পুরো শরীর এবং মন জুড়ে সুতীব্র, সুতীক্ষ্ণ প্রকট একটা অবসাদ অনুভূত হয় রাসেলের। লোকাল বাসের মত কেমন একটা খাপছাড়া থেমে থেমে ঘুম হচ্ছে। সেকেন্ড হ্যান্ড ফ্যানের ঘটর ঘটর শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ শোনা যাচ্ছে না। বিষণ্ণচিত্ত রাসেল প্রথমেই সময় সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকার স্পৃহা অনভব করে। যদিও রাসেল ভালো মতই জানে ঘড়ির সাথে তার কোন সম্পর্কই নেই, এখন ভোর হলেও যা, রৌদ্র করোটিতে ঝলসানো তপ্ত দুপুরও তাই, কিন্তু তারপরেও ঘুম থেকে ওঠা মাত্রই প্রস্রাব করার মতই অনিবার্য হচ্ছে জেগে উঠে সময় সম্পর্কে সচেতনতা। মুঠোফোনের বিবৃতি অনুযায়ী ফাইভ পয়েন্ট টু থ্রি পি এম। তার মানে বিকাল, তার মানে বিকল একটা বিকাল, ঘরে ফেরা মানুষ ও পাখিদের ভীড়, তার মাঝে একাকী বেকার রাসেল , যার বাস্তবিকই কোন কাজ নেই, কোন উদ্দেশ্য নেই। এই খুপরির মাঝে অবশ্য বিকালের অস্তিত্ত্ব বোঝা যাচ্ছে না, বোঝা যায় ও না, বোঝার কোন দরকার ও নেই। পরিপূর্ণরূপে সূর্যালোক প্রতিবন্ধক আশেপাশের দশতলা, বারোতলা, বহুতল ভবন এর ভীড়ে দিগম্বর একটা ঘর। সুর্যের আলো কিংবা দখিনা বাতাস কিছুই পৌছায় না এখানে। আজহার বলে ‘কবর’; রাসেল বলে “আমাদের জীবনে জীবনটা কোথায় শুনি, বলতে গেলে আমরা মৃতই। শুধু প্রাণটা কেই টেনে নিয়ে বেড়াচ্ছি। আমাদের এই কবরের চেয়ে বেশি কি দরকার ?” আজহারের মৌনতাই সম্মতি হিসেবে প্রতীয়মান হয়। মুঠোফোনের ক্যালেন্ডার টা নষ্ট। কি বার, কত তারিখ এই নিয়ে বিগত কয়েক মাস ধরেই কোন মাথাব্যথা নেই রাসেলের। কয়েক মাস নাকি কয়েক বছর? রাসেল ঠাউর করে উঠতে পারে না। “হু গিভস এ ফাক” রাসেল নিজের মনকে প্রবোধ দেয়। কিন্তু, প্রায় হাফ বোতল ভোদকা চাপানোর পর মাদকতাময় ঘুম কতদূর গরিয়েছে তা কৌতুহলের বশবর্তী হয়েই জানতে ইচ্ছা করে। সিগারেটের তৃষ্ণা হওয়া সত্ত্বেও যখন পুরো ঘর চিরুনিতল্লাশি করেও একটা সিগারেট পাওয়া যায় না, তখন যারপরনাই বিতৃষ্ণা ও বিরক্তি একসাথে ভর করে মনের দেয়ালে।
সিগারেট নেওয়ার জন্য কামালের দোকান অভিমুখে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বের হয়েই থমকে যায় রাসেল। বুকে আচানক ধাক্কা লাগে। আকাশ এত কালো কেন? নিস্তব্ধ পরিবেশ, কোন বাতাস নেই, ঝড়ের কোন পূর্বাভাস নেই, মূলত শরৎকালে এই আবহাওয়ার কোন যৌক্তিক ব্যাখ্যাও নেই। তাহলে আকাশ এত কালো হয় কীভাবে? বিকাল হোক আর ভোরই হোক সাড়ে পাঁচটায় তো এইরকম আঁধার থাকে না কখনো, শুধু রাস্তার ধারের সোডিয়াম বাতিগুলো টিমটিম করে জ্বলছে। আশ্চর্য ! এত আগে তো বাতি জ্বালানোর কথা না। কিন্তু তারচেয়েও বড় ব্যাপার রাস্তায় কোন মানুষই নেই, একটা নেড়ি কুত্তা ঘাড় বেকিয়ে হেলে দুলে হেঁটে বেড়াচ্ছে। এই রাস্তায়, বিশেষত চা সিগারেটের দোকান অধ্যুষিত এই পারিপার্শ্বিকে মানুষের ভীড়ে যেখানে পা ফেলাটাও দুরূহ, সেখানে কোন মানুষ নেই কেন ? আশেপাশে সুনসান নীরবতা, গা ছমছম করা স্তব্ধতা, তাহলে কি এখন মধ্যরাত? মুঠোফোনের ঘড়ি ভুল দেখাচ্ছে? কিন্তু মধ্যরাতেও তো এখানে ধুন্ধুমার চা সিগারেট কিংবা আরো গভীরভাবে দেখলে গাঁজা-ফেন্সিডিলের ব্যবসা চলে। পুরো রাস্তা জুড়ে পরে আছে পরিধেয় বস্ত্র, শতচ্ছিন্ন চপ্পল, বিভিন্ন