অনেক অনেক দিন পর আজ সামুতে মুভি নিয়ে লিখতে বসলাম।বেশ কয়েকদিন ধরেই তেমন মুভি দেখা হচ্ছে না,আর দেখলেও সেগুলোকে নিয়ে খুব একটা লিখতে ইচ্ছা করেনা, তবে কিছুদিন ধরে ভাবছিলাম অন্তত একটা সিংগেল মুভির রিভিউ হলেও লেখা দরকার। কারন সামুতে লেখালেখি খুবই মিস করছিলাম, যেই ভাবনা সেই কাজ। হার্ডডিস্কে অনেকদিন থেকেই পড়ে ছিলো হিচককের একটি মুভি, নাম লাইফবোট, রিলিজটাইম ১৯৪৪ সালের। এর চেয়ে আর ভালো অপশান কি হতে পারে? তাই ঝটপট দেখে ফেললাম মুভিটা, আর দেখেই মনে হলো এইরকম একটা মুভিই তো খুঁজছিলাম এতোদিন ধরে !!!! আসুন, আজকে আপনাদের আরেকটি হিচককীয় মাস্টারপিসের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।
মুভিটির নামতো আগেই বললাম, লাইফবোট একটি আমেরিকান মুভি যেটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালীন পটভূমিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে।কিন্তু সেই যুদ্ধের উপস্থাপনাটাও এসেছে অন্যভাবে, জন স্টাইনবেকের গল্প অবলম্বনে নির্মিত সেই মুভিতে সম্মুখযুদ্ধ না দেখিয়ে একটু অন্যভাবে যুদ্ধের ভয়াবহতা আর মানবিক জিনিসগুলো অসাধারন দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন পরিচালক হিচকক।
মুভিটির রানিংটাইম প্রায় এক ঘন্টা ৩৫ মিনিটের মতো। এইবার মুভিটির কাহিনীটা সংক্ষেপে একটু বলে নেই, মুভির নাম দেখেই বুঝতে পারছেন পুরো কাহিনীর সাথে একটি লাইফবোটের সম্পর্ক রয়েছে। ঠিক তাই। মুভির শুরুতেই দেখা যাবে,আটলান্টিক সাগরে জার্মান নাৎসি বাহিনীর একটি ইউ-বোট একটি ব্রিটিশ জাহাজকে আক্রমন করে, এবং সেই সম্মুখযুদ্ধে সেই জাহাজটি ডুবে যায়, জাহাজডুবির পর জাহাজের বেঁচে যাওয়া কিছু ভাগ্যবান আমেরিকান আর ব্রিটিশ সিভিলিয়ান যাত্রীরা একটি লাইফবোটে পর্যায়ক্রমে আশ্রয় নেয়। তাদের মধ্যে কেউ ইন্টারন্যাশনাল জার্নালিস্ট,কেউ নার্স , কেউ ধনী ব্যবসায়ী, কেউ রেডিও অপারেটর আবার কেউবা সাধারন নাবিক। কিছুক্ষন পর তাদের সেই লাইফবোটে আরেকজন প্রাণ রক্ষার্থে সাঁতরিয়ে আশ্রয় নেয়। তাকে নৌকায় তোলার পর দেখা যায়, সে আসলে ঐ জার্মান ইউ-বোটেরই একজন সদস্য, শত্রুপক্ষের একজন সদস্যকে লাইফবোটে রাখা নিরাপদ হবে কিনা সে নিয়ে বাক বিতন্ডায় জড়িয়ে পড়ে সবাই। পরে ভোটাভুটি্তে ঠিক হয়, তাকে সেই লাইফবোটেই রাখা হবে, এবং কাছাকাছি কোনো পোর্ট যেমন বারমুডাতে যখন কোনো আমেরিকান কিংবা ব্রিটিশ সাপ্লাই শিপের দেখা পাওয়া যাবে তখন তাকে একজন যুদ্ধবন্দী হিসেবে হস্তান্তর