পৃথিবী বিখ্যাত ছবিরা
প্রত্যেক মানুষের মনের ভেতরই একটি শিল্পী লুকিয়ে থাকে । তাই যে মানুষটিকে আপাতঃ নিষ্ঠুর বলে মনে হয় , দেখা যাবে সেও ফুলকে ভালোবাসে । শিল্পের প্রতি, সুন্দরের প্রতি মানুষের এ এক সহজাত টান । তাই জন্মের পরেপরেই আপনি পিটপিট করা চোখ নিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে চারদিক দেখেছেন অবাক হয়ে । পৃথিবী আসলে সুন্দর যে, তাই ! সুন্দরতার প্রতি আপনার ভালোলাগার বোধটুকু জন্মাবার অনেক অনেক আগেই আপনি তা গায়ে মেখে নিয়েছেন ।
এই সুন্দরতাকেই কেউ কেউ অমর করে রাখেন । শিল্পীরা কেউ গানে, কেউ কবিতায়, কেউ বা আঁকা ছবিতে বা কেউ ফটোগ্রাফিতে তুলে আনেন সেই সুন্দরতারই সুবাসটুকু । এগুলোর অনেক কিছুই আমাদের কাছে নান্দনিক হয়ে ধরা দেয় । যাদের চোখ আছে, মনের ভেতর উথাল-পাতাল আছে তাদের কাছে হাতে আঁকা ছবির কদরই আলাদা ।
সারা পৃথিবী জুড়ে কতো যে বিখ্যাত বিখ্যাত চিত্রকর রয়েছেন, তাদের আঁকা যে রাশিরাশি চিত্র বা সোজা কথায় “ছবি” রয়েছে তার খবর আপনারা অনেকেই রাখেন । আজ তাদের কয়েকটি নিয়েই কথার ছবি আঁকতে চাই আমি ।
ছবি বিখ্যাত হয় অনেক কারনে । আমি শিল্পবোদ্ধা নই তাই আমার ব্যাখ্যা “চিত্রশিল্প ব্যাকরন” এর সাথে মিলতে হবেই এমোন ধারনা করা ভুল হবে ।ছবি বিখ্যাত হয় তার বিষয়বস্তুতে, রংয়ের প্রয়োগে, আঁকার মাধ্যম এবং ধরনে, কালের প্রভাবে । ছবি বিখ্যাত হতে পারে তার অস্পষ্টতার কারনেও । আর সবচেয়ে জোড়ালো যে কারনটি তা হলো ছবিটির ক্রয়-বিক্রয় মূল্য ।
বিষয়বস্তুর কারনে বিখ্যাত ছবি “ গোয়ের্ণিকা ” । অস্পষ্টতার কারনে “ মোনালিসা ” । রংয়ের কারনে “ ওয়াটার লিলি ” বা “ ফ্লেমিং জুন ” । আঁকার ধরনে “ দ্য নাইট ওয়াচ ” বা “ দ্য ক্রিয়েশান অব এ্যাডাম ” । মূল্যের কারনে “দ্য বয় উইথ আ পাইপ” বা “ সেলফ পোট্রেট ” । আবার বিতর্কিত শিল্পীর কারনেও তার ছবি বিখ্যাত হয়ে ওঠে যেমনটা হয় ‘ভিঞ্চি’র বেলা বা ‘ভ্যান-গ্যঁ’ এর বেলাতে । দামের দিক থেকে এ পর্য্যন্ত সবচেয়ে বেশী দামে বিক্রী হওয়া ছবি হলো পল সীজানের “ দ্য কার্ড প্লেয়ার” । কাতার এর রয়্যাল ফ্যামিলি ছবিটি কিনেছেন ২৫৯ মিলিয়ন ডলারে ।
মজার ব্যাপার হলো, এই সব বিখ্যাত বিখ্যাত ছবির অনেকগুলিকেই মনে হবে, আপনিও এর চেয়ে ভালো আঁকতে পারতেন । এমোনটা কি মনে হয়না মাঝে মাঝে ?
