শেষ অধ্যায় / (শেষ অংশ)
নিঃসীম স্তব্ধতা ঘিরে আছে আমাদের । কি বলবো আমি সামনে বসে থাকা এই অগ্যস্তযাত্রার যাত্রীকে ! একবুক কান্নাময় ভালোবাসা উঠে আসতে চাইছে ভেতর থেকে । ভাসিয়ে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে নভেরাকে । জীবনের ঘুনপোকা যে বড় নির্মম । ক্ষয়িষ্ণু আয়ুর এই মেয়েটিকে কি দিয়ে আমি বিদায় জানাবো চিরজনমের জন্যে ! মুঠো ভরে কি দেবো আমি তাকে !
জানি ভালোবাসার কথা বলে ফুল ফোটানো খুবই সহজ । কিন্তু তা যে কি কঠিন এখোন বুঝি । কি সীমিত আমার ক্ষমতা, কি নাজুক আমার শব্দের ভান্ডার !
নভেরা কে সামলে উঠতে সময় দিই – ‘নভেরা তুমি আমার কঠিন এক দরজায় নাড়া দিয়েছো । তোমার ছবিটিতে আমি শীলাকেই ভেবেছি যা ভাবাই স্বাভাবিক । হ্যা আমি স্বীকার করি , তার প্রতি যে ভালোবাসা আমার তুমি দেখতে পেয়েছো, ছবিখানির ঐ মুখটিকেও আমি ততোখানি ভালোবেসেছি অদেখা শীলাকে ভেবেই । আমি দুহাতে সে মুখটি তুলে মনে মনে বলেছি, এ শুধু আমার । এবার তুমি বলো, সামনে এসে তুমি আমায় এ কোথায় দাঁড় করিয়ে দিলে ?
নভেরা চুপ । মাথা নত করে আছে এ মূহুর্তে । এক জনমানবহীন প্রান্তরে আমরা দুজন যেন বসে আছি । বাইরের পৃথিবী অস্তিত্বহীন হয়ে গেছে । দীর্ঘ পল্লবে ছাওয়া ওর গভীর চোখ মেলে নভেরা তাকালো এবার আমার দিকে ।
- বিশ্বাস করুন আপনাকে আমি নিতে আসিনি । যা আমার প্রাপ্য নয় তবুও আমার, এমোন না পাওয়া কিছু আপনার কাছ থেকে শুধু একমুঠো নিয়ে যাবো বলে এসেছি । আপনি শীলাকে বলেছেন, তোমার আঁচল পেতে রাখো দেখো তা ভরে ওঠে কিনা । আঁচল পেতে দিতে পারি এমোন সাহস আমার নেই । আমি শুধু একখানি হাত বাড়িয়ে দিতে পারি ।
তীব্র এক কষ্টে দম আটকে আসছে আমার । এই মৃত্যুপথ যাত্রীকে আমি ফেরাই কি করে শুন্য হাতে ! এখোন তো আমার হারাবার কিছুই নেই । আগেই যে তা আমি হারিয়ে বসে আছি । কিন্তু তার আগে আমার কথা যে বলে নিতে হবে । শীলা আর নভেরা এই দুটি পৃথিবী তো আমার কাছে একাকার হয়ে গেছে । কোনদিকে যাবো আমি, কোনখানে !
- নভেরা শোনো, এভাবে তোমাকে দেয়ার হয়তো আমার কিছুই নেই । একদম নেই তা ও বা কি করে বলি । শীলার সাথে তোমার সম্পর্ক কি আমি জানতে চাইনে । ওকে পাঠানো আমার সব লেখাই যখোন তুমি পড়েছো তাতে আর না জানলেও চলে । শীলাকে বলবে, আমি তাকে ফেরাতে পারিনি । তার সর্বনাশা পথ থেকে তাকে আমি ফেরাতে পারিনি । বলবে, আমি তাকে ছেড়েও যাইনি । পরস্ত্রী জেনেও তাকে শুদ্ধতম করতে চেয়েছি । প্রার্থনা করি, সে যেন শুদ্ধ হয়ে উঠতে পারে । আর ...আর...
কথারা থেমে যায় । আবার নিরবতা নামে আঁধারের মতো । আশেপাশের উৎসুক দৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করে আমরা দুজন বসে থাকি চুপচাপ । ভেতরের কোথাও ঘন্টা বেজে ওঠে বিদায়ের । এ বিদায় আমার নিজের গড়ে তোলা ভুবন থেকে নিজের । বড় কষ্টের ।
নিরবতা ভাঙ্গি, আবার তরল করতে চাই ভারী বাতাস – ‘ নভেরা কি খাবে বলো ? কি ভালোবাসো তুমি ?’
