পৃথিবীতে মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী, তবে সাধারণভাবে মানব জীবন গতিশীল। এ গতিরও একটা সীমানা নির্ধারিত রয়েছে, তা হলো এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড ধ্বংস হবার দিন। তার পূর্বে জীবন আসে, নির্দিষ্ট সময় এখনে যাপন করে, শ্রমে-ঘর্মে পৃথিবীতে তার অংশকে যুক্ত-সিক্ত করে ফিরে চলে যায় আরেক জগতে; এভাবেই প্রতিনিয়ত মানব জাতির আসা যাওয়ায় আবাদ হচ্ছে পৃথিবী। মোটের প্রেক্ষাপটে তাকালে মনে হবে যে, সবকিছুই মানুষের কাজ, মানুষেরই জন্য, মানুষের পৃথিবীর উন্নয়নের জন্য। কিন্তু মানব জাতির একক হিসেবে চিন্তা করলে দেখা যায় তার উল্টোটা। এখনে ব্যক্তি একা যা কিছুর সম্পাদন করে গেছে, তার কিছু কিছু জীবনকালে ভোগ করে গিয়েছে; বাদ বাকী বিশাল অংশটুকু পড়ে রয়েছে, শুধু সে আর অবশিষ্ট নেই এই পৃথিবীতে। এ দৃষ্টিভঙ্গির ফলাফলে বেশীর ভাগই বেদনা, হাহাকার, দীর্ঘশ্বাস। ব্যক্তির নিঃশ্বাসের প্রবল পরিক্রমা যতক্ষণ ক্রিয়াশীল ততক্ষণ পৃথিবীর সবকিছু তার জন্য হতে পারে, নিঃশ্বাসের নিঃশেষে সবকিছুই তার জন্য থমকে যায় সেখানে, ঠিক সেই মুহূর্তে! মূলতঃ এটিই মানব জীবনে সত্যিকারের বাস্তবতা।
কত স্বপ্ন, কত সাধনা, কত কাজ, কত গতিময় জীবন; না, তখন ভুল হয়ে যায় সকল সরল চিন্তা। জগতে কত অসাধ্যই না সাধনের পরিকল্পনা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া হয় শ্রমে-কর্মে। এই প্রাবল্য সেদিন মিথ্যে মনে হতে থাকে ওপারের যাত্রীর নিকট। কিন্তু এপারে যাদের অবস্থান, তারা কোনভাবেই উপলব্দি করতে পারে না কি ভয়ংকর অবস্থার মুখোমুখি হতে হচ্ছে অনন্তযাত্রীদের।
না, সকলেই যে ব্যর্থ কিংবা বিপদগ্রস্ত তা নয়। পৃথিবীর এ স্বল্পসময়কে সাজিয়ে রাঙিয়ে নিতে পেরেছেন যারা সত্যের রঙে, তারা সে যাত্রায় যত খুশী হন পৃথিবীর জীবনকালের আর কোথাও এত খুশী হতে পারেন না। অনন্তখুশীর এ ধারাবাহিকতার কোন শেষ নেই। এ খুশী লাভের যাবতীয় উপায় উপকরণ আমাদের নাগালের মধ্যেই রয়েছে। প্রয়োজন শুধু গ্রহণের, জ্ঞান লাভের ও শ্রমে-কর্মে জীবনকে সফল হিসেবে গড়ে তোলা এবং প্রিয় আনন্দের মঞ্জিল জান্নাতে পৌঁছে যাওয়ার সাধনা করা। জগৎস্রষ্টা বলেন: فَادْخُلِي فِي عِبَادِي وَادْخُلِي جَنَّتِي "অতঃপর আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও। এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর।" [সূরা আল-ফজর: ২৯-৩০]
অজানা অথচ সুনির্দিষ্ট সময়ের এই জগতের পথে যে যা কিছুই করি না কেন, যে পথ ও যে আদর্শই ধারণ করি না কেন, ওপার জীবনের প্রথম মঞ্জিল কবরে প্রত্যেক আদম সন্তানকে তিনটি প্রশ্নের সম্মুখীন হতেই হবে। প্রশ্ন তিনটি যথাক্রমে- তোমার রব কে? তোমার দ্বীন কী? তোমার নবী কে?