যাক, মূল কথায় ফিরে আসি । বত্তিচেল্লির ছবি দিয়েই শুরু করা যাক ।
বার্থ অব ভেনাস / সান্দ্রো বত্তিচেল্লি ।
ছবি - “বার্থ অব ভেনাস”
পুরো নাম আলেসান্দ্রো ডি মারিয়ানো ডি ভান্নি ফিলিপ্পি । যে নামে আপনারা তাকে চেনেন তা হলো – বত্তিচেল্লি । ইতালীর ফ্লোরেন্সে ১৪৪৫ সালে তার জন্ম । জীবনের শুরুতে ছিলেন স্বর্ণকার । থাকেন নি সেখানে । হয়ে উঠেছিলেন য়্যুরোপীয় রেনেশাঁর প্রথমদিককার আলোচিত পেইন্টার । সোনার চেয়েও মূল্যবান সব পেইন্টিং এঁকে এখোনও পেইন্টিংয়ের ইতিহাসে পৃথিবীর প্রথম সারির একজন চিত্রকরের জায়গা দখল করে রেখেছেন । তারই ভুবনখ্যাত ছবি – “বার্থ অব ভেনাস” । ক্যানভাসের উপরে টেম্পেরায় করা । আকারে ৬৭.৯ ইঞ্চি বাই ১০৯.৬ ইঞ্চি । ১৪৮২ থেকে ১৪৮৫ সালের ভেতর আঁকা । বিখ্যাত হয়ে আছে পনের শতকের ইতালীয়ান আর্টের ল্যান্ডমার্ক হিসেবে । ছবিটির অন্তর্নিহিত অর্থ আর প্রাচীনতার রুপকসূত্র হিসেবে এর উপস্থাপনা ছবিটিকে পৃথিবীখ্যাত আর বহুল আলোচিত করে রেখেছে ।
প্রেমের দেবী ভেনাস এর নাম শোনেননি এমোন লোক খুঁজে পাওয়া ভার । গ্রীক পুরানের হিসেবে যাকে আপনারা “আফ্রোদিতি” বলেও জানেন । তো সেই ভেনাসকেই দেখানো হয়েছে এখানে । উঠে আসছেন সাগরের বুকের গহন থেকে , ঝিনুকের তরী বেয়ে ডাঙায়, সদ্য ফোঁটা একজন তরুনী হিসেবে । তার জন্মবৃত্তান্তের সাথে মিল রেখে এমোন দৃশ্যপটের আবহ তৈরী করা হয়েছে । বত্তিচেল্লির যেমন স্বভাব, ছবির আকৃতিগুলোকে কখোনই স্বাভাবিক বা ন্যাচরল করে আঁকেন না, এখানেও তাই । ভেনাসের অঙ্গগুলিরও শারীরিক সামঞ্জস্য নেই এখানে । অপেক্ষাকৃত লম্বা বাঁকানো গ্রীবা । বুকের দিকটাও তাই । দাঁড়ানোর ভঙ্গীটিও স্বাভাবিক নয় । যদিও তার দাঁড়ানোর ভঙ্গীটিকে আঁকা হয়েছে বেঁকে থাকার ধ্রুপদী ভঙ্গীতে, যেখানে একপা’য়ের উপরে তার সব শারীরিক ভার ছেড়ে দেয়া হয়েছে । তার উপর ভেনাসকে বত্তিচেল্লি ঝিনুকের এমোন একটি জায়গাতে দাঁড় করিয়েছেন যে কোনও মূহুর্তে তা উল্টে যেতে পারে । ভেনাসের ডানদিকে আছেন বায়ুর দেবতা “জেফিরাস” আর তার বক্ষলগ্ন হয়ে থাকা মৃদুমন্দ হাওয়ার প্রতীক “ অরা” । বামে অপেক্ষমান রয়েছেন ঋতুর দেবী “ হেরা” । প্রেমের দেবীকে বরন করে নিতে তার হাতে রয়েছে ফুলাচ্ছাদিত বস্ত্রখন্ড । দৃশ্যপটে বাকী যা আছে, মনে করা হয় তা নিছক সৌন্দর্য্য বাড়ানোর জন্যেই । বেগুনী রংয়ে এসেছে গাছপালা । বেগুনী নাকি ভালোবাসার রং, তাই । কারো কোনও ছায়া আঁকেননি শিল্পী এখানে । তাই ধরে নেয়া যায়, এটা একটা স্বপ্নবিলাসী ছবি ।
