আগের পর্ব পড়ুন।
কর্তৃপক্ষ ও সকল ব্লগারদে প্রতি- (এটি আমার জবাবের ২য় অংশ)
ব্লগের নীতিমালা অনুযায়ী সবাই সুন্দর ও সুষ্ঠু পন্থায় নিজ নিজ মত ও আদর্শের কথা বলার অধিকার রাখে। ব্লগার "সুশীল সমাজ" আমার মত ও আদর্শের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে, তাই আমি আমার প্রাপ্য অধিকার নিয়েই এই লেখা দিয়েছি। এবং আমি আশা করবো র্কতৃপক্ষ তাদের ঘোষিত নীতিতে অটল থাকবেন ও ব্লগারবৃন্দ মানুষের সাধারণ নীতি-নৈতিকতার মানদণ্ডে আমার এ লেখার বৈধতা এবং এতে উঠে আসা বাস্তব সত্যকে উপলব্ধি করতে সচেষ্ট হবেন। ধন্যবাদ।
মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কাফেরদের কৃত আচরণ ও তার জবাব:
(১)
وَأَنْذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ
((আপনার নিকট-আত্মীয়বর্গকে সতর্ক করে দিন।)) [সূরা আশ্-শু'আরা: ২১৪]
মহানবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর রব-এর নিকট হতে এমন আদেশপ্রাপ্ত হয়ে মক্কার সাফা পাহাড়ে উঠে তাঁর নিজ বংশের কুরাইশদেরকে ডাকতে শুরু করলেন: ইয়া সাবাহাহ্! ইয়াসাবাহ্! লোকেরা আসলে তিনি বললেন: "তোমরা বলো, যদি আমি তোমাদের বলি যে, পাহাড়ের ওদিকের প্রান্তরে একদল ঘোড়সওয়ার আত্মগোপন করে আছে, ওরা তোমাদের উপর হামলা করতে চায়, তোমরা কি সে কথা বিশ্বাস করবে? সকলে বলল: হাঁ, বিশ্বাস করবো, কারণ আমরা আপনাকে কখনো মিথ্যা বলতে শুনিনি। তখন তিনি বললেন: "আমি তোমাদেরকে এক ভয়াবহ আযাবের ব্যাপারে সাবধান করতে প্রেরিত হয়েছি"। সাথে সাথে তাঁর আপন চাচা আবূ লাহাব বলল: তুমি ধ্বংস হও! তুমি আমাদেরকে একথা বলার জন্য এখানে ডেকেছ? [দেখুন-বুখারী: ২য় খণ্ড, পৃ-৭০৬, ৭৪৩, মুসলিম: ১ম খণ্ড, পৃ-১১৪, আর্-রাহীকুল মাখতূম: পৃ-৯৪-৯৫]
(২)
فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِينَ
((অতএব, যে বিষয়ে আদেশপ্রাপ্ত হয়েছেন তা প্রকাশ্যে প্রচার করুন এবং মুশরিকদের উপেক্ষা করুন।)) [সূরা আল-হিজর: ৯৪] এটাই ছিল প্রকাশ্য দাওয়াত দানের আদেশ। সত্য দ্বীন ইসলামের প্রতি প্রকাশ্য এ দাওয়াতের প্রেক্ষিতে মক্কার কাফের-মুশরিকরা সত্য নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছিল।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোথাও যেতেন, তখন তাঁর সামনে-পেছনে দুর্বল ও অত্যাচারিত সাহাবায়ে কেরাম থাকতেন, তখন পৌত্তলিকরা ঠাট্টা করে বলতো, ((আল্লাহ্ কি তোমাদের উপর অনুগ্রহ করলেন?)) [দেখুন- আর্-রাহীকুল মাখতূম: পৃ-৯৯]
(৩)
নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম কা'বা ঘরের পাশে সালাত আদায় করছিলেন, আবূ জাহেল গ্রুপের এক দুস্কৃতিকারী ওকবা ইবনে মুঈত রাসূলের সিজদারত মাথার উপর উটের নাড়িভুঁড়ি ঝুলিয়ে রাখলো। আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু বলেন, দুর্বৃত্তরা হাসছিল আর রাসূল সিজদা থেকে মাথা তোলেননি, সেভাবেই পড়ে রইলেন। খবর পেয়ে ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু 'আনহা ছুটে এলেন এবং সেগুলো সরালেন। প্রিয় রাসূল সেদিন বললেন: الَّهم عليك بقريش! ((হে আল্লাহ! কুরাইশের দায়িত্ব আপনার উপর!)) কাফেররা নাখোশ হলো, তারপর নবী নাম ধরে ধরে বদদো'আ করলেন: ((হে আল্লাহ্! আবূজাহলকে পাকড়াও করুন! ওতবা ইবনে রবী'আ, শাইবা ইবনে রবী'আ, ওলীদ ইবনে ওতবা, উমাইয়া ইবনে খালাফ এবং ওকবা ইবনে আবূ মঈতকেও পাকড়াও কর!)) [দেখুন- আর্-রাহীকুল মাখতূম: পৃ-১০৪]
রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে কাফেরদের এ জাতীয় অত্যাচারে একেবারে চুপ ছিলেন তা কিন্তু নয়; বরং উবাই ইবনে খালাফ রাসূলকে প্রায়ই হত্যার হুমকি দিত। জবাবে প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন: ((তুমি নও; বরং আমিই তোমাকে হত্যা করবো ইনশাআল্লাহ।)) এরপর ওহুদের যুদ্ধে রাসূল এক সাহাবীর হাত থেকে একটি বর্শা নিয়ে উবাইয়ের প্রতি নিক্ষেপ করেন। [বিস্তারিত দেখুন- আর্-রাহীকুল মাখতূম: পৃ-১৩৭]
জামায়াতে ইসলামীর সাথে কৃত আচরণ ও জবাবের নমুনা:
আমি হাজারো লাখো ঘটনা প্রবাহ থেকে মাত্র কয়েকটি ঘটনাকে তুলে এনেছি তুলনার স্বার্থে যে, বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলনের প্রতি যে অপবাদ দেয়া হচ্ছে যে, তারা ইসলাম বিরোধী; এর যথাযথ জবাব দানের জন্য।
(১) নং ঘটনার প্রতি লক্ষ্য করুন, আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত দানের আদেশ প্রাপ্ত হয়েছেন আল্লাহর রাসূল, আর প্রথম দিনের দাওয়াতে সর্বপ্রথমই বিরোধিতা কণ্ঠ উচ্চ করলো তাঁর আপন চাচা, অর্থাৎ প্রথম বাধাটা আসলো ঘর থেকে।
জামায়াত-শিবিরের ভাইদের বেলায়ও এরকম হাজারো লাখো ঘটনা শুনতে পাবেন যেখানে তাদের অন্য কোন অপরাধ, বদভ্যাস বা খারাপ আচরণের কোন প্রমাণ পরিবারের লোকেরা দেখাতে পারে না; একটাই অপরাধ ইসলামী আন্দোলন করছে। তাই প্রবল বাধা আসে তাদের জন্য নিজ নিজ ঘর, আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে।
আমি নিজেই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ, দেশে থাকাকালীন ইসলামকে একটা সামাজিক রীতিনীতির মতই মনে করতাম; এর মাঝে যে জীবনের জন্য সবচেয়ে বড় বিপ্লব লুক্কায়িত আছে তা কোনদিন জানতেও পারিনি; না শিক্ষায়, না সামাজিকতায়। তাই প্রবাসী হবার দ্বিতীয় বর্ষেই এক আল্লাহর বান্দার প্রচেষ্টায় বুঝতে সক্ষম হই যে, ইসলাম আমার জন্য কতটুকু এবং কি? তারপর নিজের যৎসামান্য বুঝটুকু পুঁজি করে পরিবারকে, আত্মীয়দেরকে চিঠি লিখতাম। সশরীরে তো উপস্থিত হই-ই নাই, চিঠি পেয়েই এলাকাব্যাপী প্রচার করতে শুরু করেছে পরিবার-আত্মীয়রা যে, আমি নাকি পাগল হয়ে গেছি, আমি না কি কাজকর্ম ছেড়ে ছুড়ে মানুষকে বুঝানোর জন্য রাস্তায় রাস্তায় ফিরছি। অথচ আমার জীবনে কিছু ইবাদাত, কিছু পড়াশোনা আর কিছু সামাজিক আচরণরীতিতে পরিবর্তন আসা ছাড়া তেমন কিছু ঘটেনি। বহুদিন সাধনার পর পরিবারকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছি যে, এটা ইসলাম এবং আমি ইসলামের উপর আছি আলহামদুলিল্লাহ্।
(২) নং ঘটনায় বলা প্রকাশ্য দাওয়াতের ক্ষেত্রে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা কি পরিমাণ গালমন্দ, অপমান এমনকি মারধোর পর্যন্ত সহ্য করে যাচ্ছে, তা স্বদেশে যারা আছেন তারাই নিজ নিজ এলাকা দেখছেন। আর যারা এসব অত্যাচার করে যাচ্ছেন, তারা হয়ত এ লেখায় এসেও তেমন অত্যাচার করতে দ্বিধা করবেন না এবং এটাই ঐতিহ্য হয়ে আসছে মুমিনদের জন্য।
একটা ব্যাপার- সাহাবায়ে কেরামের সময়ে ঘটেনি যা বর্তমানে আমাদের জন্য ঘটছে এবং যা আমাদের জন্য চরম কষ্টদায়ক যে, সাহাবায়ে কেরামের সাথে যারা ইসলাম প্রসঙ্গে বিরোধিতা করেছিল তারা ছিল মুশরিক, কাফের আর আজকের যুগে আমাদের সাথে যারা ইসলাম প্রসঙ্গে; এমনকি ইসলামেরও বিরোধিতা করছে, তাদের মধ্যে বিরাট অংশ মুসলমানদের সন্তান! এটাই আফসোস!
