আজকে একটি সহজ শব্দ ক্লাস (Class)। পুরো নাম ক্লাসিফিকেশন সোসাইটি (Classification Society)। এটি জাহাজের কোন অংশের নাম নয় বরং জাহাজ সংশ্লিস্ট একটি পক্ষের নাম। জাহাজ তৈরি ও পরিচালনার জন্য জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠান আই এম ও (IMO - International Maritime Organization) এর কিছু নির্ধারিত নিয়ম কানুন আছে। আর্ন্তজাতিক রুটে চলাচল কারি সকল জাহাজের জন্য ঐ নিয়ম কানুন পালন বাধ্যতামুলক। কিন্তু এই নিয়ম কানুনের সাথে সাথে জাহাজ তৈরি ও পরিচালনার জন্য একটি স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারন এবং এই স্ট্যান্ডার্ড বজায় রাখার জন্য আরো কিছু নিয়ম কানুন অনুসরন করতে হয়। যে সকল প্রতিষ্ঠান এ কাজ করে তাদের বলা হয় ক্লাস বা ক্লাসিফিকেশন সোসাইটি। আর এ নিয়ম কানুন অনুসরন হচ্ছে কিনা তা ঐ ক্লাসিফিকেশন সোসাইটি সমুহের শিপ সার্ভেয়ার বা শিপ ইন্সপেক্টররা করে থাকে। এটি জাহাজের ইন্স্যুরেন্স এর প্রিমিয়াম নির্ধারনে প্রধান ভুমিকা পালন করে। কোনো জাহাজ ক্লাস না হলে কোন ইন্সুরেন্স হবে না, আবার কোনো ইন্সুরেন্স না হলে কোন ব্যাপারী জাহাজে কার্গো নিবে না। অনেক কঠিন মনে হচ্ছে ব্যাপারটা, আসুন একটা গল্পে পুরো ব্যাপারটা জেনে নেই। তাহলে হয়ত আপনি এই ব্যাপারটা কিছুটা অনুমান করতে পারবেন।
গল্প মনে হলেও পরোটাই কিন্তু সত্যি এবং এই গল্পটাই ক্লাসিফিকেশন সোসাইটির গঠনের সংক্ষিপ্ত এবং একমাত্র ইতিহাস।
আনুমানিক ১৬৮৭-৮৮ সালের দিকে লন্ডনের টাওয়ার স্ট্রীটে এডওয়ার্ড লয়েড নামে ৪০ বছরের একজন যুবক (!! তাকে যুবক না বল্লে আমরা সবাই বুড়ো) তার নিজ নামে লয়েড কফি হাউজ একটি কফি সপ খোলেন। (কফি সপ খোলার আগে তার পেশা বা জীবন সম্পর্কে কোন ইতিহাস জানা যায় নি।) যা তখনকার আমলে ঐ এলাকায় প্রথম কফির দোকান। ফলে খুব সহজেই তিনি ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষনে সক্ষম হলেন। ৩/৪ বছরের মধ্যে তার ব্যবসার খুবই জমজমাট অবস্থা। তিনি আর্শ্চয্য হয়ে লক্ষ্য করলেন, তার এখানে আসা খরিদ দারদের মধ্যে একটি বিশাল অংশই জাহাজের নাবিক, জাহাজ মালিক এবং কোন না কোন ভাবে জাহাজের সাথে সংশ্লিস্ট। মোটামুটি জাহাজের সাথে জীবন জীবিকায় যুক্ত এমন মানুষদের মিলন মেলা। তিনি আরো লক্ষ্য করলেন, নাবিকরা কফি পানের সাথে সাথে তাদের সমুদ্র যাত্রার নানা বিষয় নিয়ে যেমন আলোচনা করছে, তেমনি তার সমাধানের ও পথ খুজছে। আবার জাহাজ মালিকরা বা পন্যের ব্যাপারিরা তাদের ব্যাবসা নিয়ে আলোচনা করছে। একসময় তিনি বুঝলেন তিনি তার কফি সপ ব্যাবসায় মনযোগ দিতে পারছেন না, কারন ঐ সকল গল্প গুলি তাকে চুম্বকের মত টানছে। তখন তিনি তার মেয়ে জামাইকে কফি সপে বসিয়ে ঐ সকল গল্প শুনতে লেগে গেলেন।