করা হবে। সেই জার্মানের কাছে জানা যায়, কমব্যাট ব্যাটেলে সেই ইউ-বোটটিও ডুবে গিয়েছে। কিন্তু সেই বারমুডায় যেতেই বাধে মহা বিপত্তি, কারন কারো কাছে কোনো কম্পাস নেই, এই অবস্থায় কোন ডিরেকশানে তারা বারমুডায় যাবে এইটা নিয়ে তারা সন্দিহান হয়ে পড়ে, তাদের কাছে পর্যাপ্ত ফুড সাপ্লাইও নেই, কাজেই নষ্ট করার মতো সময় তাদের নেই। এমন সময় জার্মান সোলজারটি বলে, সে বারমুডার ডিরেকশান জানে, কিন্তু শত্রুপক্ষের কারো কথা বিশ্বাস করা যায় কিনা এইটা নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক। শেষপর্যন্ত তারা জার্মান লোকটির দেখানো ডিরেকশানেই লাইফবোটটি চালানো শুরু করে।আর এইভাবেই কাহিনী এগুতে থাকে সামনের দিকে। শেষপর্যন্ত তারা বারমুডায় পৌঁছেছিল নাকি জার্মান সেই লোকটি সবার সরলতার সুযোগ দিয়ে আবারো তাদের বুকে ছুরি মারলো জানতে হলে দেখে ফেলুন মুভিটি।
এইবার মুভিটির বিশ্লেষণে আসি, মুভিটি গতানুগতিক হিচককীয় ধারার ব্যতিক্রম, কারন মুভিটির প্লট কিংবা জেনার টিপ্যিকাল হিচককের মিস্ট্রি ড্রামা মুভিগুলোর মতো নয়। সুতরাং এই মুভিতে হিচককের একটু অন্যরকম চেহারা দেখতে পাবেন, তবে হিচককের প্যাটার্নটা ঠিকই চোখে ধরা পড়বে, অন্যান্য মুভিগুলোর মতোই এই মুভিটা ভীষন জীবনঘেঁষা। কাহিনীতেই দেখুন, সেই লাইফবোটের প্রত্যেকটি মানুষই পেশাগত এবং সামাজিক শ্রেণী থেকে একে অপরের চেয়ে একেবারেই আলাদা। এইখানে কেউ সাধারন নাবিক আবার কেউবা বিশাল ধনী ব্যবসায়ী। আর তাদের জীবনের ভাগ্য সেই বিশাল সমুদ্রের বুকে ছোট্ট একটু নৌকায় গিয়ে ঠেকেছে, তাদের জীবনের দর্শনও বদলেছে। তাইতো এক পর্যায়ে তাদের কেউ একজন বলে উঠে, " আমরা যতোই নিজেদের সাথে ঝগড়া-বিবাদ করবো, এই সাগর ততোই বিশালাকার হয়ে উঠবে আর এই লাইফবোটও ততোই ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হবে।"
তাদের প্রত্যেকের কথোপকথনের মাঝে তাদের নিজেদের জীবনের দুঃখ-কষ্ট, হাসি-আনন্দ, বেদনাগুলো সবার চোখের সামনে উঠে আসে। আর সেই ইমোশানগুলো বর্ণ-শ্রেণী ভুলে সবাইকে একতাবদ্ধ করে। শত্রুপক্ষের হলেও সেই জার্মানটির সাথে তারা বিস্কুট-পানি ভাগ করে খায়। যদিও অন্তরে কারো কারো সেই অবিশ্বাসটুকু ঠিকই থেকে যায়। গোটা মুভিটির ব্যাপ্তিকালেই সেই অসাধারন জীবনধর্মী জিনিসগুলো চোখে ধরা পড়বে।আর মুভিটির শেষটাও দুর্দান্ত, একটা চমৎকার প্রশ্নের মাধ্যমে যখন মুভিটা শেষ হয়, আমার নিজের কাছেও মনে হয়েছিলো, আমি যদি সেইখানে থাকতাম তাহলে আমি কি করতাম?
