আগের পর্ব: @নবী-রাসূলদের সাথে তাঁদের জাতির লোকদের বিবাদ-সংঘাতের মূল বিষয়: তাওহীদ বা একত্ববাদ(১)
মহান আল্লাহ্ তা'আলা পবিত্র কুরআনুল কারীমে আমাদেরকে অবহিত করেছেন যে, যুগে যুগে বিভিন্ন জাতি তাদের নবীগণের সাথে কি কারণে বিবাদ-লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছিল। ইসলামের প্রথম রাসূল নূহ 'আলাইহিস্ সালামের জাতিকে যখন তিনি আল্লাহর একত্ববাদের প্রতি আহ্বান করেন, তখন তারা জবাবে বলেছিল:
وَقَالُوا لَا تَذَرُنَّ آَلِهَتَكُمْ وَلَا تَذَرُنَّ وَدًّا وَلَا سُوَاعًا وَلَا يَغُوثَ وَيَعُوقَ وَنَسْرًا * وَقَدْ أَضَلُّوا كَثِيرًا وَلَا تَزِدِ الظَّالِمِينَ إِلَّا ضَلَالًا
((আর তারা বলেছিল, 'তোমরা কখনো পরিত্যাগ করো না তোমাদের উপাস্যদেরকে, পরিত্যাগ করো না ওয়াদ্, সুওয়া', ইয়াগুছ, ইয়া'ঊক ও নাসরকে'। এরা অনেককে বিভ্রান্ত করেছে। সুতরাং যালেমদের বিভ্রান্তি ব্যতীত আর কিছুই বৃদ্ধি করো না।)) [সূরা নূহ: ২৩-২৪] নূহ 'আলাইহিস্ সালামের জাতির লোকেরা তাঁর সাথে বিবাদ-বিসম্বাদে লিপ্ত হয়েছিল শুধুমাত্র এক আল্লাহর ইবাদাতের প্রতি আহ্বানের বিপরীতে তাদের উল্লেখিত দেব-দেবী উপাস্যগুলোর ইবাদাতে অন্ধভাবে অটল থাকার প্রেক্ষিতে; উপরের আয়াত থেকে সেকথা পরিস্কার হলো।
নবী হূদ 'আলাইহিস্ সালামের জাতির লোকদের ভাষ্য সম্পর্কে আল্লাহ্ আমাদেরকে অবহিত করছেন:
قَالُوا أَجِئْتَنَا لِتَأْفِكَنَا عَنْ آَلِهَتِنَا فَأْتِنَا بِمَا تَعِدُنَا إِنْ كُنْتَ مِنَ الصَّادِقِينَ
((তারা বলেছিল, আপনি কি আমাদের উপাস্যদের (পূজা) থেকে আমাদেরকে ফিরিয়ে দিতে এসেছেন? আপনি সত্যবাদী হলে আমাদেরকে যে বিষয়ের ওয়াদা দিচ্ছেন তা আনয়ন করুন।)) [সূরা আল-আহক্বাফ: ২২] এখানেও জাতির লোকদের সাথে নবীর আর কোন পার্থিব-অপার্থিব বিষয়ে নয়; বরং ইবাদাত কার জন্য নিবেদিত হবে- এক আল্লাহ্ না কি অসংখ্য কল্পিত মা'বূদের জন্য, বিরোধের মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে একমাত্র এটিই।
নবী সালেহ্ 'আলাইহিস্ সালাম ও তাঁর তাওহীদের দাওয়াত সম্পর্কে তাঁর জাতির লোকেরা বললো:
قَالُوا يَا صَالِحُ قَدْ كُنْتَ فِينَا مَرْجُوًّا قَبْلَ هَذَا أَتَنْهَانَا أَنْ نَعْبُدَ مَا يَعْبُدُ آَبَاؤُنَا وَإِنَّنَا لَفِي شَكٍّ مِمَّا تَدْعُونَا إِلَيْهِ مُرِيبٍ
((তারা বললো, হে সালেহ্! এর পূর্বে আপনি ছিলেন আমাদের মধ্যে আশা-ভরসার স্থল। আপনি কি আমাদেরকে নিষেধ করছেন তাদের ইবাদাত করা হতে, যাদের ইবাদাত করতো আমাদের পিতৃ-পুরুষেরা? আমরা অবশ্যই গুরুতর সন্দেহের মধ্যে রয়েছি সে বিষয়ে, যার প্রতি আপনি আমাদেরকে আহ্বান করছেন।)) [সূরা হূদ: ৬২] গোটা জাতি স্বীকৃতি দিচ্ছে যে, নবী তাওহীদের প্রতি আহ্বান করার পূর্ব পর্যন্ত ছিলেন জাতির একমাত্র আশা-ভরসার স্থল। অথচ এক আল্লাহর একত্ববাদের প্রতি দাওয়াত দানের সাথে সাথেই জাতির লোকেরা শত্রুতে পরিণত হতে শুরু করলো। এ থেকে প্রমাণিত যে, দুনিয়ার কোন স্বার্থ বা কর্তৃত্বের লাভালাভের জন্য নয়; রবং শুধুমাত্র তাওহীদের প্রতি আহ্বানই ছিল নবী-রাসূলগণের অপরাধ(?) তাদের জাতির দৃষ্টিতে, যার কারণে তারা নবীর প্রতি সম্মিলিত শত্রুতা পোষণ করেছিল।