ইতালীয়ান মেডিসি প্রাসাদের জন্যে বত্তিচেল্লি এটি আঁকেন । মনে করা হয়, ভেনাসের মডেল হিসেবে মেডিসি প্রাসাদের সভাকক্ষের সুন্দরী শ্রেষ্ঠা জনপ্রিয় “সিমোনেত্তা কাত্তানিও ডি ভেসপুঁচি” কে ব্যবহার করেছেন তিনি । মনে তো আরো অনেক কিছুই করা হয় । মৃদুমন্দ হাওয়ার প্রতীক “অরা”ও কি ভেসপুঁচি ? আদলটাও মিলে যাচ্ছে ভেসপুঁচির আদলের সাথে । আর এই ছবিতে কি অসাধারন নমনীয়তার ছন্দে অরাকে এঁকেছেন তিনি । এটা কি ভেসপুঁচির প্রতি তার গভীর গোপন অনুরাগের প্রকাশ ? আর বায়ুর দেবতা কি বত্তিচেল্লি নিজে ? কল্পনা করেছেন, প্রেমাষ্পদকে আঁকড়ে আছেন বুকে ? রসিকজন এমোনটা মনে করতেই পারেন । কারন, ভেসপুঁচির অনেক অনেক পোট্রেট করেছেন বত্তিচেল্লি ।একটুও অনুরাগ কি জন্মায়নি ?
রেনেশাঁ সময়কালের বিশেষজ্ঞ চিত্র ঐতিহাসিকরা কিন্তু তেমনটা মনে করেন না । অনেকের ধারনা, বত্তিচেল্লি এটা এঁকেছেন স্বর্গীয় ভালোবাসার নিওপ্লেটনিক ধারনা থেকে, যেখানে ভালোবাসা নগ্ন ভেনাসের রূপ ধরে বিরাজমান ।
আর এক দলের মতে ছবিটির আইকনোগ্রাফি মিলে যায় কবি এ্যাঞ্জেলো পলিজিয়ানোর কবিতা “Stanze per la giostra” র বর্ণনার সাথে । তাদের ধারন্ বত্তিচেল্লি এই কবিতার আলোকেই ছবিটি এঁকেছেন ।
“বার্থ অব ভেনাস” বই এর লেখক চার্লস আর. ম্যাক বলছেন আর এক কথা । তিনি বলছেন, একটি “স্তব” এর উপর ভিত্তি করে ছবিটি আঁকা যে স্তবে ভেনাসের আগমনকে চিত্রায়িত করা হয়েছে ছন্দে ছন্দে । গ্রীক রিফিউজি “দিমিত্রিওস চকোকন্দ” এর এই স্তবটি প্রকাশিত হয় ১৪৮৮ সালে ফ্লোরেন্সে । ম্যাক বলছেন, ফ্লোরেন্টাইন প্রজাতন্ত্রের শাসক লোরেঞ্জো দ্য মেডিসির গুন গাইতেই এটা প্রতীকি হিসেবে আঁকা ।
এ ধারনাকে বাতিল করে দেয়া হয়েছে এই বলে যে, যেহেতু বক্তব্যটি ছবিটি আঁকার জন্যে মেডিসির নির্দেশ এর উপর নির্ভরশীল আর যেহেতু মেডিসি প্রাসাদে ছবিটিকে দেখা যায়নি ১৫৫০ সালের আগে পর্য্যন্ত তাই এই বক্তব্য মেনে নেয়া যায়না ।
আসলে বত্তিচেল্রি কি দেখে অনুপ্রানিত হয়েছিলেন এর সঠিক জবাব নেই । রেনেশাঁ যুগে প্রাক্সিটিলিসের গড়া ভাস্কর্য্য “আফ্রোদাইত” এর ভঙ্গীমার সাথে বত্তিচেল্লির ছবির ভেনাসের অদ্ভুৎ মিল দেখে মনে হতে পারে বত্তিচেল্লির প্রেরনা এটাই । কারন এই ভাস্কর্য্যটি মেডিসি প্রাসাদেই রাখা ছিলো ।
