(১)
কয়েকদিন আগে দেখলাম জামালপুরে এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন পরীক্ষা শুরুর অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই কেন্দ্রের বাইরে বের হয়ে এসেছে ।
এমন ঘটনা অধিকাংশ পাবলিক পরীক্ষার কেন্দ্রেই বহুদিন ধরে ঘটছে । ধরা পড়াটাই দুর্ঘটনা, ধরা না পড়াটা দক্ষ ম্যানেজমেন্টের উদাহরণ । ধরা পড়লেই চোর, নইলে সবাই সাধু ।
মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, পরীক্ষার হল থেকে প্রশ্ন বের হয়ে যায় কীভাবে, কেন ? কারা কেন্দ্রের বাইরে বসে সেগুলির সমাধান করে পরীক্ষার হলে সাপ্লাই দেয় ? কারা পরীক্ষা কেন্দ্রের বিভিন্ন কক্ষে গোপনে ও নিঃশব্দে পৌঁছে দেয় সাময়িক উপকারি কিন্তু শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন ধ্বংশকারি এই স্টেরয়েড ?
(২)
পাশের হার বাড়ানোতেই আজ যত কৃতিত্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির, এ জাতির শিক্ষা ব্যবস্থার । সংগে যদি থাকে জিপিএ ফাইভের আধিক্য, তাহলেতো একাদশে বৃহস্পতি ।
শিক্ষায় কোয়ালিটি নয়, কোয়ানটিটিই যেন আজ পরম ঈপ্সিত বস্তু ।
এ কারণেই প্রকৃত শিক্ষাবিদরা যখন ক্রমাগত পড়ালেখার মান নিম্নমুখি বলে রায় দিচ্ছে, জাতি দেখছে ঊর্দ্ধমুখি পাশের হার ।
এ কথা আজ ওপেন সিক্রেট যে বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পাশের হার বাড়িয়ে নিজেদের সুনামটিকে চকচকে রাখার জন্য পরীক্ষা কেন্দ্রে পরীক্ষার্থীদের মধ্যে অবৈধ কোঅপারেশনকে স্বেচ্ছায় প্রশ্রয় দেয়, কোথাওবা গোপন ব্যবস্থায় প্রশ্নের সমাধান পরীক্ষার হলে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করে ।
অতীতে পরীক্ষার হলে নকল চলতো সরবে ও স্থূলভাবে, এখন চলে নীরবে ও সূক্ষ্ণভাবে ।
পরীক্ষাকেন্দ্রগুলিতে এসব দেখার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত বহু কর্মকর্তা লোভনীয় উৎকোচ হজম করে ক্যাবলাকান্ত বনে যায় । আদর্শ ও নীতিবর্জিত, শিক্ষার দুশমন, পদলেহী মানসিকতার কিছু শিক্ষক কর্তৃপক্ষকে প্রসন্ন রাখতে পর্দার আড়াল থেকে এসব অপকর্মকে সুপারভাইজ করে নির্লজ্জ দাপটে ।
সৎ ও নীতিবান শিক্ষকরা ঘৃণা ও ক্ষোভ হজম করে বোবা যন্ত্রণায় দীর্ঘশ্বাস ফেলেন । চাপের মুখে প্রশ্ন সমাধান ও সাপ্লাই দেয়ার নোংরা কাজে আত্মনিয়োগ করে চাকরি বাঁচানো শিক্ষকরা মনের গ্লানি লুকানোর চেষ্টায় থাকে ।
ওদিকে বিনা পড়াশুনায় পাশ করার অলিখিত নিশ্চয়তা পেয়ে শিক্ষার্থীরা গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়ায়; পড়াশুনা থেকে দূরে সরে । উচ্ছন্নে যায় তাদের উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যত, জাতির সম্ভাবনা ।
প্রাইমারি স্কুল পার হওয়ার বিদ্যাও পেটে নেই, এমন অন্তঃসারশূন্য অযুত-নিযুত শিক্ষার্থী কলেজের চৌকাঠ পার হয়ে যায় হাসতে হাসতে; শিক্ষিতের আলখাল্লা গায়ে চড়ায়; তারপর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মেঝেতে পা দিয়ে আরও কিছুদূর আরোহনের চেষ্টা করে, বা বেকার ভুবনের বাসিন্দা হয় ।
এসব বিব্রতকর এবং একান্ত গোপনীয় সত্য বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একাডেমিক ট্যাবুতে পরিণত হয়েছে । এসব নিয়ে কথা বলা অস্বস্তিকর এবং ক্ষেত্রবিশেষে ঝুঁকিপূর্ণ । কিন্তু ভীরু এবং চাটুকারপরিবেষ্টিত নির্বোধ রাজার সামনে তার নগ্নতার কথা চীৎকার করে ফাঁস করে দেয়ার মতো সরল ও দুঃসাহসী কিছু শিশু এ সমাজে সবসময়ই ছিল এবং আছে । আমি তেমনই একজন শিক্ষক ।