আগের পর্ব: @নবী-রাসূলদের সাথে তাঁদের জাতির লোকদের বিবাদ-সংঘাতের মূল বিষয়: তাওহীদ বা একত্ববাদ(২)
আরবী عبد শব্দের অর্থ গোলাম বা বান্দা। সাধারণ অর্থে 'আবদ তার মনিবের জন্য যা কিছু করে তাই 'ইবাদাত। কিন্তু 'আবদ বা গোলাম যাতে ভুল করে না বসে তাই মনিব তাঁর ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ভালোলাগা-মন্দলাগা ইত্যাদি গোলামকে জানিয়ে ইবাদাতের একটি সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তাই ইবাদাতের সঠিক অর্থ ও তাৎপর্য বুঝতে হলে নিম্নের বিষয়গুলো ভালোভাবে বুঝতে হবে।
ইবাদাতের আভিধানিক অর্থ নম্র ও অনুগত হওয়া। যেমনটি বলা হয়ে থাকে- طًرِيْقٌ مُعَبَّدٌ অর্থাৎ উপযোগী রাস্তা যা পায়দলে চলার কারণে চলাচলের উপযোগী হয়। এটি 'ইবাদাত শব্দের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি উদাহরণ। অর্থাৎ, বান্দা তার মনিবের প্রতি এতটা ভালবাসা পোষণ করবে, এতটা নম্র হবে এবং আনুগত্য প্রকাশ করবে যার কারণে সে তার মনিবের গোলাম হবার উপযোগিতা অর্জন করবে, বান্দা হবার যোগ্যতা প্রমাণ করবে।
শরীয়তের পরিভাষায় ইবাদাত হলো: "আল্লাহ্ তা'আলা ভালবাসেন এবং পছন্দ করেন এমন সকল প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য কথা ও কাজের ব্যাপক একটি নাম।"
অর্থাৎ, শুরুতে বলা কথা- "বান্দা তার মনিবের জন্য যা কিছু করে থাকে তাই ইবাদাত" এ কথাটির সীমারেখা নির্ধারিত হয়েছে উপরোক্ত ব্যাখ্যায়। এখানে মনিব কি ভালবাসেন, কি পছন্দ করেন; মনিবের পক্ষ থেকে পাঠানো আদেশপত্র বা বাণী থেকে সেসব উদ্ধার করে সে অনুযায়ী যা কিছু করা হবে তাই ইবাদাত হিসেবে গণ্য হবে।
মূলত: তিনটি রুকন বা স্তম্ভের উপর ইবাদাতের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনুল কারীমে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা রয়েছে। স্তম্ভ তিনটি যথাক্রমে-
এক) মা'বূদ তথা আল্লাহ্ তা'আলার জন্য পরিপূর্ণ ভালবাসা পোষণ করা। যেমন পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে:
وَالَّذِينَ آمَنُواْ أَشَدُّ حُبّاً لِّلّهِ
"আর যারা ঈমান এনেছে, তারা আল্লাহকে সর্বাধিক ভালবাসে।" [সূরা আল-বাকারাহ্: ১৬৫]
অন্তরের স্বীকৃতি পেলেই মানুষ কোন কিছুকে বিশ্বাস করে থাকে, আর যা কিছুতে অন্তর স্বীকৃতি দিয়ে থাকে সেসব কিছু অন্তরে কোন না কোনভাবে কমবেশী নিজের অবস্থান করে নিতে সক্ষম হয়। আর তা যদি হয় আপন স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস, তাহলে তাতে আরো অসংখ্য বিষয়ের মত ভালবাসা যুক্ত হয়; বরং এ বিশ্বাসে ভালবাসার মাত্রা থাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের। তাই বান্দা যখনি তার প্রকৃত স্রষ্টা ও প্রতিপালককে চিনতে পারবে, তখন তাঁকে জীবনের সবকিছুর চাইতেও বেশী ভালবাসবে, তাঁর ভালোলাগা-মন্দলাগা, পছন্দ-অপছন্দ ইত্যাদিকে জানার জন্য প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালাবে, অবশেষে যা কিছু সে তার মহামনিবের জন্য নিবেদন করবে তার পুরোটুকুই থাকবে বিশুদ্ধ ভালবাসায় মোড়ানো। আর এটাই আমাদের প্রতিপালক ও মা'বূদের ইবাদাতের প্র্রথম স্তম্ভ।