আকারের, বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন রঙ এর। চকরা বকরা শার্ট, নোংরা জিন্স, টি-শার্ট, ব্রা-প্যান্টি। রাসেলের মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে, দৃষ্টিভ্রম নাকি ? ইলিউশন, ডিলিউসন, হেলুসিনেশন এই জাতীয় কিছু ? রাসেল চোখ কচলায়, দৃশ্যপটের পরিবর্তন হয় না। চিমটি কাটে, দৃশ্যপটের পরিবর্তন হয় না। উল্টা ঘোরে, দৃশ্যপটের পরিবর্তন হয় না। চোখ বন্ধ করে নিজেকে এক মিনিট সময় দেয়, বড় বড় দম ফেলে, দৃশ্যপটের পরিবর্তন হয় না।
নির্বাক, নির্জন, নিস্তব্ধ, নিশ্চুপ নিসর্গ। রাসেলের হৃদয় ধুক ধুক করে পিটায়, ছিড়ে বেরিয়ে আসতে চায়। এ কোন অচেনা অসহায়ত্ব? রাসেল এর চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করে। সে চিৎকার করে ওঠে “ অনেক হয়েছে ভাইসব, এই লুকোচুরি খেলা বন্ধ করুন। ” ক্ষীণ এক প্রতিধ্বনি ছাড়া কেউ জবাব দেয় না। সঙ্গী চাই, সঙ্গী চাই। নেড়ি কুত্তাটার পিছ পিছ নিজের অজান্তেই হাঁটতে থাকে রাসেল, মেসোমেরাইজড। মস্তিষ্ক নিঃসাড় হয়ে আছে, ভয়েড। কতক্ষণ ধরে হাঁটছে কুকুরটা? কতদূর যাবে? ইনফিনিটি। অকস্মাত এলাকার সর্ববৃহত আস্তাকুড়ের সন্নিকটে এসে পরলে রাসেলের সম্বিত ফেরে। দুর্গন্ধে বিবমিষা জাগে। না, এইতো রাসেল, এইতো একটা চা সিগারেটের দোকান। ছোট্ট একটা কুপি জ্বালানো। তাকে ঘিরে কিছু আলোখোর পোকাদের উদ্দাম নৃত্য। ধূ ধূ প্রান্তর, কোথাও কেউ নেই। মনে হয় কোন মরুভূমিতে অমাবস্যার রাতে হেঁটে চলা কোন একলা পথিক, সাথে তার পুরনো ভৃত্ত একটা নেড়ি কুকুর। চায়ের দোকান খালি, কেউ নেই, চায়ের কেটলির চা পুড়ে আশ্চর্য এক নেশা উদ্রেককারী বাষ্প হয়ে গেছে। এবড়ো থেবড়ো ভাবে পরে আছে সিগারেটের প্যাকেট। আনমনে একটা বেনসন চুরি করে আকাশের দিকে তাকাতেই রাসেলের বুক ফাঁকা হয়ে যায়, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। প্রচন্ড ভয় গ্রাস করে সত্ত্বাকে। আকাশে একটা না, দুটো না। লাখ লাখ কাক, কোন চিৎকার চেচামেচি নেই, কোন বিকার নেই। তারা শান্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে রাসেলের দিকে। এত কাক! এত কাক কেন ? রাসেল এর মনে হয় এত এত কাকের এত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সে সহ্য করতে পারবে না, সে জ্ঞান হারাবে, কিন্তু এক দৈব প্রক্রিয়ায় সে তার ভয় নিয়ে টিকে থাকে। এত গুলো কাক তার দিকে নিস্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে কেন? রাসেলের পুরো শরীর কাঁপে, দড়দড় করে ঘাম ঝরে। এই অস্পষ্ট আলোতেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সব কয়টা কাকের ডাগর ডাগর চোখ, শুষ্ক চাহনি। সে বোধহয় ভস্ম হয়ে যাবে, রাসেল এর মনে হয় ওরা সবাই একেকটা মেডুসা, পাথরের মত নিশ্চল হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে রাসেল। এত এত কাক, এত এত কালো, এত এত আঁধার ভেদ করে সূর্যালোক মর্তে আসতে পারে না, অকস্মাত আঁধারের উৎস খুঁজে পায় রাসেল। আচমকা একটা কাক আসমান থেকে ঝাঁপ দিয়ে রাসেলের ঠিক সামনে চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে। সোমা, এইতো সোমা। এ চোখ সোমার চোখ না হয়ে যায় না। লাখ লাখ চোখের মাঝে রাসেল ঠিক ঠিক সোমার চোখ চিনে নিতে পারবে। এ অবশ্যই সোমা, সত্যি সত্যিই এ সোমা। এই সত্য অনিবার্য, এ এক ধ্রুব বাস্তব। “সোমা, তোমার এই অবস্থা কেন সোমা ?” রাসেলের দুচোখ দিয়ে অশ্রুর ঢল নামে। এ অশ্রু হয়তো পুরোটা সোমার পরিণতির জন্য নয়, কিছুটা তার এই একাকী হয়ে যাওয়া নিঃসঙ্গ পরিস্থিতির জন্যও। কিন্তু, নির্বাক কাক নির্বাকই রয়ে যায়। তারও চোখ হয়তো বর্ষণ করে, কিন্তু এই অন্ধকারে এবং ততোধিক অন্ধকার চেহারায় তা রাসেল দেখতে পায় না। দু একবার আহাজারি করে সে থেমে যায়, নির্বাক হয়ে দর্শক হয়ে যায়। শুধু ভয়ের জায়গায় হানা দিয়ে দখল করে নেয় বিস্ময়। তাহলে কি সবাই ?? কিন্তু সে নয় কেন ? মেটামরফসিস? সে কি শুধুই গ্রেগর সামসা ? নাকি মায়ান ক্যালেন্ডারের এপোক্যালিপ্স ? কিন্তু এই অলৌকিক ঘটনার অবতারণা কোথায় ? আব্বা, আম্মা ? সোহাগ? তাকে যে হিরো সাইকেল কিনে দেয়ার কথা ছিল রাসেলের ? রাসেল আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে কাঁদে। কোন সাড়াশব্দ নেই। কোন জবাব নেই। নির্বাক, নির্জন, নিস্তব্ধ, নিশ্চুপ নিসর্গ। মাঝে মাঝে শুধু ছেড়ে ছেড়ে দু একটা কুত্তার ডাক শোনা যায়। চৌরাস্তায় তখনো জ্যাম, এহেন সঙ্গীন পরিস্থিতিতেও হাসি পায় রাসেলের। বাসের ইঞ্জিন তখনো চালু, ঘড় ঘড় শব্দ শোনা যায়, ভেতরে মানুষ নেই, রিকশার পেছনে ভ্যান, ভ্যানের পেছনে রিকশা, রিকশার পেছনে কাত হয়ে পরে থাকা মোটরসাইকেল মৃগী রোগীর মত লাফাচ্ছে, কোন মানুষ নেই। রাস্তার পাশের ল্যাম্পপোস্টে ধাক্কা খেয়ে এবড়োথেবড়ো হয়ে গেছে বিলাশবহুল প্রাইভেট কার। পেছনের সিটে তখনো দামী প্রসাধনী সামগ্রী ছিটানো, কোন মানুষ নেই। নিউমার্কেটের সব দোকান হাঙ্গরের হা, দিগম্বর, কোন মানুষ নেই। রাসেলের দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়, চিৎকার তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। কোন মানুষ নেই, কোন জবাব নেই, কোন প্রাণ নেই। নির্বাক, নির্জন, নিস্তব্ধ, নিশ্চুপ নিসর্গ। রাসেল ভাবতে বসে – শুধু আমিই বাদ গেলাম কেন ? হোয়াট ইস সো স্পেসিয়াল আবাউট মি ? এ কথা সত্যি যে, সে মাঝে মাঝেই বলতো “এই দেশে, মূলত এই শহরে কোন মানুষ নেই, যারা বেঁচে আছে, তারা কেবল একটা কংকালের উপর মাংসের প্রলেপ, কোন প্রাণ নাই, বাঁচার অধিকার নাই এদের।” কিন্তু, এ কথা তো আজহার ও বলতো হরহামেশাই। বস্তুত, আজহার আর তার মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়? গাঁজার পুটকি থেকে শুরু করে শহুরে বেশ্যার কোমল জোৎস্নার মত যোনির পাঁপড়িদুটো পর্যন্ত শেয়ার করে খেয়েছে তারা দুজন। তাহলে ? নাকি সোমার মত মেয়েকে ভালোবাসার পরও বিয়ে করতে না পারার অযোগ্যতাই মুখ্য যোগ্যতা ? পরক্ষণেই রাসেলের জানতে ইচ্ছা করে, সে কি একাই নাকি আরো অনেকে তার মত এই ধ্বংসযজ্ঞে টিকে আছে কিংবা অন্যভাবে বললে ধ্বংসযজ্ঞে্র কবলে পরেছে ? যোগাযোগের গভীর সমস্যা নিয়ে কয়েকজন একা একা লোক? পুরো পৃথিবীর সব মানুষ ? সে কি তবে শেষ আদম ? তাহলে আরো একজন মানবী আছে শেষ হাওয়া। তাহলে কি আবার একটা পৃথিবী, একটা মানবজাতি সৃষ্টি করতে হবে ? যেই পৃথিবীর আকাশ কালো, সময় কালো, চেতনা কালো, কালো চারিদিক ? এরচাইতে আত্নহনন সোজা। রাসেল নিজেকে বোঝায়।
কিছুক্ষণ পর আকাশে এত এত কাকের ভীড়ে একটা চিল দেখা যায়।