আল্লাহর নবী শু'আইব 'আলাইহিস্ সালাম; যাঁর সম্পর্কে তাঁর জাতি কর্তৃক স্বীকৃত যে, তিনি একজন সহিষ্ণু ও ভালো মানুষ, অথচ একত্ববাদ ও সে অনুযায়ী জীবন গড়ার প্রতি জাতিকে আহ্বান করার ফলশ্রুতিতে জাতির লোকেরা তাঁকে এ বলে বিবাদের সূত্রপাত ঘটায় যে:
قَالُوا يَا شُعَيْبُ أَصَلَاتُكَ تَأْمُرُكَ أَنْ نَتْرُكَ مَا يَعْبُدُ آَبَاؤُنَا أَوْ أَنْ نَفْعَلَ فِي أَمْوَالِنَا مَا نَشَاءُ إِنَّكَ لَأَنْتَ الْحَلِيمُ الرَّشِيدُ
((তারা বললো, হে শু'আইব! আপনার সালাত কি আপনাকে নির্দেশ দেয় যে, আমাদের পিতৃ-পুরুষেরা যার ইবাদাত করত আমাদেরকে তা বর্জন করতে হবে অথবা আমরা আমাদের ধন-সম্পদে ইচ্ছেমত যা কিছু করে থাকি তাও ছেড়ে দিতে হবে? আপনি তো একজন সহিষ্ণু, ভালো মানুষ।)) [সূরা হূদ: ৮৭]
সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী এবং রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে তাঁর স্বজাতীয় কুরাইশরা যে আচরণ করেছে, সে সম্পর্কে আল্লাহ্ কুরআনে উল্লেখ করছেন:
وَعَجِبُوا أَنْ جَاءَهُمْ مُنْذِرٌ مِنْهُمْ وَقَالَ الْكَافِرُونَ هَذَا سَاحِرٌ كَذَّابٌ * أَجَعَلَ الْآَلِهَةَ إِلَهًا وَاحِدًا إِنَّ هَذَا لَشَيْءٌ عُجَابٌ * وَانْطَلَقَ الْمَلَأُ مِنْهُمْ أَنِ امْشُوا وَاصْبِرُوا عَلَى آَلِهَتِكُمْ إِنَّ هَذَا لَشَيْءٌ يُرَادُ * مَا سَمِعْنَا بِهَذَا فِي الْمِلَّةِ الْآَخِرَةِ إِنْ هَذَا إِلَّا اخْتِلَاقٌ
((এরা বিস্ময় বোধ করছে যে, এদের নিকট এদের মধ্য হতে একজন সতর্ককারী আগমন করলেন। আর কাফেররা বললো: এ তো এক মিথ্যাবাদী যাদুকর। সে কি বহু ইলাহকে এক ইলাহ্ বানিয়ে নিয়েছে? এ তো এক অত্যাশ্চর্য ব্যাপার! তাদের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা একথা বলে প্রস্থান করে যে, তোমরা চলে যাও এবং তোমাদের উপাস্যদের পূজায় দৃঢ় থাক। নিশ্চয়ই এ ব্যাপারটি উদ্দেশ্যমূলক। আমরা তো অন্য ধর্মাদর্শে এরূপ কথা শুনিনি। এ এক মনগড়া উক্তি মাত্র।)) [সূরা সাদ: ৪-৭] অথচ এই লোকেরাই জীবনের চল্লিশটি বছর এ ব্যক্তিকে (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) 'আল-আমীন' বা পরম বিশ্বাসী বলে জানতো, নিজেদের সমস্যাবলীতে ফয়াসালা করার জন্য তাঁর শরণাপন্ন হতো।
আল্লাহ্ আরো জানাচ্ছেন:
وَإِذَا رَأَوْكَ إِنْ يَتَّخِذُونَكَ إِلَّا هُزُوًا أَهَذَا الَّذِي بَعَثَ اللَّهُ رَسُولًا * إِنْ كَادَ لَيُضِلُّنَا عَنْ آَلِهَتِنَا لَوْلَا أَنْ صَبَرْنَا عَلَيْهَا وَسَوْفَ يَعْلَمُونَ حِينَ يَرَوْنَ الْعَذَابَ مَنْ أَضَلُّ سَبِيلًا * أَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَهَهُ هَوَاهُ أَفَأَنْتَ تَكُونُ عَلَيْهِ وَكِيلًا * أَمْ تَحْسَبُ أَنَّ أَكْثَرَهُمْ يَسْمَعُونَ أَوْ يَعْقِلُونَ إِنْ هُمْ إِلَّا كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ سَبِيلًا