এর মাঝেই ঘটে গেল এক অদ্ভুত ঘটনা। একদিন এক জাহাজের নাবিক কফি সপে আসলেন তার সমুদ্র যাত্রায় ঘটে যাওয়া কিছু সমস্যার সমাধানে। অনেকের সাথে আলোচনা করেও ঐ সমস্যার কোন সমাধান না পেলেন না। লোকটি চলে যাওয়ার প্রাক্কালে লয়েড বল্লেন, যদি কিছু মনে না করেন, আপনার সমস্যার সমাধান হয়ত আমি দিতে পারব, আর সমাধানটি মনে হয় এ রকম। নাবিক তো ভীষন অবাক হলেন। লয়েড তখন বল্লেন কিছুদিন পুর্বে আসা একজন নাবিকের কাছে তিনি এমন একটি সমস্যার প্রায় এমন একটি সমাধানের গল্প শুনেছেন। নাবিক প্রথমে বিশ্বাস না করলেও পুর্ববর্তী নাবিকের গল্প শুনে তিনি চেষ্ঠা করে দেখবেন বলে চলে গেলেন। এর কিছুদিন পর ঐ নাবিক আবার যখন কফি সপে আসলেন, এবার কোন সমস্যার সমাধানের জন্য নয়, বরং লয়েড কে ধন্যবাদ জানানোর জন্য এবং সবাইকে এ খবর টা দেওয়ার জন্য যে লয়েড তাকে এমন একটি তাক লাগানো সমাধান দিয়েছে, ফলে এবারের যাত্রা কোন সমস্যা ছাড়াই শেষ করতে পেরেছে। সাথে লয়েডের জন্য নিয়ে আসেন অনেক উপহার সামগ্রী। এভাবে লয়েড হয়ে উঠেন লয়েড কফি হাউজের সকল আলোচনার প্রান ভোমরা, লয়েড হয়ে উঠেন জাহাজের সমস্যা সমাধানের এক বিশ্বস্থ নাম। লয়েডের তখন আগ্রহ আরো বেড়ে যায়। যেহেতু তিনি প্রতিদিনই নতুন নতুন গল্প শুনছেন, তাই তিনি এগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখতে শুরু করেন।
এভাবে চলতে চলতে ঘটে যায় আরেকটি অন্যরকম ঘটনা। লয়েড একজন নাবিক কে তার সমস্যর সমাধান দিলেন, লোকটি খুশি মনে চলে গেল, কিন্তু সে ফিরে এসে জানাল এই সমাধানটি তার জন্য অনেক ক্ষতি হয়ে গেল। এর পরই লয়েড ভাবলেন, এর পর থেকে কেউ কোন সমস্যা নিয়ে এলে তিনি প্রথমে সমস্যা শুনে, উনার কাছে থাকা গল্প গুলি পড়ে জাহাজে যাবেন এবং জাহাজে প্রকৃত ঘটনা দেখে তিনি সমস্যার সমাধান দিবেন। আর এ ভাবে কাজে তিনি পেলেন অসাধারন সাফল্য। আর লয়েড একজন কফি বিক্রেতা থেকে হয়ে গেলেন মানব ইতিহাসের প্রথম প্রফেশনাল শিপ সার্ভেয়ার বা শিপ ইন্সপেক্টর। এর পর তিনি আরো গোছালো ভাবে এগুনোর পরিকল্পনা করলেন। তিনি যে সকল জাহাজ পরিদর্শন করেছেন সে জাহাজ গুলির সম্পর্কে প্রাপ্ত সকল তথ্য, সমস্যা, সমাধান সহ লিপিবদ্ধ করা শুরু করলেন এবং নিজে থেকে ঐ জাহাজের জন্য একটি স্ট্যান্ডার্ড বা গুনগত মান (A, E, I, O, U........) একটি রেজিস্টারে লিখে রাখতে শুরু করলেন।