দুই) পরিপূর্ণ আশা পোষণ করা। যেমনটি মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে বলা হয়েছে-
وَيَرْجُونَ رَحْمَتَهُ
"এবং তারা তাঁর দয়া প্রত্যাশা করে।" [সূরা আল-ইসরা: ৫৭]
যাঁকে একজন মানুষ তার স্রষ্টা, প্রতিপালক ও ইবাদাত প্রদানের জন্য একমাত্র যোগ্য সত্তা হিসেবে চিনতে পেরেছে, যাঁর প্রতি অন্তরের পরিপূর্ণ আস্থা সহকারে বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং যাঁকে তার জীবনের যাবতীয় ভালো-মন্দের প্রবর্তক ও পরিচালক হিসেবে মেনে নিয়েছে, তেমন সত্তার নিকট আশা ও দয়ার আকাঙ্খা করা খুব স্বাভাবিক। আমাদের প্রতিপালকের নিকট এ বিষয়টি খুবই পছন্দনীয় যে, বান্দা তাঁর নিকট দয়া প্রত্যাশা করবে। এবং তাঁর কাছে দয়া প্রত্যাশার মত এত পরিপূর্ণ প্রত্যাশা বান্দা আর কারো নিকট করবে না। তাই আল্লাহ্ তা'আলা তাঁর ইবাদাতের জন্য বান্দার চাওয়ার বিষয়গুলোকে দ্বিতীয় স্তম্ভ হিসেবে নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
তিন) আল্লাহকে পরিপূর্ণভাবে ভয় করা। তিনি তাঁর বাণী আল-কুরআনে বলেন:
وَيَخَافُونَ عَذَابَهُ
"এবং তারা তাঁর শাস্তিকে ভয় করে।" [সূরা আল-ইসরা: ৫৭]
এ তৃতীয় স্তম্ভে রয়েছে তাঁর অবাধ্যতার বিষয়ে সতর্কবাণী। কেননা, তিনি শুধুমাত্র ভালবাসা এবং দয়া প্রদর্শনের পাত্রই নন; বরং তিনি তাঁর অবাধ্যদের প্রতি অত্যন্ত কঠোরও বটেন। দয়া এবং শাস্তির বিষয়টি এ কারণে যে, আল্লাহ্ আমাদের সৃষ্টি করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন একটা স্বল্প মেয়াদী সময়কালের জন্য শুধুমাত্র এ জন্য যে, তিনি আমাদের পরীক্ষা নেবেন। এ সময়কাল সম্পর্কে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন যে, وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ "এবং আমি জিন ও মানুষকে শুধুমাত্র আমার ইবাদাত ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্য সৃষ্টি করিনি।" [সূরা আয-যারিয়াত: ৫৬] আর ইবাদাত কি এবং কিভাবে তা আমাদের জীবনে পরীক্ষার বিষয় হয়ে উঠেছে তা এ প্রবন্ধে আসা ইবাদাতের ব্যাখ্যা এবং উপরোক্ত আয়াতে পরিস্ফুট হয়েছে। তাই বান্দা তার পরীক্ষার বিষয় "ইবাদাত"-এর ক্ষেত্রে তার স্রষ্টা এবং মা'বূদ এক ও একক আল্লাহর জন্য অন্তরে ও কর্মে ইখলাছ বা একনিষ্ঠতা অবলম্বন করে কি না তা এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ কারণে ইবাদাতের স্তম্ভসমূহের মধ্যে এ বিষয়টিও যুক্ত হয়েছে, যাতে আল্লাহর অবাধ্যতার পরিণাম সম্পর্কে তাঁকে যথার্থ ভয় করার বিষয় উল্লেখিত হয়েছে।
মূলত: যে কোন সম্মানিত জনের সাথে মৌলিক ভাবে তিনটি বিষয় সম্পর্কযুক্ত হতে পারে, যা ইবাদাতের উপরোল্লেখিত তিনটি স্তম্ভে উদ্ধৃত হয়েছে। কেননা, আল্লাহ্ তা'আলা এমন কোন নীতি আমাদের উপর চাপিয়ে দেননি, যা আমাদের বুঝে আসার মত নয়। অতএব, আমাদের উচিত ইবাদাতের তিনটি রুকনকে মজবুত রেখে আল্লাহর ইবাদাত সুসম্পন্ন করার প্রাণান্ত সাধনা করা।
১৭ জুন ২০০৮, মদীনা মুনাওয়ারা, সউদী আরব।