আপনারা দেখুন নিজ নিজ সমাজের দিকে তাকিয়ে, ইসলামী আন্দোলন করে বলে মুখে দাড়ি রেখেছে, সেজন্য ঠাট্টা করছে; এমনকি আমি যখন আঠারোতে দাড়ি রাখার সিদ্ধান্ত নেই, তখন পরিচিত নাপিত একটা ভরা মজলিসে আমাকে বললো: "চেহারাটা শয়তানের মত করে ফেললে কেন?" অথচ এই নাপিতই আমার কত প্রশংসা করে আসছিল এতদিন। তারপর চুলকাটাতে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম যে, "....... ভাই, শয়তানের চেহারাটা দেখতে কেমন?" আমি তার হাতে কম্পন দেখতে পেলাম, সে চুল কাটা বন্ধ করে দিচ্ছিল প্রায়, তার হাত থেকে কাঁচি পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। আমি বুঝলাম, মুমিনদের নিকট শয়তানরা এভাবেই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। অন্য কথা বলে তাকে স্বাভাবিক করলাম। আজো এই ব্লগেই তো পুরোনো সকল গালির ভাণ্ডার উজাড় করে নতুন নতুন গালি আবিস্কার করা হচ্ছে জামায়াত-শিবিরের জন্য। অথচ জবাবে কি দেখতে পাচ্ছেন? জামায়াত-শিবিরের লোকেরা এখানে যে সহনশীলতার পরিচয় দিচ্ছে, বাস্তবে তার চাইতে আরো লক্ষগুণ বেশী সহনশীল তারা। কেননা, এখানে মারের ভয় নাই, নিহত হবার আশংকা নাই তাহলে তারা কেন এখানে প্রাণ উজার করে গালাগালির জবাবে গালাগালি করছে না?
অতএব, বুঝে নিন যে, তারা বাস্তবিকই শালীন আর এ শালীনতার শিক্ষা তাদেরকে দিয়েছে ইসলাম, আল্লাহর রাসূলের মহৎ জীবন ও তা থেকে পাওয়া শিক্ষা। এই তো সেদিন মাত্র তিনজন ব্লগার ক্ষেপলো গালিবাজদের বিরুদ্ধে, পরিণামে কি হলো, ব্লগের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা ঘটলো। তাহলে হিসাব মিলিয়ে দেখুন, বাস্তবের হাজারগুণ শালীন ও ধৈর্য্যশীলরা যদি ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলনের বিরোধিতাকারীদের বিরুদ্ধে এরূপ সোচ্চার হয়ে উঠে, তবে দেশের কি হাল হবে; চিন্তা করুন?
(৩) নং ঘটনায় দেখুন, আল্লাহর রাসূলকে কিভাবে অপমান করা হলো, তিনি কত কষ্ট পেয়েছেন মনে যে কারণে সেদিন সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমতের নবী কাফের-মুশরিকদের নাম ধরে ধরে বদদো'আ করলেন। অথচ সবাই নবীর তায়েফে ঘটিত রক্তাক্ত শরীরে কাফেরদের জন্য দো'আকেই ফলোআপ করে থাকেন। রহমতের নবী ও তাঁর সাহাবীগণের ব্যাপারে তো স্বয়ং আল্লাহ্ বলেছেন:
مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ
((মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল; তাঁর সহচরগণ কাফেরদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল।)) [সূরা আল-ফাতহ্: ২৯]
তাহলে এবার মিলিয়ে দেখুন, শিবিরের যে ছেলেটিকে হত্যা করা হয়েছে (শতক তো ক'বেই পেরিয়ে গেছে বাংলাদেশের শহীদের মিছিলে), কি ছিল তার অপরাধ? খোঁজ নিয়ে দেখুন পরিবারে, এলাকায়, কোন অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল? সমাজের অপকর্মগুলোতে তার কোন অনুপ্রবেশ ছিল কি না? আচরণে-ব্যবহারে সে কেমন ছিল? সত্যবাদীতায়-সৎসাহসে সে কতটা দুর্নিবার ছিল? ইবাদাতে-সৎকাজে সে কতটা অগ্রগামী ছিল? আসলে অপরাধ আর কিছু নয়; অপরাধ হলো সে ইসলামী আন্দোলন করে অতএব তার কণ্ঠ চিরতরে রোধ করে দিতে হবে, ব্যস!
সুতরাং, দৃষ্টিকে প্রসারিত করুন, বোধকে জাগ্রত করুন এবং দেখুন কেউ কি আপনাকে আপনার প্রিয় দ্বীন ইসলামের বিরুদ্ধে আপনাকেই ব্যবহার করছে কি না? সত্যিকারের ইসলাম কি যা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের জন্য বয়ে এনেছিলেন এবং বর্তমানেও কারা সেই মহান সত্যের উপর দাঁড়িয়ে; তা বিচার করুন সকল পক্ষপাতকে উপেক্ষা করে। এবং নিজেকে হেফাযত করুন অপপ্রচার ও বিভ্রান্তকারীদের বিভ্রান্তি থেকে। আল্লাহ্ আপনাকে-আমাকে সকলকে তৌফিক দিন।
(শেষ হয়নি)
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জানুয়ারি, ২০০৮ রাত ৩:৩৪