ছবি – ভেনাস দ্য মেডিসি
যার জন্যে এই ছবিটি আঁকা হয়েছিলো সেই লোরেঞ্জো দ্য মেডিসির প্রাসাদ “ভিলা দ্য কস্টেলো”তে আজ আর নেই ছবিটি । ভেনাসের মতো ভেসে ভেসে আজ ছবিটি গিয়ে ঠেকেছে ফ্লোরেন্সের উফিজি গ্যালারীতে ।
আর ইটালীয়ানদের পকেটেও ঠাই মিলেছে তার । ১০ সেন্টের ইতালীয়ান ইউরো কয়েনে যে মুখটি আপনি খোদিত দেখেছেন তা কিন্তু বত্তিচেল্লিকৃত ভেনাসের ।
ভেনাসের এভাবে সমুদ্র থেকে উঠে আসার দৃশ্যটি আবার কাজে লাগিয়েছেন চলচ্চিত্রকারেরাও । ১৯৬২ সালের তৈরী জেমসবন্ড সিরিজের “ডঃ নো” চলচ্চিত্রে নায়িকা উরসুলা এ্যান্ড্রেস যে ভাবে সমুদ্র থেকে উঠে এসেছেন সেই দৃশ্যকল্পটি কিন্তু এই “বার্থ অব ভেনাস” এর থীম অনুকরনে করা হয়েছে । ১৯৮৮ সালে এই থীমটিকেই আবার পাকাপোক্ত করে বিস্তৃত ভাবে নায়িকা উমা থরম্যান এর মাধ্যমে দেখানো হয়েছে “ দ্য এ্যাডভেঞ্চারস অব ব্যারন মুঞ্চাউসেন “ চলচ্চিত্রে ।
ওয়াটার লিলিজ / ক্লঁদ মনে ।
ছবি – ওয়াটার লিলিজ
২৫০ টি তৈলচিত্র নিয়ে গড়ে উঠেছে ফ্রেঞ্চ ইমপ্রেশনিষ্ট “ক্লঁদ মনে”র “ ওয়াটার লিলিজ” সিরিজটি । ৭০ বছর বয়সকালের বেশীর ভাগটা ধরেই ছবি এঁকে এঁকে ক্লান্ত শিল্পীর মনে হয়েছে এবারে থিতু হবার পালা । দক্ষিন ফ্রান্সের জিভার্নিতে শেষমেশ থিতু হয়েছেন মরনের আগ পর্য্যন্ত । জীবনের শেষদিনগুলো, প্রায় ৩০ বছর ধরে এঁকেছেন নিজের ফুল বাগানের ছবি । ততোদিনে চোখে ছানি পড়ে গেছে । ওয়াটার লিলি সিরিজটি মূলত এই বাগানেরই ফুল, পুকুর আর পুকুরে পড়া রোদের খেলা নিয়ে । আঁকতে শুরু করেছেন ১৯১৯ সালে । ছবিটির মূল বক্তব্য প্রকৃতিকে উৎসাহিত করা আর যারা এটি দেখছেন তাদের চোখে প্রকৃতির স্বপ্ন এঁকে দেয়া । এদিক থেকে দেখলে ক্লঁদ মনে’কে খাটি প্রকৃতি প্রেমিক বলা চলে । গাঢ় নীলের আবেশ ছবিটির অনেকটা জায়গা জুড়ে । ওয়াটার লিলি ফুল আর পানিতে সূর্য্যাস্তের আলোছায়ার খেলা মনে’ এঁকেছেন একই রকম চ্যাপ্টা ব্রাশ দিয়ে দৃশ্যমান ব্রাশ স্ট্রোকে । কোথাও রং ব্লেন্ডিং করেননি । অসংখ্য চ্যাপ্টা ব্রাশ স্ট্রোকের মাঝে মাঝে কয়েকটি চিকণ ব্রাশ স্ট্রোকের দেখা মেলে কেবল । সম্ভবত ক্লঁদ মনে খুব নির্দিষ্ট সাইজের গুটি কয়েক