১
এবং ঠিক সেইদিনই, ১৯৯৮ সালের ১৯ শে জুলাই দুপুরের প্রায় শেষভাগে যেখানে দুপুর আর বিকাল অলস সূর্যটার দিকে হাত ধরাধরি করে একইসাথে তাকিয়ে থেকে খুব উদাস, সেই সময়ে গোটা চারেক যুবক; নিজেদেরকে যারা ছন্নছাড়া হিসেবে পরিচয় দিতে ভালবাসতো, তারা সাহেববাজারের তুমুল গরম কয়েকটি পুড়ি খাওয়ার পর অদূরে হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকা পদ্মার গান শুনে বিমোহিত হয়। ছন্নছাড়া যুবকগোষ্ঠী, তাদের আবার কাপড় !! তাদের আবার ভূষণ !! জিন্সের প্যান্ট পদ্মার জলে ভিজে শুদ্ধ হয়ে যাক, ভেজা শরীরে জ্বর হোক ছন্নছাড়াদের কিছু যায় আসে না। তারা ধূলোরঙ্গা পদ্মার ধূলোতে ভিজতে চায়, তারা ধূলোরঙ্গা পদ্মার ধূলোতে ভিজতে যায়।
এবং ঠিক সেইদিনই, ১৯৯৮ সালের ১৯ শে জুলাই দুপুরের প্রায় শেষভাগে পদ্মার কোন এক আজব মাতলামী চাপে, কোন স্নেহে সে রাসেলকে আপন করে নেয়ার দুঃসাহস দেখায়, নাক চেপে ডুব দেয়ার প্রতিযোগিতা শেষে রাসেলের এক দুর্বল শুকিয়ে আসা শুষ্ক কন্ঠ শোনা যায় – “আজহার, আমি ডুবে যাচ্ছি আজহার।” সেই বার্তা শুনে তড়িৎগতিতে পার থেকে ছুটে আসে ছন্নছাড়াদের মাঝে একমাত্র সাঁতার জানা যুবক, আজহার; রাসেল ডুবে যাচ্ছে আজহার, আজহার তুমি তাকে বাঁচাও। আজহারের হৃৎপিণ্ড শুধু কাঁপে। কিন্তু, পদ্মা, সে এক গোঁয়ার পিশাচ, শ্রাবণ মাসের ছাইরঙ্গা মেঘ উড়ে যায় দুর্বার গতিতে, শিরিশির করা বাতাস ভেসে যায়। মহাবিশ্বের কাল হিসেবে হয়তো খুব বেশি না, কিন্তু কিছুকাল, যেই কিছুকাল কিছু মানুষের জন্য পুরো জীবন, সেই কিছুকাল পদ্মার সাথে যুদ্ধ করার পর, দুটো শরীরকে সোঁদা মাটি পর্যন্ত নিয়ে যাবার জন্য তুমুল পরিশ্রম করার পর রাসেল এবং আজহারের বাঁধন শিথিল হয়ে আসে।
এবং ঠিক সেইদিনই, ১৯৯৮ সালের ১৯ শে জুলাই দুপুরের প্রায় শেষভাগে যেখানে দুপুর আর বিকাল অলস সূর্যটার দিকে একইসাথে তাকিয়ে থেকে খুব উদাস, পাগলা ঘোড়া উড়তে থাকা ছাইরঙ্গা মেঘেদের সাক্ষী রেখে রাসেল মারা যায়।
২
চেনাজানা সকলেই বোঝে যে - রাসেলের মৃত্যুর ঠিক পরেই আজহারের প্রচন্ড জ্বরে পরা, ১০৪ এর নিচে নামতেই চায়না এমন আগুন জ্বরে , ব্যাপারটা মোটেও কাকতালীয় ছিল না। সেই জ্বরের মাঝে আজহারের শুধু রাসেলের কথা মনে পড়ে – ““আজহার, আমি ডুবে যাচ্ছি আজহার।” জ্বরের ঘোরে আজহার চিৎকার করে, প্রলাপ হতে পারে, বিলাপ হতে পারে, অশরীরি অলীকের সাথে কোন সংলাপও হতে পারে, আজহার এর মুখে শুধু একটাই বাক্য – ““আজহার, আমি ডুবে যাচ্ছি আজহার।”
সেই ছাইরঙ্গা মেঘেরা সরে যায়, আধখাওয়া চাঁদটা বুমেরাং এর মত বাঁকতে থাকে, জ্বর কোন এক দুষ্টু কিশোর, খুব জ্বালিয়ে কোথায় পালায় !! কিন্তু, আজহারের শুধু রাসেলের কথা মনে পড়ে। কোন এক ঝড়ো রাতে আয়নাতে পাংশু মুখের দিকে তাকাতে গিয়ে আজহার আবারো এক ঘোরের মাঝে পড়ে যায়। অকস্মাৎ আয়নায় ভেসে ওঠে কোন অচেনা অবয়ব , খুব ঘোলাটে সেই অবয়ব শুধু প্রশ্ন করে – “আরেকটু ধৈর্য্য তোর হল না আজহার ??”
