১
হয়, মাঝে মাঝে এমন হয়। মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক চোখ আর নিঃসাড় মস্তিষ্ক দল বেঁধে ছুটে যায় ভ্রান্ত সময় ভ্রমণে।
যেমনটা হয়েছিল সেদিন। আমি আর আজহার পলাশীতে নৈশব্দের সুতো বিমর্ষতায় পুড়ে সন্ধ্যাটুকু সেলাই করছিলাম। অনেকক্ষণ পর নেমে এল চাঁদ, নাগরিক নির্জনতার মাঝে। আজহার বলল – 'ভাপাপিঠা খাবি ?? এইখানে এক খালা আছে, খুব ভাল বানায়।'
আমরা গেলাম। আটপৌরে নীল শাড়ির মাঝ থেকে বেরিয়ে এল একটা কোমল হাত, সেখানে দুটো চুড়ির ধাক্কা, রিনিঝিনি শব্দের মাঝ দিয়ে আমাদের সামনে তুলে ধরলো তার সৃষ্ট দুটো পিঠা। আমি পিঠার দিকে তাকাই, মনে হয় যেন ঐ চাঁদের একটা মিনিয়েচার হাতে ধরে থাকি। শুভ্র-শুক্ল, সেখানে কলংকের মত লেপ্টে আছে খেজুরের গুড়। খালা আজহারের দিকে নিশানা করে জোছনা মাখানো হাওয়ায় ভাসিয়ে দেয় একটা প্রশ্নবোধক – ‘ভালা আছেন ভাই ??’ আজহার দায়সারারকমভাবে মাথাটা নাড়িয়ে পালটা একটা প্রশ্নবোধক ছোড়ে – ‘আচ্ছা খালা, দ্যাখো, আমি তোমার এইখানে পিঠা খাই কতদিন হল। অথচ, আমরা নিজেদের নামটাই জানিনা এখনো। আমার নাম আজহার, তোমার নাম কী ??’
সাথে সাথে কোন এক অলীক স্পর্শ অনুভূত হয় তার। একটা নিশ্চিন্ত কেন্নো হঠাৎ স্পর্শ পেলে যেমন, তেমনিভাবে শরীর গুটিয়ে নেয়। লজ্জাবতী পাতার মত শাড়ির ঘোমটার মাঝে গুটিয়ে নেয় মুখ, সেই লজ্জাবতীর ফুল হয়ে নির্লজ্জ ফুটতে থাকে পিঠাগুলি। খালা লজ্জা পায়, সে যে কী ব্রীড়া, সে যে কী সংকোচ !! যেন নাম তার এক গোপন অপরাধ। লজ্জাবতী বলে- ‘বলাই লাগবো ??’ আজহার বলে – ‘না, তা না, ইচ্ছা না হইলে কওনের দরকার নাই।‘ আচল টেনে, ঘোমটা টাকে আরেকটু লম্বা করে খালা জবাব দেয় – ফুলজান। যেমন করে নববিবাহিতা বাসর ঘরে স্বামীর প্রশ্নে জবাব দেন।
তখনই আমি তার ব্রীড়ার উৎস খুঁজে পাই, শহুরে যান্ত্রিকতায় সেকেলে নামটা বয়ে বেড়ানোই তার লজ্জা। এই নামটা ধরে সম্ভবত কেউ তাকে ডাকে না আর, সম্ভবত কোন পলাশ কিংবা বকুলের মা – এইটুকুই তার পরিচয়। তবে কেউ নিশ্চয়ই ডাকতো, আদর করে ডাকতো। গোল্লাছুট খেলার মত নামটাও তার ছুটে পালিয়ে গেছে জীবন থেকে।
আর, ঠিক সেই সময় ঐ যে বলেছি মাঝে মাঝে ভ্রান্ত সময় ভ্রমণে চলে যাই। আমি ডুবে গেলাম, ফুঁড়ে গেলাম অজস্র সময়।
২
যেন ফুলজান আমার বধূ, কৈশোর কে বিদায় জানাতে অপ্রতিভ এক পল্লি তরুণী। শিশুদের আঁকা ছবিতে যেমন দেখা যায়, একটা নদীর পাশে একটা কেবল কুঁড়েঘর দাঁড়িয়ে, ঠিক সেইরকম একটা কুঁড়েঘরে আমাদের বাস। আহ, ফুলজান, আমার ফুল, আমার জান। ফুলজান ঘরে থাকে, আমি কিষাণ মাঠে আলের মাঝে, আগাছার ফাঁকে ঘরে ফেরার আকাংখাটা লুকিয়ে রাখি। ধানের মাঝে গেঁথে দেই সোনালী স্বপ্ন। ফুলজানের কোলে আসবে নতুন কিষাণ। শাড়ির ভাঁজে লেপ্টে থাকবে, আচলে মুখ লুকাবে। উঠানে হামাগুড়ি খাবে দিনভর।