ব্রাশ ব্যবহার করেছেন এখানে । ব্রাশ স্ট্রোকগুলোর দৈর্ঘ্য বিভিন্ন আর এর ব্রাশ চালনার ডিরেকশানও ভিন্নভিন্ন । ছবিটির এক একটি বিষয়বস্তুর জন্যে এক এক ধরনের ব্রাশ স্ট্রোকের ব্যবহার করেছেন তিনি । গাছপালার আউটলাইনের পাশের স্ট্রোকগুলো সবটাই ছড়ানো । সমস্ত ছবির দিকে তাকালে মনে হবে এই স্ট্রোকগুলি অন্য সব স্ট্রোকের চেয়ে একেবারেই আলাদা । ব্রাশের প্রতিটি টানই পরিষ্কার ভাবে দৃশ্যমান, একটির সাথে আর একটি মিলে যায়নি । আর এভাবেই ছবির সবটা জুড়ে আছে ষ্ট্রোকে আলো-আধারির খেলা ।
ঐতিহাসিক ভাবেই একজন শিল্পী প্রকৃতিকে তুলে আনতে চেষ্টা করেন ( ট্রাই টু কপি দ্য নেচার ) তার ছবিতে । কিন্তু প্রকৃতির বিশদতাকে এভাবে ক্যানভাসের ছবিতে রুপান্তর যথার্থ প্রকৃতি হয়ে ওঠেনা কখোনও । এখানেও সেই চেষ্টাটি করা হয়েছে তবে ভিন্ন ভাবে । আপনারা জানেন, একজন শিল্পী চেষ্টা করেন এটাই যে, তার ছবিটি যে হাতে আঁকা তা যেন বোঝা না যায় । তাই শিল্পী সন্তর্পনে ব্রাশ স্টোকগুলি এমোন ভাবে টানেন যেন স্ট্রোক বোঝা না যায়, স্ট্রোকগুলি যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় । যেন অদৃশ্য হয়ে থাকে প্রতিটি তুলির টান । অথচ ক্লঁদ মনে এটাকেই এড়িয়ে গেছেন সচেতন ভাবে । ছবির সব ক’টি স্ট্রোকই এখানে স্পষ্টতই আলাদা আলাদা ভাবে ফুটে আছে । শিল্পী তার হাতের উপস্থিতি লুকোননি মোটেও । তুলির প্রতিটি টানেই শিল্পীর উপস্থিতি দৃশ্যমান ।
বলা যেতে পারে, ওয়াটার লিলি ছবিটি ব্রাশ স্ট্রোকের মুন্সীয়ানা । ছবিটির আর ক্লঁদ মনে’র অনন্যতা এখানেই । আর এই অনন্যতাই এনে দিয়েছে ছবিটিকে বিশ্ব জোড়া খ্যাতি ।
ছবি – নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটান মিউজিয়ম অব আর্ট এর দেয়াল জুড়ে ওয়াটার লিলিজ সিরিজের একাংশ ।
আজ সারা পৃথিবীর মিউজিয়মগুলোর দেয়াল জুড়েই ছড়িয়ে আছে ওয়াটার লিলি । অনেক বাঙালী শিল্প রসিকের লেখাতেও বা ভ্রমনের গল্পেও আমি এর উচ্ছসিত প্রশংসা দেখেছি ।
নাইট ওয়াচ / রেমব্রান্ট ভ্যান রীন ।
ছবি - নাইট ওয়াচ
ডাচ স্বর্ণযুগের তুঙ্গ সময়কাল ১৬৪২’র আঁকা ছবি । ডাচ শিল্পী রেমব্রান্ট ভ্যান রীন এর সবচেয়ে আলোচিত ছবিগুলোর একটি । বিখ্যাত হয়ে আছে তিন তিনটি গুনের জন্যে - ১১.৯১ ফুট বাই ১৪.৩৪ ফুট এর বিশাল সাইজ, ছবিতে আলোছায়ার সত্যিকারের খেলা আর ছবিতে থাকা মানুষগুলো যেন এই চলতে শুরু করেছে এমোন একটি ভাবের কারনে ।