- আমি তো আমার সাধ্যমত চেষ্টাই করলাম, ওকে ধরে রাখলে আমিও ডুবে যাইতাম। আমার দম ফুরায়া গেসিলো প্রায়।
- রাসেলকে তুই পানির উপরে রাখতি, ওর শুধু অল্প একটু বাতাস দরকার ছিলো। অল্প একটু বাতাস পেলে ও বেঁচে যেতো।
- কিন্তু, আমি?? আমারও তো বাতাস দরকার ছিলো। আমি ওকে উপরে তুলে রাখলে আমি মারা যেতাম।
- তুই নিজেকে বাঁচানোর জন্য রাসেলকে খুন করেছিস আজহার।
তৎক্ষনাৎ পালিয়ে যায় আজহার, আয়না থেকে পালায়। পালাও আজহার পালাও, রাসেলকে তুমি ডুবিয়ে দিয়েছ আজহার, পালাও আজহার, পালাও, একাকী খুনের দায়ভার নিয়ে পালাও। রাসেলের অবাক এপিটাফ থেকে পালাও, সেই এপিটাফে রাসেল এর ইচ্ছামত একটা আয়না ঝুলানো আছে, সেই আয়নায় ছবিগুলো ঝাপসা খুব, সেই আয়নায় ধূলো জমে খুব, তোমার ঘরে হামলা দেয়া সেই কুলাঙ্গার আয়না থেকে পালাও, পদ্মার ঢেউ থেকে পালাও।
কিন্তু, কোথায় পালাবে আজহার ?? আজহারের যে কেবল রাসেলের কথা মনে পড়ে যায় – ““আজহার, আমি ডুবে যাচ্ছি আজহার।” সেই শুষ্ক কন্ঠের আমিত্ব এসে আজহারকে গ্রাস করে, আজহার নিজেই ডুবে যেতে থাকে। বিস্তীর্ণ জীবনের প্রতিটি কোণায় আজহার শুধু ডুবে যায়, শুধু শুধুই অকারণে ডুবে যায় । মা এর ক্যান্সার, অফুরন্ত দৌড়াদৌড়ি, সেখানেও হাসপাতালের রোগগন্ধের মাঝে আজহারের কেবল পদ্মার কথা মনে পড়ে, রাসেলের কথা মনে পড়ে, ডুবে যায়, আজহার কেবল ডুবে যায়। হাজার হাজার মানুষ, কীট, ফড়িঙ্গের মাঝে ডুবে যায় আজহার, টাকা পয়সার ধান্ধায় ঘুরতে ঘুরতে ডুবে যায়। তুমুল ভীড়ে একাকীত্বের মাঝে ডুবে যায়, হতাশার মাঝে ডুবে যায়, খুনী তকমার মাঝে ডুবে যায় যখন তখন।
আর, সময়ে অসময়ে আজহারের কেবল রাসেলের কথা মনে পড়ে । সেই রাসেল, কোন এক অলৌকিক উপায়ে বিপুলা পৃথিবীর কোন কিছুতেই অবাক না হওয়ার এক বিরল প্রতিভা ছিল যার, সেই রাসেল, কোন অজ্ঞাত কারণে যে কখনোই গান গেত না, যার গান শুনেছে এমন কোন স্বাক্ষীকে কখনোই পাওয়া যায় নাই সাহেববাজারে, নিউমার্কেটে, তালাইমারি মোড়ে। সেই রাসেল, যে কিনা সময় পেলেই একটাই বই পড়তো ‘বিষাদ সিন্ধু’ ; একবার, দুবার, তিনবার শেষ করে বারংবার। রাসেল কি তবে সিন্ধুর বিষাদ বুঝে ফেলেছিল ?? রাসেল কি পদ্মায় বিষাদ খুঁজে পেয়েছে ?? আজহার শুধু রাসেলের মাঝে ডুবে যায়। ডুবে যাও আজহার, ডুবে যাও।
৩
ঠিক এইভাবে, সমান্তরাল বেশ অনেককটা বছর পার হয়ে রাসেলের এপিটাফের আয়নাকে ঝুলের মাঝে ফেলে রেখে সময় এসে থামে ২০০৬ সালের ২২ শে মে মধ্যরাতে কালবৈশাখীর খুব কালো কোন রাতে হায়েনা হাসি হাসতে থাকা মেঘেদের মাঝে। চাঁদপুরের মোহনায় পদ্মা, মেঘনা আর ডাকাতিয়ার মাঝে কোন ডাকাতিয়া ঝড় এসে ছোটখাট একটি লঞ্চ কে আপন করে নিতে চায়।
এবং ঠিক সেইদিনই, ২০০৬ সালের ২২ শে মে মধ্যরাতে লঞ্চ ও নদীর পানির যুদ্ধে পড়া খুব সাদা হয়ে ওঠা ঢেউ এর মাঝে, খুব শ্যাওলারঙ্গা কচুরিপানা এর সাথে ভাসতে ভাসতে, ধূলোরঙ্গা পদ্মার স্নেহমাখানো বছর ত্রিশের এক নব্য বিবাহিত যুবকের, তার স্ত্রীর পিতার বাড়িতে সস্ত্রীক যাত্রাকালে আরো একবার খুব কোলাজে পরিপূর্ণ চেতনায় আঘাত হানে একটা বাক্য – ““আজহার, আমি ডুবে যাচ্ছি, আজহার।”
আজহারের কেবল রাসেলের কথা মনে পড়ে, কৌতুহল বিহীন নির্বিকার রাসেল, কখনোই গান না গাওয়া রাসেল, সিন্ধুর মাঝে বিষণ্ন রাসেল, পদ্মায় ডুবে যাওয়া রাসেল, বুমেরাং হয়ে ফিরে আসা রাসেল; রাসেলের কথা মনে পড়ে।
ফুটনোট -
► গল্পটা প্রায় বাস্তব, তাই লিখতে খুব কষ্ট হয়েছে। কায়িক পরিশ্রম না, মনস্তাত্ত্বিক কষ্ট।
► এই গল্পটা লেখার পিছনে একটি গানের অবদান অনেক। যদিও গল্পের সাথে গানের কথার তফাত আকাশ পাতাল, তবে এই গানটির মাঝে খুব ডুবে গিয়েই আমি এই গল্পটি লেখার সাহস অর্জন করি।
নুরুল আলম আতিকের ডুবসাঁতার সিনেমার আমি যদি ডুইবা মরি - এই গানটি।