জীবনের প্রতিটি কাজে কর্মেই মানুষের এ প্রশ্নগুলোকে স্মরণ রাখা ও সামনে নিয়ে আসা একান্ত প্রয়োজন। কেননা, এ প্রশ্নগুলো এমন নয় যে, বার বার মুখস্থ করে নিয়ে গেলে কবরে জবাব দেয়া যাবে। আবার এমনও নয় যে, লিখে কিংবা রেকর্ড করে নিয়ে গিয়ে কাজে লাগানো যাবে। না; বরং কেউ সারা জীবন এগুলো মুখস্থ করতে থাকলেও সেদিন কবরে যখন ফিরিশতা প্রশ্ন করবেন, তখন শুধু মুখস্থ করার গুণে জবাব দেয়া সম্ভব হবে না। বরং জবাব দেয়া সম্ভব হবে যদি জীবনকে এ তিনটি প্রশ্নের আলোকে আলোকিত করা সম্ভব হয়। আর জীবনের তিনটি অবিচ্ছেদ্য অংশ যথাক্রমে চিন্তা, কথা ও কর্ম। ব্যক্তি কি চিন্তাধারা, কি চেতনা, কি আদর্শিক ভাবনা পোষণ করেছে সারাটি জীবন; কি কথা বলেছে জনে জনে জনসভায়, বক্তৃতায়, লেখনিতে, কি কর্ম সাধনে প্রাণান্ত সাধনায়, কোন পাওয়ার জন্য, কোন আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে গেছে আমৃত্যু, এমনকি মৃত্যুর ঠিক পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত, সেসবই হবে কবরে জবাব দিতে পারা না পারার যোগ্যতা ও অযোগ্যতা ভিত্তি।
প্রথম প্রশ্নটি জগৎস্রষ্টা আল্লাহর পরিচয় বিষয়ক, যার অধিকাংশই জ্ঞানগত। অন্যদিকে তৃতীয় প্রশ্নটিও প্রিয় রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কিত; যাঁর উপর সুদৃঢ় বিশ্বাসী হতে না পারলে দ্বীন-ধর্মের বাকী যাবতীয় সবকিছুই ভেঙ্গে পড়তে বাধ্য থাকে। এতদ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা অন্যান্য লেখায় হয়েছে এবং আরো হবে ইনশাআল্লাহ্। এ প্রবন্ধে আমরা আলোকপাত করতে চেষ্টা করবো আমাদের বর্তমান চলমান সময়ে দ্বিতীয় প্রশ্নটি কিভাবে সংশ্লিষ্ট ও কবরে এর সঠিক উত্তর দেয়ার জন্য এখনই পৃথিবীতে সে প্রশ্নের আলোকে আমাদের করণীয় সম্পর্কে।
জীবনের নানা কাজে, নানা মৌসুমে; এমনকি প্রতিটি মুহূর্তেই এ প্রশ্নগুলোর আলোকে সাজাতে হবে আমাদের সফল জীবনকে। অন্যথা জীবন জুড়ে ব্যর্থতা নেমে আসতে বাধ্য। স্রষ্টার বেঁধে দেয়া সবটুকু সময়ই সমান গুরুত্ববহ হলেও জগতের নানা উত্থান-পতনে সময়গুলো আমাদের জীবনে নানা মৌসুমের আগমন ঘটায়। বাংলাদেশের অধিবাসী হিসেবে আমাদের জাতীয় জীবনেও একটা পরিবর্তনের হাওয়া বইছে এখন। আমাদের জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী ২৯ ডিসেম্বর। এর মাধ্যমে এদেশবাসীর প্রত্যেকে নিজ নিজ মতামত ভোটের মাধ্যমে প্রদান করে নির্ধারন করবে যে, আগামী দিনে তারা ব্যক্তি-সমাজ ও দেশের জন্য কোন পদ্ধতি, কোন আদর্শ, কোন ব্যবস্থাকে চায়। যে ব্যবস্থা-আদর্শ-জীবন যাপন পদ্ধতির পক্ষে অধিকাংশ মানুষ ভোট দেবে সে জীবন পদ্ধতিই হবে আগামীর বাংলাদেশের পরিচালনা ব্যবস্থা। পৃথিবীর এ স্বল্পকালীন জীবন শেষে কবরে আমাদেরকে যে তিনটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে বিশ্বাস-কথা-কর্মের ভিত্তিতে, সেগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় প্রশ্নটি আমাদের এই নির্বাচনী মৌসুমের সাথে গভীর সম্পর্ক রাখে।
