রাতে হোটেলে বসে নেটে খুঁজছিলাম সকালে কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায়। খুঁজতে খুঁজতে দেখতে পেলাম এক রঙিন শহর আছে পাশেই যা এখন মিউজিয়াম হিসাবে স্বীকৃত।এই রঙিন শহরের নাম ‘’বো-ক্যাপ’’ যা ১৬০০/১৭০০ সালের দিকে হয়েছিল এবং আজো সেই অবস্থাতেই আছে। হোটেলের পাশেই বো-ক্যাপ শহর তাই পরিকল্পনা করলাম ক্যাপটাউন থেকে যাওয়ার আগে অবশ্যই এই রঙিন শহর ও তার ইতিহাস জেনে যাব, সকালে বরং টেবল মাউনটেন দেখতে যাবো।
রাতে প্রচুর বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। রুমের হিটার চলছে ফুল স্পিডেই, একটার জায়গায় দুইটা কম্বল নিলাম, সুয়েটার গায়ে দিলাম তাও শীতে কাঁপছিলাম। সকালে রুমের পর্দা সরালেই দেখতে পেতাম টেবল মাউনটেন আর তার উপর সূর্যের আলোর ঝিলিক, কিন্তু ঘুম ভেঙ্গে যখন পর্দা সরিয়েছি দেখতে পেলাম আমার সামনের পুরা পাহাড়ের উপর যেন কেউ মেঘের চাদর বিছিয়ে দিয়েছে, পাহাড়ে মেঘ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাইনি।
পরিষ্কার আবহাওয়ায় হোটেল রুমের পর্দা সরিয়েই যেমন দেখতাম
মেঘ করলেই পাহাড় মেঘের চাদরে ঢেকে যায়
আমাদের ট্যাক্সি ড্রাইভার এসে যখন ফোন দিল তখন হোটেল লবিতে গিয়ে হোটেলের ট্যুরিজম কর্মিদের সাথে কথা বললাম যে আজ টেবল মাউনটেন যাওয়া যাবে কিনা। ডেস্কে বসা মেয়েটা বললো সে আজকের আবহাওয়া বার্তা দেখে বলতে পারবে। সে আবহাওয়া বার্তা দেখে বললো ‘সরি, আজ সারাদিন আবহাওয়া খারাপ থাকবে, মেঘাচ্ছন্ন থাকবে আর বৃষ্টি হবে, তাই আজ পাহাড় আর সাগর কোথাও যাওয়া যাবেনা। বললো টেবল মাউনটেন পুরাই মেঘে ঢাকা আর অন্ধকার, পাহাড়ে যাওয়ার রাস্তাও বন্ধ আর সাগরে ঘুরাঘুরির সব ট্যুরিষ্ট জাহাজও বন্ধ, তাই আমরা ইচ্ছে করলে সাইট সিয়িং বাসে শহর ঘুরতে পারবো, অথবা প্রায় ১২টা মিউজিয়াম আছে শহরের মধ্যে তা দেখতে পারবো।‘’ জিজ্ঞেস করলাম বো-ক্যাপ মানে সেই রঙিন শহর দেখতে পারবো কিনা। সে বললো অবশ্যই দেখতে পারবে, আর বাকি সব মিউজিয়ামও কাছাকাছি তাই যতগুলি সম্ভব দেখতে পারবো, তবে আজ প্রচন্ড শীত থাকবে তাই আমরা যেন ভারী শীতের কাপড় আর ছাতা নিয়ে বের হয়।
ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বললাম বো-ক্যাপ যেতে। সে প্রথমে একটা মিউজিয়ামে নিয়ে গেল। বিশাল এক মিউজিয়াম। সৃষ্টির শুরু থেকে মোটামুটি যত রকমের পশু, প্রানী এবং গ্যালাক্সির যখন যা পেয়েছে, তার যতটুকু সংরক্ষণ করা সম্ভব তার সবই এই মিউজিয়ামে তারা সংরক্ষণ করে রেখেছে। এটা পুরা দেখতে গেলে দিনের বেশির ভাগ সময় চলে যাবে, তাই অল্প একটু দেখে ড্রাইভারকে বললাম বো-ক্যাপের রঙিন শহরে নিয়ে যেতে।