বিষয়বস্তু আহামরি কিছু নয় । একদল শহররক্ষী যেন এই বেড়িয়ে পড়ছেন শহর রক্ষায় ।
ছবি যারা ভালোবাসেন তারা রেমব্রান্টের নামের সাথে পরিচিত বলেই ধরে নিতে হয় । ১৭ শতকেরই শুধু নয় রেমব্রান্ট ছবিতে আলোছায়ার খেলায় , এচিঙয়ে, সমসাময়িকতার বিষয়ে , বাইবেলের চরিত্র চিত্রনে ওস্তাদ আঁকিয়ে হিসাবে সর্বকালের সেরা বলেই বিবেচিত । এখানেও রংয়ে আলোছায়ারই খেলা ।
শুরুতে ছবিটির নাম ছিলো “The Shooting Company of Frans Banning Cocq”
মনে করা হয় , ছবিটি আঁকা হয়েছিলো ডাচ ক্লোভেনিয়র্স বা সিভিক মিলিশিয়া গার্ডের ক্যাপ্টেন ব্যানিং ও তার সতের জন সদস্যদের ফরমায়েশে । কারন ছবিটির ব্যাকগ্রাউন্ডের ডানদিকে (এই পোষ্টের ছোট্ট ছবিতে ডিটেইলস হয়তো আপনারা খুঁজে না ও পেতে পারেন ) আঠারোজনের নাম একটি ফলকে লেখা আছে । আর সম্ভবত ড্রামবাদকটি এখানে বিনে পয়সায় ঢুকে পড়েছেন এক্কেবারে সামনের দিকে । সব মিলিয়ে ছবিটিতে ৩৪টি চরিত্র আছে । ছবিটি আঁকতে কত দিতে হয়েছিলো রেমব্রান্টকে ? ১৬০০ গিল্ডার্স । সে সময়ের অনেক টাকা ।
জন্মের পর থেকে প্রায় তিন’শো বছর ধরে ছবিটি ছিলো গাঢ় ভার্ণিসের আবরনে ঢাকা । মনে হতো যেন রাতের অন্ধকারে ঢেকে আছে সবকিছু । ধারনা , নৈশকালীন ছবিই বুঝি এঁকেছেন রেমব্রান্ট । তাই নামটি হয়েছে “ Night Watch” । আর এই “ভুল” নামটি নিয়েই তামাম দুনিয়া খ্যাত হয়ে আছে সে আজো ।
১৯৪০ সালে ভার্ণিস তুলে ফেললে ছবিটি আরো ঝকঝকে হয়ে ওঠে । আলোর খেলায় ভীড়ের ভেতর থেকেও শিল্পী তিনটি চরিত্রকে মূখ্য করে তুলেছেন দেখা যায় । মাঝখানের দু’জন, কালো পোষাক আর লাল রংয়ের উত্তরীয় নিয়ে ক্যাপ্টেন ব্যানিং আর হলুদ পোষাকে তার লেফটেন্যান্ট উইলিয়াম ভ্যান রুইতেনবার্চ । আছে একটি ছোট্টমেয়ে । ছবিতে মেয়েটির কাছে Arquebusiers বা রাইফেল এর পূর্বসুরী “মাজেল লোডেড” আগ্নেয়াস্ত্রের ঐতিহ্যগত প্রতীকটি এঁকেছেন খুব স্বাভাভিক ঢংয়ে । তার কোমরের বেল্টে গোঁজা মৃত মুরগীর নখটি আগ্নেয়াস্ত্রধারীদের প্রতিনিধিত্ব করছে যেন । এগুলো দিয়ে রেমব্রান্ট মেয়েটিকে যেন সিভিক মিলিশিয়ার একটি “মাসকট” হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছেন । সবকিছু মিলিয়ে শিল্পী তুলে ধরেছেন সেই মোক্ষম সময়টিকে, ঠিক যখোন ক্যাপ্টেন তার দলটিকে এগিয়ে যেতে নির্দেশ দিচ্ছেন অথচ এগিয়ে যাবার নির্দেশটি যেন তখোনও বাহিনীর সবার কাছে পৌছেনি , এমোন মূহুর্তের । এগিয়ে যাওয়া না যাওয়ার দোলাচলের এই প্রেক্ষিতটিই ছবিটির দিকে টানবে আপনাকে চুম্বকের মতো ।
ছবিটির কয়েকটি চরিত্র আপনারা বর্তমানের মূল ছবিটিতে দেখতে পাবেন না । কারন ছবিটির উপর হামলা হয়েছে কয়েকবার । প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে বেকার এক মূচি প্রতিবাদ স্বরূপ নিজ হাতের চাকু দিয়ে আর ১৯৭৫ সালে চাকুরীহারা এক স্কুল শিক্ষক রুটিকাটা চাকু দিয়ে ছবিটির অনেক জায়গা কেটে ফেলেছে । ক্ষতগুলো সারানো হলেও তার দাগ এখোনও দেখতে পাবেন আপনি । ১৯৯০ তে হয়েছে আরো ভীষন কান্ড । কে যেন একজন লুকিয়ে বোতলে আনা এসিড ছুঁড়ে মেরেছে ছবিটিতে । এছাড়াও ১৭১৫ সালে যখন ছবিটিকে আমস্টার্ডমের টাইন হলে স্থানান্তরিত করা হয় তখন ছবিটি যাতে সেখানের দু’টো কলামের ভেতর ঢুকে যেতে পারে তাই চারপাশ থেকে কেটে ফেলা হয় । উনিশ শতকের আগে ছবির উপর এই ভাবে ছুরি চালানো ছিলো অতি স্বাভাবিক একটি কাজ । এর ফলে বেশ কিছু ফিগারের সাথে একটি গার্ড রেইল আর সিড়ির ধাঁপ উধাও হয়ে যায় । এই দু’টির উপস্থিতি দিয়েই রেমব্রান্ট ছবিটিতে একটি “ফরোয়ার্ড মোশন” দিয়েছিলেন ।
“ক্লার্কফাইনআর্ট ডট কম” এই ছবিটি সম্পর্কে লিখেছে – “ one of the most important paintings of the whole history of Art, and with no doubt one of the most complex.”
“ ফ্লেমিং জুন” / ফ্রেডরিক লেইটন ।
ছবি - “ ফ্লেমিং জুন”
৪৭ ইঞ্চি বাই ৪৭ ইঞ্চি বর্গাকার ক্যানভাসে তেল রংয়ে আঁকা । শিল্পী স্যার ফ্রেডরিক লেইটন । এঁকেছেন ১৮৯৫ সালে । ভিক্টোরিয়ান যুগের ছবি তাই ভিক্টোরিয়ান একটি আমেজ আছে ছবিতে । “ ফ্লেমিং জুন” ছবিটি শিল্পীর “ম্যাগনাম অপাস” (মাস্টারপীস ) যা শিল্পীর ক্লাসিসিষ্ট বৈশিষ্টকেই তুলে ধরেছে । তার সময়ে তাকে তুলনা করা হতো মাইকেলেঞ্জোলোর সাথে । কারন যুক্তরাজ্যের এই শিল্পী সিদ্ধহস্ত ছিলেন মিথোলজিক্যাল বিষয় নিয়ে আঁকতে যেখানে ভাব, শারীরিক সৌন্দর্য্য আর রং নিয়ে সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছেন তিনি ।
সাদা চোখে, গাঢ় রংয়ের পোষাকে নিদ্রিতা এক নারীর ছবি মনে হবে এটাকে । আসলে কি তাই ?