আমার কাছে মুভিটা দেখবার পর মনে হয়েছিলো, আজকের এই সময়ের পরিপ্রেক্ষি্তে এই মুভিতে একটা চমৎকার ম্যাসেজ রয়েছে, আর তা হলো ডেমোক্রেসির মাধ্যমে যখন কোনো জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়, তখন কোনো থার্ড পার্টি এসে সমাজের ভিত টলাতে পারে না।অবশ্য এই ম্যাসেজের ব্যাপারটা আমার নিজের একান্ত ধারণা, জানিনা আপনারা সেইটার সাথে লিংক আপ করতে পারবেন কিনা !
মুভিটির অ্যাক্টর অ্যাক্ট্রেসদের অসামান্য অভিনয়ের কথা না বললেই নয়, প্রত্যেকেই দারুন পারফরম্যান্স দেখিয়েছেন, তবে আলাদা করে Tallulah Bankhead এর নাম বলতে চাই যিনি Constance 'Connie' Porter এর চরিত্রে আউটস্ট্যান্ডিং অভিনয় করেছেন। মুভিটির চিত্রনাট্যও অসাধারন মাপের, গোটা মুভিটির অলমোস্ট পুরোটাই শ্যুট করা হয়েছে সেই লাইফবোটের উপর। পরিচালনায় হিচকককে নিয়ে কিছু বলতে চাই না, হিচককের তুলনা কেবল হিচককই, কেবল একটা দৃশ্যের কথা আলাদা করে বলবো, লাইফবোটে কোলের শিশুটিকে হারিয়ে মা যখন ঘুমাচ্ছিলেন তখন তার দুই হাতের পজিশান এমন ছিলো যেন সে সত্যিই তার শিশুটিকে কোলের উপর শুইয়ে রেখেছে, অসাধারন এবং ভীষনরকম আবেগস্পর্শী একটা দৃশ্য !!!!!
মুভিটি মোট তিনটা ক্যাটাগরীতে অস্কারের জন্য নমিনেশান পেয়েছিলো,ক্যাটাগরী তিনটি হলো :
১। Best Cinematography ( Black-and-White ) এর জন্য Glen MacWilliams
২। Best Director এর জন্য Alfred Hitchcock এবং
৩। Best Writing, Original Story এর জন্য John Steinbeck
মুভিটির আইএমডিবি রেটিং ৭.৯/১০, আইএমডিবির প্রোফাইল ঘেঁটে মনে হচ্ছে এটি হিচককের বেশ আন্ডাররেটেড একটি মুভি, কারন মাত্র ১২০০০ ইউজার এটিকে রেটিং করেছেন, তবে আমার কাছে গোটা মুভিটি খুবই খুবই ভালো লেগেছে, ভীষন উপভোগ্য এবং সেই সাথে মনকে নাড়া দিয়ে যাওয়া একটি মুভি। আমার পার্সোনাল রেটিং ৮.৫/১০। মুভিটি সবার জন্য হাইলি রিকোমেন্ড করলাম।
এই ধরনের সিংগেল সেট নির্ভর মুভি একমাত্র হিচককই বানাতে পারেন।তাই জয়তু হিচকক, জয়তু লাইফবোট।
ডাউনলোড লিংক:
Click This Link
পোস্টটি শেষ করার আগে একটা মজার ইনফো দিয়ে যাই, এই মুভিতে হিচককের একটা অন্যরকম ক্যামিও শট আছে, আর তা হলো মুভির ঠিক ২৪ মিনিট ৫১ সেকেন্ডের মাথায় পত্রিকার যেই ওজন কমানোর বিজ্ঞাপনটি দেখানো হয় সেখানে হিচককের ইমেজ দেখানো হয়েছিলো, এই জটিল জিনিসটি উইকিপিডিয়া থেকে জানতে পারি, হিচককের পারেও বটে !!!!
মুভিটি অবশ্যই দেখবেন আর দেখে কেমন লাগলো জানিয়ে যাবেন।