কি চাই আমরা? কিভাবে দেখতে চাই আগামীর বাংলাদেশকে? কোন আদর্শের রঙে রঙিন দেখতে চাই আমাদের প্রিয় জন্মভূমিকে? ইত্যাদি এসব প্রশ্নগুলোর সাথে আরো একটি প্রশ্নকে মিলিয়ে তারপর চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে আজকের বাংলাদেশের প্রতিজন মানুষকে। তবেই হবে সত্যিকারের মতামত প্রদান। সেই অন্য অথচ মহাজীবনের সাফল্য-ব্যর্থতা নির্ভরশীল প্রশ্নটি হলো- তোমার দ্বীন কী?
দ্বীন শব্দটির অনেকগুলো অর্থ রয়েছে। ড. আবূ বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া বলেন: "যদি তোমাকে প্রশ্ন করা হয়, তোমার দ্বীন কি? উত্তরে বল : আমার দ্বীন হলো ইসলাম, যার মানে - আল্লাহর একত্ববাদকে মেনে নিয়ে সম্পূর্নভাবে তাঁর কাছে আত্নসমর্পণ করা, তাঁর নির্দেশ অনুসরণের মাধ্যমে স্বীকার করা, এবং আল্লাহর ইবাদতে অন্য কিছুর অংশীদারীত্ব করা থেকে মুক্ত থাকা এবং যারা তা করে তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা।" সূত্র: প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য যা জানা একান্ত কর্তব্য Click This Link
উপরোল্লেখিত জবাবে জীবনের যাবতীয় অংশটুকুই শামিল হয়ে যায়। সহজ ভাবে এরূপ যে, যেহেতু ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা এবং ইসলামই হলো একমাত্র সত্য দ্বীন, সেহেতু পরিপূর্ণ জীবনটাই এখানে শামিল হয়ে যায়। এছাড়াও যারা ইসলামের বিরুদ্ধাচরণে বিগত দিনগুলোতে হেন তৎপরতা নেই যা দেখায়নি; এমনকি পূর্ব থেকেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছে যে, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারলে জঙ্গীবাদ দমনের দোহাই দিয়ে সত্যিকারের ইসলাম ও ইসলামপন্থীদের উত্থানকে প্রতিরোধ করবে, তাদেরকে কোনরূপ সন্দেহ সংশয় ছাড়াই আপনার-আমার জন্য অনন্ত পথের প্রথম মঞ্জিলে অপেক্ষমান তিনটি প্রশ্নের জীবন ব্যাপী উত্তর প্রস্তুতের জন্য সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে গ্রহণ করে নিতে পারেন। এবং আসন্ন নির্বাচনে ইসলামের বিপক্ষ শক্তিকে প্রতিরোধের মাধ্যমে আপনি সাধনা করতে পারেন আপনার জন্য অপেক্ষমান দ্বিতীয় প্রশ্ন "তোমার দ্বীন কি?"-এর উত্তর বাস্তবায়নে।
পবিত্র কুরআনে ‘দ্বীন’ (دين) শব্দটির তিন প্রকারের অর্থ এসেছে। প্রথমঃ শক্তি, কর্তৃত্ব, হুকুমাত, রাজত্ব-আধিপত্য এবং শাসন ক্ষমতা। দ্বিতীয়ঃ এর সম্পূর্ণ বিপরীত যথা-নীচতা, আনুগত্য, গোলামী, অধীনতা এবং দাসত্ব। তৃতীয়, হিসেব করা ফায়সালা করা ও যাবতীয় কাজের প্রতিফল দেয়া।" সূত্র: Click This Link