((তারা যখন আপনাকে (নবীকে) দেখে, তখন তারা আপনাকে কেবল ঠাট্টা-বিদ্রূপের পাত্ররূপে গণ্য করে, বলে: এ-ই কি সে যাকে আল্লাহ্ রাসূল করে পাঠিয়েছেন? সে তো আমাদেরকে আমাদের উপাস্যগণ হতে দূরে সরিয়েই দিত, যদি না আমরা তাদের আনুগত্যের উপর অবিচল থাকতাম। আর যখন তারা শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে, তখন জানতে পারবে কে অধিক পথভ্রষ্ট। আপনি কি তাকে দেখেছেন, যে তার প্রবৃত্তিকে ইলাহরূপে গ্রহণ করে? তবুও কি আপনি তার যিম্মাদার হবেন? না কি আপনি মনে করেন যে, তাদের অধিকাংশ শোনে ও বোঝে? তারা তো পশুর মতই, বরং তারা (সে পর্যায়ের চাইতেও) অধিক পথভ্রষ্ট।)) [সূরা আল-ফুরকান: ৪১-৪৪] আহা! এ কথাগুলো কি তারা সেই মহান ব্যক্তি সম্পর্কে বলেনি, যাঁর কাছে তারা ইতিপূর্বে কা'বা শরীফের ঐতিহাসিক কালো পাথর স্থাপনে অংশীদারিত্বের বিবাদ মীমাংসার জন্য গিয়েছিল। চার গোত্র মিলে সমগ্র জাতির মধ্যে যারা তাঁকেই একমাত্র সুবিচারক হিসেবে নির্বাচন করলো নিজেদের কর্তৃত্বের বিবাদ নিরসনের জন্য। অতএব, তাদের পূর্বাপর কথানুযায়ী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবী হবার পর তাঁর সাথে বিবাদের একমাত্র মূল কারণ ছিল তাওহীদ বা একমাত্র আল্লাহর ইবাদাতের প্রতি দাওয়াত।
নবীর সাথে জাতির লোকদের লড়াই আর অন্য কোন কারণে ছিল না শুধুমাত্র তাওহীদুল্ উলুহিয়্যাহ্ বা ইবাদাতে একত্ববাদ ব্যতীত। এ সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَشْهَدُوا أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ وَيُقِيمُوا الصَّلَاةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ فَإِذَا فَعَلُوا ذَلِكَ عَصَمُوا مِنِّي دِمَاءَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ إِلَّا بِحَقِّ الْإِسْلَامِ وَحِسَابُهُمْ عَلَى اللَّهِ
((আমাকে মানুষের সাথে ততক্ষণ পর্যন্ত লড়ে যাওয়ার জন্য আদেশ করা হয়েছে, যতক্ষণ না তারা এ কথার সাক্ষ্য প্রদান করে যে, আল্লাহ্ ছাড়া সত্যিকার কোন মা'বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল, আর সালাত কায়েম করে ও যাকাত প্রদান করে। অতঃপর যখনই তারা সে কাজগুলো করবে, তখনই আমার থেকে স্বীয় জান-মাল রক্ষা করে নেবে, ইসলামের হক্ক ব্যতীত। আর তাদের হিসাব-নিকাশের দায়িত্ব আল্লাহর উপর।)) [বুখারী: ২৫, মুসলিম: ২২] এখানে "ইসলামের হক্ক" বলতে ইসলামী দণ্ডবিধিকে বুঝানো হয়েছে, কেননা এর আওতায় এসে গেলে অপরাধীর জন্য আর হাদীসে উল্লেখিত নিরাপত্তা থাকছে না।
উপরোল্লেখিত প্রমাণাদিগুলো অতীত জাতিসমূহ তাদের নবীদের সাথে এবং আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্বজাতি তাঁর সাথে যে কারণে বিবাদ-বিসম্বাদ ও লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছিল, সে সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিকে উন্মোচন করে দিচ্ছে। সকল নবী-রাসূল 'আলাইহিমুস্ সালাম-এর সাথেই বিবাদের যে কারণ ঘটেছিল, তা আর কিছুই নয়; শুধুমাত্র তাওহীদুল্ উলুহিয়্যাহ্ বা ইবাদাতে একত্ববাদ। যেখানে বলা হয়ে থাকে যে, মানুষ তার জীবনের যাবতীয় ইবাদাতকে নির্দিষ্ট করবে শুধুমাত্র, একমাত্র, কেবলমাত্র এক আল্লাহ্ সোবহানাহু ওয়াতা'আলার জন্য এবং অন্য সকল কল্পিত মা'বূদকে অস্বীকার করবে।
০৯.০৪.২০০৮, মদীনা মুনাওয়ারা, সউদী আরব।
পরের পর্ব: @ ইবাদাতের অর্থ ও বুনিয়াদ
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুন, ২০০৮ দুপুর ২:৫৮