নড়ে ওঠে নভেরা । খানিকটা সহজ হয়ে ওঠে ।
- না , আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করছেনা । শুধু কফি খেতে পারি ।
কফি আসে । নভেরা নিজে এককাপ বানিয়ে এগিয়ে দেয় আমাকে, তারপর নিজে । হাত ছুঁয়ে যায় হাত । চকিতে ওর দিকে তাকাই । এতোক্ষন ভুলে ছিলাম , এবার মনে পড়ে ।
- নভেরা তুমি আমাকে ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছিলে । দেখো । আমি তোমারই মতোন এক মানুষ । আর তোমাকে শেষের কবিতা থেকে ক’টা লাইন শোনাই – “যে আমারে দেখিবারে পায়
অসীম ক্ষমায়
ভালোমন্দ মিলায়ে সকলি,
এবার পূজায় তারি আপনারে দিতে চাই বলি ।”
বুঝতে পেরেছো ?
মাথা নাড়ে নভেরা - ‘আপনি অদ্ভুত এক মানুষ । এতো এতো ভালোবাসা আপনি কোথায় পেলেন ? শীলাকে আমার হিংসে হচ্ছে না । ওর জন্যে আমার করুনা হচ্ছে । ওর ....
নভেরার মুখের কথা কেড়ে নিই – শীলার কথা থাক , তোমার কথা বলো । ঔষধ খাচ্ছো নিয়মিত ? শোনো নভেরা, তুমি মিষ্টি একটি মেয়ে । নিজেকে কষ্ট দেবেনা অযথা ভেবে ভেবে । বাড়ীতে তোমার কে কে আছেন ? এসো তোমার গল্প শুনি ।’
গল্পে মেতে উঠি দু’জনে। নভেরা তার গল্প বলে যায় । শীলার প্রসঙ্গও আসে । শীলা কবীরের নামটির আধেকটা যে ওর তাও জেনে যাই । সুশান্ত নামের এক ছেলের কথাও বলে যায় অবলীলায় । আমিও আমার কথা বলি অকপটে । কখোনও তার হাসির বাঁধ ভেঙ্গে যায়, কখোনও গলাটা ধরে আসে । গল্প শুনতে শুনতে অনেকটা সময় আমি ওর হাত ধরে থাকি । ওর দু’চোখে যেন গোধুলীর রঙ জোনাকীর মতো জ্বলে নেভে । আমি আর কি দিতে পারি ওকে ! এর চেয়ে বেশী আর নৈবেদ্যের কি আছে আমার ঘরে ! আমি ওকে উষ্ণতা দিতে পারি, ভালোবাসা দিতে পারি, মমতা দিতে পারি, বন্ধুত্ব দিতে পারি কিন্তু বুকে তুলে নিতে পারিনা ।
কথারা নিভে আসে এক এক করে । এবার ! নভেরা চলে যাবে । আমার আর কি কিছু বলা উচিৎ ! না বললে যে এক খসে পড়া তারা কারো বুকে আছড়ে পড়ার অনেক আগেই পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে । মিলনের ইচ্ছেতেই তো খসে এসেছে সে এতোদুরে সাহস করে ... বলি – ‘ নভেরা তোমার জন্যে আমি প্রার্থনা করবো প্রতিদিন । আমি বন্ধু হয়ে থাকলাম তোমার । ইচ্ছে হলে আমাকে ডেকো , পাবে ।’
-আমি আসবো, ওপারের পথে পৌছে গিয়ে আবার আমি ফিরে আসবো । আপনার কাছে । আমাকে যে আসতেই হবে । আপনি আমাকে যেমন করে আপনার চোখে ধরে রেখেছেন আমি না এলে তা যে মুছে যাবে । আপনাকে ঘিরে থাকবো আমি, জানবেন আমি হারিয়ে যাইনি । এইটুকু আপনাকে দিতে চাই ভালোবেসে । আমার তো হারানোর কিছু নেই ।
ঝরা পাতার মতো উড়ে গিয়ে দিগন্তে বিলীন হওয়ার অপেক্ষায় রত এই মুখখানি এই মূহুর্তে আমার কাছে অনিন্দ্য সুখের কষ্ট হয়ে বুকে আটকে থাকলো । হাত বাড়িয়ে তুলে ধরতে ইচ্ছে করলো সে মুখখানা । শুধু বললাম,’ নভেরা, বলেছি তোমাকে দেয়ার মতো আমার কিছু থাকবেই বা না কেন । আমি তোমাকে আমার আয়ুষ্কাল দিলাম । আমি নিজেই তো এক পড়ন্ত বেলায় দাঁড়িয়ে । আমার থেকে নিয়ে, বিধাতা বলে যদি কেউ থাকেন, তিনি যেন তোমাকে আরো একটু বেশী আয়ুষ্মতি করেন । আর.....