সুতরাং "দ্বীন" এমন একটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ যা আপনার জীবনের প্রতিটি ক্ষুদ্র-বৃহৎ অংশ ও ব্যাপারকে পরিবেষ্টন করে রয়েছে। তাই দুনিয়ার জীবন ও আখেরাতের অনন্ত জীবনের কথা বিবেচনা করে এ মৌসুমে আপনাকে-আমাকে চিন্তা করতে হবে, ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, কোথায় আপনার মূল্যবান রায়টি প্রধান করলে আপনার দুনিয়ার জীবনেও কল্যাণকর হবে, পাশাপাশি আখেরাতের জীবনের প্রথম মঞ্জিল কবরেও সেই দ্বিতীয় প্রশ্ন-"তোমার দ্বীন কি?" –এর উত্তর দেয়াও সহজতর হবে।
উল্লেখ্য যে, এবারের নির্বাচনে দু'টো ভাগ হয়ে গেছে সবগুলো আদর্শ ও সেসবের ধারকেরা। তন্মধ্যে একদিকে রয়েছে ইসলামী ও ইসলামকে ভালবাসে এমন ধারার মানুষেরা এবং অন্যদিকে রয়েছে কুফরী মতবাদ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও নাস্তিক-মুরতাদ ধরনের মানুষেরা। এখন দুনিয়া ও আখেরাতের বিবেচনায় আপনাকে-আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, আমরা আমাদের উভয় জগতের সাফল্য বিবেচনায় কাদের পক্ষ নেব। অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, এ মতামত প্রদান বা ভোট প্রদান কোন অবস্থাতেই ছোট কোন বিষয় নয়; কিংবা "ভোট পঁচে যাবে" এমন ভ্রান্ত ধারনা করা কখনোই উচিত নয়। বরং জানতে হবে ও বুঝতে হবে যে, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ইসলামের পক্ষাবলম্বন করার কারণেই পৃথিবীতে মানুষের "বড় প্রভু" দাবী করা ফিরআওনের স্ত্রী আছিয়া জান্নাতী হবেন। অন্যদিকে নবী লূত 'আলাইহিস্ সালামের স্ত্রী একজন নবীর স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও জাহান্নামী হবে শুধুমাত্র বাতিল, মিথ্যা ও অশ্লীলতার পক্ষে মতামত প্রদানের জন্য। তাই এ সিদ্ধান্তকে গ্রহণ করুন জীবন-মরণ সমস্যার সিদ্ধান্ত হিসেবে এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিন যে, কোন পক্ষাবলম্বন করবেন আপনি- ইসলাম ও ইসলামের স্বপক্ষ জোটের না কি ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও নাস্তিক-মুরতাদ সমষ্টীয় জোটের? অতএব, চিন্তা করুন, ভাবুন এবং বর্জন করুন ইসলাম বিধ্বংসী মতবাদ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও নাস্তিক-মুরতাদ গোষ্ঠীকে। আল্লাহ্ আপনাকে আমাকে ও এদেশে ইসলাম সুরক্ষার সাধনায় লিপ্ত মুজাহিদদের সাহায্য করুন। আল্লাহ্ হেফাযত করুন আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশকে।
২১ ডিসেম্বর ২০০৮, মদীনা মুনাওয়ারা, সউদী আরব।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ডিসেম্বর, ২০০৮ সন্ধ্যা ৭:৪৩