এভাবে কাজ করে তিনি অসাধারন সাফল্য পেলেন। তার এই গল্প শুনার আগ্রহ তাকে এই ব্যবসার সকল দিকের জ্ঞানকে আহরনে সাহায্য করেছে, তিনি হয়ে উঠলেন জাহাজের ইন্সপেকশন ব্যবসায় এক মহিরুহ এবং অল্প দিনের মধ্যে তিনি লন্ডনের অন্যতম ধনী ব্যাক্তিতে পরিনত হলেন। তার এ কাজ কে আরো এগিয়ে নিতে তিনি তার সম্পদের প্রায় সমস্ত অংশ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন লয়েড ফাউন্ডেশন (যা ছিল সম্পুর্ন অলাভজনক প্রতিষ্ঠান মানে লভ্যাংশ শুধু এ সম্পর্কিত কাজের উপর গবেষনা ও প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে ব্যয় করা যাবে।) এই লয়েড ফাউন্ডেশন থেকে অল্প কিছু দিনের ভিতর তিনি বের করলেন সংবাদ পত্র লয়েড নিউজ, যা প্রধানত লন্ডন ও আশেপাশের বন্দরে আগমন ও প্রস্থানকারী জাহাজের তালিকা, তাদের মালপত্রের নাম ও পরিমান ইত্যাদি মানে শুধু জাহাজের খবর। আর তার রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ জাহাজ গুলোর জন্য তিনি চালু করেন লয়েড ইন্সুরেন্স। যার স্ট্যান্ডার্ড বা গুনগত মান যত ভালো তার ইন্সুরেন্স প্রমিয়াম তত কম।
১৭১৩ সালে এই গুনি মানুষটি মৃত্যু বরন করলেন বটে কিন্তু সারা পৃথিবির জন্য রেখে গেলেন এক অনুকরনীয় দৃষ্টান্ত। তার মৃত্যুর পর লয়েড ফাউন্ডেশনে অভিজ্ঞ নাবিক দের নিয়োগ দেয়া হলো শিপ সার্ভেয়ার বা শিপ ইন্সপেক্টর হিসাবে যারা লয়েডের জ্ঞান ও কাজ কে আরো এগিয়ে নিয়ে যাবেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৭৩৪ সালে লয়েড নিউজ নাম পাল্টে লয়েড লিস্ট করা হয়। এবং এখনো এটি এই নামেই প্রকাশিত হচ্ছে। লয়েড ইন্সুরেন্স এখনো স্বনামে চালু আছে। ১৭৭৬ সালে লয়েড ফাউন্ডেশন তার অংগ প্রতিস্ঠান লয়েডস রেজিস্টার চালু করে, যারা শুধু জাহাজ তৈরি ও পরিচালনার উপর নিয়ম কানুন তৈরি ও তা তদারকি করবে। লয়েডস রেজিস্টার নামক এই প্রতিষ্ঠানকেই বলে ক্লাস (Class) বা ক্লাসিফিকেশন সোসাইটি (Classification Society)।
ইংল্যান্ডে এই লয়েডের সাফল্যের পর আস্তে আস্তে পৃথিবীর নানা প্রান্তে গড়ে উঠে লয়েডস রেজিস্টার এর মত আরো অনেক প্রতিস্ঠান ব্যুরো ভ্যারিটাস (ফ্রান্স ১৮২৮), আমেরিকান ব্যুরো অব শিপিং (আমেরিকা ১৮৬২), ডেট নরকস ভ্যারিটাস (নরওয়ে,১৮৬৪), জার্মানিসার লয়েড (জার্মানী, ১৮৬৭) ইত্যাদি। বর্তমানে পৃথিবীতে এমন সংস্থার সংখ্যা প্রায় ৫০। এশিয়াতে এমন সংস্থা শুধু জাপান, কোরিয়া, চীন, ভারতের আছে।
লয়েডের এই কাহিনী নিয়ে একটি ছোট প্রামন্য চিত্র দেখুন ই্উ টিউব এ
লয়েডের বর্তমান অবস্থা জানতে এই ই্উটিউব ভিডিওটি দেখুন
ভালো লাগলে জানাবেন
যারা অন্য পর্ব গুলি মিস করছেন তাদের জন্য লিংক এখানে। here
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মার্চ, ২০১৪ সকাল ৯:২১