতা । আপন দুঃখ বেদনা থেকে আপনার দৃষ্টিকে সরিয়ে রেখে নিজেকে নির্বিকার রাখার মধ্যে রয়েছে যে মাদকতা ।
আমি তেমন প্রতীক্ষাতেই আছি--- চাষী যেমন ক্ষেতে বীজ বুনে অপেক্ষায় থাকে ফসলের ।
সেদিন পৃথিবীর আপন হাতখানা আপনার পানে ধরে থাকবে আমার হৃদপিন্ডের মখমলের কৌটাখানি । একটি কৌটা, ডালা মুক্ত করা হয় যেমন লজ্জাবনত আগ্রহশীল চোখের সামনে , সেইভাবে পৃথিবীর হাত তুলে ধরবে সেই কৌটাখানি । নিলীমা অবাক হয়ে দেখবে । তার নর্দমায় ঢেলে দেয়া চালধোঁয়া পানির ভেতর থেকে অযুত "আমি " উছলে যাবে নিঝুম দ্বীপ-সমুদ্রে । তখোনই সমুদ্র সঙ্গমে আদিম ওঙ্কার সূর্য্যস্নানে রত হবে ।
তাতে নিলীমার চোখ লজ্জাবনত হয়ে উঠলে , তার দেহ মন নিঃষ্কাম রোদে ঝলসে গেলে তবেই মহানির্বাণ প্রাপ্ত হবে শরীর আমার ।
তথাস্তু .........
( সবিনয়ে বলছি -- যে সব সম্মানিত সহ-ব্লগারদের নামোল্ল্যেখ করে তাদের ব্লগলেখার কিছু কিছু শব্দের গন্ধ নিয়ে যে গাঁটছড়া বেঁধেছি , তার বাইরেও অনেকে থেকে গেছেন । যারা থেকে গেলেন তাদের আমি ভুলিনি । তারাও হয়তো আগামী কোনও লেখার বিষয়বস্তুর সম্ভাবনা সঞ্জাত হয়ে উঠতে পারেন । )