মনে হয়, যেন আমি আর ফুলজান ছাড়া পৃথিবীতে কেউ নেই আর। আমি আদম, ফুলজান আমার হাওয়া। আমাদের চারপাশে বাতাসে ভেসে বেড়ায় রঙ, লাল-নীল-হলুদ সবরকম। আমি সেই রঙ দেখে, দেখতে দেখতে বাঁশি বাজাই, বাঁশির সুরে আমার শব্দ খেলা করে। দুপুরবেলা বটগাছটার নিচে বসে ছায়ায়; আর ফুলজান বসে বসে ঘাসে হাত বুলায়, আঙ্গুলের মাঝে সবুজ মাখে। ফুলজানের অনাবৃত শরীরএর চামড়া একটু কুঁচকে গেলে তার নিচে খেলা করে আমাদের শিশু।
এরই ফাঁকে কখনো পাখিরা শিষ দিয়ে ওঠে, উদাস করা। সেই শিষ সীসার বুলেটের মত আমাদের কানে এসে লাগে। আমরা ব্যথা পেয়ে ছোট্ট একটা ধ্বনি তুলে হাসাহাসি শুরু করি। সেই হাসির সাথে অল্প একটু পানি মিশিয়ে ফুলজান আমাদের উঠান লেপে। তাই, আমাদের উঠানে হাসিগুলো ফুটে থাকে সবসময়। আমাদের ছাদে মেঘ ভাসে নিরন্তর, সেই মেঘের ছায়াগুলো, মায়াগুলো ঝড়ে পড়ে আমাদের খড়ের চালে।
আমাদের আপন নদীতে মাঝে মাঝে একটা দুইটা নৌকা চলে, হেরে গলায় গান গাইতে গাইতে মাঝিরা, তাদের আরোহীরা সরে যায়। তাদের গান মিশে যায় নদীর মন্থর ঢেউয়ে। সেই ঢেউ আচড়ে পড়ে আমাদের উঠানে, আমাদের হাসির সাথে মিশে নতুন রঙ এর জন্ম দেয়।
আবার, মাঝে মাঝে আমি আর ফুলজান শরত বিকালে নৌকায় চেপে বেড়াতে যাই নদীর অন্য ঢেউয়ে। তখন আমি নূহ, আমার নৌকার সওয়ার শুধু ফুলজান। সবাইকে ফেলে রেখে আমরা নৌকায় চাপি নতুন পৃথিবীর দিকে।
আঁধার নামলে ফুলজান হারিকেন কিংবা মোমবাতি নিয়ে আসে। সেউ আলো ফুলজানের মুখে পিছলে যায়। মুখে একটা লাজুক হাসি খেলে। চোখের পাপড়িতে বোনা সুখের নীড়। খেতে বসলে ফুলজানের থালা থেকে উড়ে আসা গরম ভাতের ভাঁপ এর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি, আনন্দগুলো কি সুন্দর ভেসে বেড়াচ্ছে কুয়াশার মত।
আবার, কোন কোন রাতে আমরা একসাথে গান গাই, নাচি, আমাদের ঠোঁটগুলো আরেকজনের ঠোঁট ছুঁয়ে ফেলে।
কিংবা, কোন কোন রাতে ফুলজানের চুলোর পাশে বসে আগুন পোহানোর ফাঁকে ফুলজান বাড়িয়ে দেয় একটা ভাপাপিঠা।
মাটির চুলোয় আগুন ধাক্কা খেয়ে ফুলজানের মুখে আছড়ে পড়ে; সেখানে লজ্জা।
৩
ফুলজানের ডাক শুনে সম্বিত ফেরে, ‘ কি ব্যাপার ভাইজান, খাইবেন না পিঠা?? ঠান্ডা হইয়া যাইবো তো !!’
কতক্ষণ চলে গেলো মধ্যে ?? কতক্ষণ ধরে আমি দাঁড়িয়ে?? বুঝতে পারি না। আনমনে পিঠা খেতে খেতে আমার মনে প্রশ্ন জাগে, আদম কি কবিতা লিখতো ?? হাওয়ার দিকে তাকিয়ে কি তার একবারও কবিতা লিখতে ইচ্ছা করেনি ??
আমি ফুলজানের দিকে হতবিহ্বল চাহনি দেই একটা। আর কী আশ্চর্য !! ফুলজানের চোখে সেই লজ্জাটাই লেপ্টে আছে এখনো।