বলা হয়ে থাকে, শিল্পী আসলে এই নারীর মাঝে ঘুমন্ত এক “নীম্ফ” (স্বর্গীয় আত্মা যা নিষ্পাপ কোমল তরুনীর রূপ ধরে প্রকৃতিকে উদ্দীপ্ত করে ) কে বুঝিয়েছেন । শায়িতার উপরে ডানদিকে বিষাক্ত ঔলিঅ্যান্ডার ( করবী )গাছের শাখা এঁকে শিল্পী নিদ্রা আর মৃত্যুর মাঝের ভঙ্গুর সংযোগের কথাই বলতে চেয়েছেন যেন ।
কে ছিলেন ছবির এই অনিন্দ্য সুন্দরী মডেল ? মডেল হিসাবে দু’জনার নাম করা হয় – ডরোথী ডীন এবং মেরী লয়েড এর । কারন সেই সময়কালে এরা দু’জনেই ইংল্যান্ডের “ প্রি-র্যাফালাইট ব্রাদারহুড” এর নামীদামী শিল্পীদের মডেল হিসেবে কাজ করেছেন ।
আপনি যদি নান্দনিকতাকে পছন্দ করেন তবে “ফ্লেমিং জুন” আপনাকে টানবেই । নিদ্রিতার অতিস্বচ্ছ পরিধেয়টি যা ঢেউয়ের আকারে লুটিয়ে আছে শরীরে, দারুন মুন্সীয়ানার সাথে শিল্পী এঁকেছেন সংবেদনশীল করে ।মনে হবে সত্যি, যেখানে যেমন ভাজটি পড়ার সেখানেই তা আছে । গোলাপের পাপড়ি যে ভাবে কুঞ্চিত হয়ে থাকে তেমনি অনিন্দ সুন্দর ভঙ্গীমায় ঘুম পাড়িয়েছেন তিনি মেয়েটিকে । একটি গোলাপফুল যেন । তার পরিধেয় থেকে বিচ্ছুরিত কমলা রংয়ের আভা ছড়িয়ে আছে তার হাতে আর চিবুকে । স্বচ্ছ আবরনের ভেতর থেকে তার কোমল দেহসৌষ্ঠবের কণককান্তি তুলে এনেছেন লেইটন পরম যত্নে । সব মিলিয়ে একটি স্বপ্নীল তন্দ্রালুতা যেন ঘিরে আছে ছবিটিতে, এমোনটাই মনে হবে আপনার ।
১৯৬০ সালে ছবিটি যখোন নিলামে ওঠে , সে সময়কালে ভিক্টোরিয়া যুগের ছবির তেমন কদর ছিলোনা । ছবিটির জন্যে নির্দ্ধারিত সর্বনিম্ন মূল্য মাত্র ১৪০ ডলার হলেও ক্রেতা মেলেনি তার । ১৯৬৩ সালে পুয়ের্টোরিকান ব্যবসায়ী এবং পঞ্চ মিউজিয়ম অব আর্টের প্রতিষ্ঠাতা এ্যান্টোনীয় লুইস ফেরী আমস্টারডামের এক গ্যালারীতে ছবিটিকে অবহেলায় পড়ে থাকতে দেখেন । ছবিটি দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে দশ হাযার ডলারে তা কিনে নেন । সেই থেকে ছবিটির স্থায়ী নিবাস হয়ে ওঠে পঞ্চ মিউজিয়ম অব আর্ট, পুয়ের্টোরিকো । এর পরেই ছবিটির মুগ্ধতার বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবী জুড়ে । বিখ্যাত বিখ্যাত গ্যালারীগুলি ছবিটি ধার করে নিয়ে প্রদর্শনীর আযোজন করতে থাকেন ।
আলোচনা –সমালোচনার ঝড় ওঠে । লন্ডনের “ইন্ডিপেন্ড্যান্ট” পত্রিকা তো বলেই বসলো, এটা একটা ট্রাভেল ব্রশিউয়্যার (ব্রোশিওর) । আপনি যদি বিলাসী হন আর গরমে আপনার আলস্য লাগে তবে খানিকটা উত্তেজিত হতে আপনি এটাকে দেখতে পারেন । তবে ভালো হতো যদি ছবিটির নীচে লেখা থাকতো- “ এই গরমে... সাইপ্রেসের স্বপ্ন” ।যদিও সমালোচক শেষে লিখেছেন – বক্তব্য যা ই থাক, একটি ছবি দেখার মতো হতেই পারে আঁকার গুনে... ।
আমিও বলি , ছবিটি আপনার শিল্প মনে না ও হতে পারে । এটা তেমন কিছু নয় । কারন একটি ইমেজ সত্যিকারের “শিল্প” হয়ে উঠলো কিনা তার বিচারে ব্যক্তিগত রুচির কিছু করার নেই । আপনি যদি
“মেঘনাদ বধ” কাব্যকে পছন্দ না করেন তো কার কি বলার আছে ?
তবে লেইটন তার সমালোচকদের চেয়ে ছবিতে কবিতা লিখতে যে ভালোই পারেন তার প্রমান “ফ্লেমিং জুন” ।
(পরের খন্ডে সমাপ্ত )