আমার ঠোটে আঙ্গুল রেখে আমার না বলা কথা আটকে দিলো নভেরা –‘ চুপ, কথা বলবেনা ।’
এতোক্ষন ঘটনার আকস্মিকতা আর বিহ্বলতায় টেবিলে চুপচাপ পড়ে থাকা রজনীগন্ধার গোছা তুলে নিয়ে এবার আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো নভেরা – ‘আমি জানি তুমি রজনীগন্ধা ভালোবাসো । তাই তোমার জন্যে । শুধু মনে রেখ, আমিও ছিলাম ।’
অবাক হয়ে ওর চোখে চোখ রাখি । সে চোখে যেন কি খেলা করে যায় ।
-‘ভাবছো, তোমাকে তুমি বলার অনুমতি আমাকে কে দিলো । সে অনুমতি আমি দেখে নিয়েছি যে তোমার চোখে ।’
যে সুখ আমার হয়তো জোটেনি কখোনও, তেমন একটা সুখের নদী বহতা হয়ে গেল মনের কোথাও তিরতির করে । তবুও মুখ ফুটে বলতে পারা গেলোনা –‘ নভেরা আমি তোমাকে ভালোবাসি যেমন ভালোবাসি আমি শীলাকেও । কাকে বেশী এ প্রশ্ন তুলোনা । এর উত্তর আমার জানা নেই ।’
নভেরার চোখ ভিজে ভিজে হয়ে উঠতে চাইছে । ততক্ষনে আমার ঠোট থেকে আঙ্গুল সরিয়ে নিয়েছে নভেরা ।
উঠলো । আমি ওর হাত ধরলাম – ‘আবার এসো ।’
আমার হাতের উপর তার একটি হাত রেখে ফিসফিস করে বললো –‘ আমি আর আসবোনা কোনওদিন । কিছু দেয়া হলো কিনা জানিনে । আমি শুধু নিয়ে গেলাম । সুদুরের পথ পাড়ি দিতে এ আমার পাথেয় হয়ে থাকুক । অন্ধকারে আমার জোনাকির আলো । বিদায় ।’
নভেরা চলে গেলো । একবারও পিছু ফিরে দেখলোনা । আমি দেখলাম, কাঁচের সুইংডোরের ওধারে তার অপসৃয়মান ছায়া দুর থেকে দুরে মিলিয়ে গেল ।
এবার ! এক প্রহরের জন্যে একটা অধরা সুখ না চাইতেই আমার কাছে এসেছিলো । এই-ই প্রথম, এই-ই শেষ । একটা স্বপ্নের মতো । চলে গেলো ।
রূঢ় বাস্তব এবার সামনে । মানুষের ভীড়ে বিলি কেটে কেটে আবার সেই ঘরে ফেরা । নিজের ঘেরাটোপে – একাকী ।
এতোক্ষন আমার এই উপন্যাসিকাটি লিখছিলাম আমি । শীলার জন্যে লিখছিলাম । পৃথিবী খুব মন দিয়ে শুনছিলো আমার এই কাহিনী কিন্তু কাহিনী বলতে বলতে আমিই যে ঘুমিয়ে পড়লাম আজ ।
কথা দিয়েছিলাম আমার এই উপন্যাসিকাটি শীলার নামে উৎসর্গ করবো । উৎসর্গ পত্রও ঠিক করা ছিলো মনে মনে -
“ একজন শীলা কবিরের জন্যে যে আমার সাথে অবলীলায় মিথ্যেই বলে গেছে । যাকে আমি দেখিনি কখোনও অথচ এ জীবনে তার দেখা পাবো এমোনটিও মনে হয়না । ঠিকানাও জানিনে, তবুও তাকেই ।”
এখোন ঘুম থেকে জেগে দেখি আর একটি মুখ । আমার কি তাকেই এটা উৎসর্গ করা উচিৎ -
“ একজন নভেরা কবিরকে, অস্তাচলের পথে যেতে যেতে একবার পিছে ফিরে যেন সে দেখে যেতে পারে, একদিন সোনালী রোদ্দুর হয়ে ফুঁটে ছিলো সে ।”
আপনারা কি বলে দেবেন কার নামে এই বইটি আমি উৎসর্গ করবো ? যদি অনুগ্রহ করে আমাকে জানান তবে কৃতজ্ঞ থাকবো ।
আগেরটুকু - এক ( প্রথম অংশ )
এক ( দ্বিতীয় অংশ )
এক ( তৃতীয় অংশ )
এক ( শেষ অংক )
দুই ( প্রথম অংশ )
দুই ( দ্বিতীয় অংশ )
তিন ( প্রথম অংশ )
তিন ( দ্বিতীয় অংশ )
তিন ( শেষ অংশ )
চার ( প্রথম অংশ )
চার ( দ্বিতীয় অংশ )
চার ( শেষ অংশ )
পাঁচ ( প্রথম অংশ )
পাঁচ ( শেষ অংশ )
ছয় ( প্রথম অংশ )
ছয় ( শেষ অংক )
সাত ( প্রথম অংশ )
সাত ( দ্বিতীয় অংশ )
সাত ( শেষ অংশ )
আট ( প্রথম অংশ )
আট ( দ্বিতীয় অংশ )
আট ( শেষ অংশ )
শেষ অধ্যায় ( প্রথম অংশ )
শেষ অধ্যায় ( দ্বিতীয় অংশ )
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মার্চ, ২০২১ রাত ১২:৫১