যখন বো-ক্যাপে আসলাম রাস্তার দুইপাশে সারিসারি রঙিনসব বাড়ি যা আমি আগে ইন্টারনেটে দেখেছিলাম তা চোখের সামনে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। এইসব রঙিন বাড়ির পেছনের ইতিহাস অনেক করুণ, বেদনাদায়ক।সারিসারি বাড়ির মধ্যে একটি বাড়িকে রাখা হয়েছে যাদুঘর হিসাবে, যেখানে ট্যুরিষ্টরা সব তথ্য পেতে পারে। টিকেট কেটে প্রথমে গেলাম সেই বাড়িতে। জানলাম এই বো-ক্যাপ শহর সম্পর্কে কিছু। বো-ক্যাপ হচ্ছে সাউথ আফ্রিকার সবচেয়ে পুরানো আর আকর্ষনীয় আবাসিক এলাকা, যেটা সিগনাল পাহাড়ের ঢালুতে ক্যাপটাউনে অবস্থিত। ১৬০০/১৭০০ সালের দিকে যখন ডাচরা সাউথ আফ্রিকা শাসন করতো তখন তারা মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ইন্ডিয়া,শ্রীলংকা এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে ক্রীতদাস নিয়ে আসতো এই বো-ক্যাপে।এই ক্রীতদাসদের বলা হত ক্যাপ মালে, যদিও তাদের সবাই মালয়েশিয়ার ছিলনা। ক্রীতদাসদের বেশিরভাগই ছিল মুসলমান কিন্তু ডাচরা তাদের কোন রকম ধর্মকর্ম পালন করতে দিতনা।কেউ নামাজ পড়তে পারতোনা, নামাজ পড়লে তাদের কঠিন শাস্তি দেওয়া হত। এই দাসদের দিয়ে সারাদিন কঠিন কাজ করাতো। কিন্তু তাদের ঈমাদের জোর ছিল খুবই মজবুত। তারা সারাদিন কাজ করে ক্লান্ত হয়ে, গভীর রাতে দূরের সিগনাল পাহাড়ের উপর গিয়ে সারাদিনের নামাজ পড়ে নিত।
এভাবে প্রায় আশি বছর তারা ডাচদের কাছে ক্রীতদাস হিসাবে বন্দি ছিল। তারপর এক সময় ১৭৯৫ সালে ব্রিটিশরা ডাচদের থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেয়। ব্রিটিশরা ক্ষমতায় আসার পর আস্তে আস্তে এই ক্রীতদাসরা কিছু স্বাধীনতা পাওয়া শুরু করেছে ধর্মীয় দিক থেকে, তারপর আস্তে আস্তে ক্রীতদাস প্রথা বিলুপ্ত হয়ে গেল। তখন এই বো-ক্যাপের ক্রীতদাসেরা একটি নতুন কমিউনিটি চালু করেছে যা এখন ‘’মালে কোয়ার্টার’’ নামে পরিচিত, আর এই বো-ক্যাপ মূলত মুসলিম কমিউনিটি, যাদের বহু বছর আগে এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে এখানে ক্রীতদাস হিসাবে আনা হয়েছিল।পরে অনেক স্থানীয় লোকজনও মুসলিম ধর্ম গ্রহন করেছিল এবং তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল। বর্তমানে বো-ক্যাপের লোকজন নিজেদের ‘’ক্যাপ মুসলিম’’ হিসাবে পরিচয় দেয়। এই বো-ক্যাপেই আছে সাউথ আফ্রিকার প্রথম মসজিদ আওয়াল মসজিদ, আছে যে মসজিদে সাউথ আফ্রিকার মধ্যে সবার আগে জুম্মার নামাজ হয়েছিল সেই জামিয়া মসজিদ।
আগে সাউথ আফ্রিকার সব বাড়ি ছিল সাদা রঙের। যখন থেকে বো-ক্যাপের মুসলমানেরা নিজেদের ধর্মীয় স্বাধীনতা পেয়েছে তখন তারা ঈদ উপলক্ষে যার যার বাড়ি রঙিন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, এবং তারা ঠিক করেছিল যে একেকজনের বাড়ির রঙের সাথে যাতে অন্য কারো বাড়ির রঙ না মিলে সেভাবে রঙ করবে, সেই ঐতিহ্য আজও চালু আছে। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে সেই শতশত বছর আগের বাড়িগুলিও আগের ডিজাইনেই আছে। এখন এখানে সব মুসলিমদের বসবাস, সব বাড়িতেই লোকজন আছে। পুরা এলাকায় মিউজিয়াম হিসাবে স্বীকৃত। পর্যটকেরা দেখার জন্য যেকোন বাড়িতেই ঢুকতে পারে।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই আগস্ট, ২০১৬ সকাল ৭:২৪