সূর্য ওঠার আগেই নুয়েরা ইলিয়ার ভোরবেলাটা ছিল ঝকঝকে। টি বুশের সামনে পাহাড়ের চূড়ায় চা বাগানের শরীর জুড়ে ছড়িয়ে আছে সাদা মেঘের ঘন আবরণ। আর হোটেলের পেছন দিকের উঠানে দাঁড়িয়ে দূরে দৃষ্টি মেলে দিয়ে দেখা গেল আগেরদিন সন্ধ্যার দৃশ্যপট পুরো বদলে গেছে। লেকের ওপারে ঘন সবুজ বনভূমির মাথায়ও সাদা মেঘের আনাগোনা। একটু পরে সূর্য মুখ দেখালে সব কিছু আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠবে দিনের তাপমাত্রাও কিছুটা বাড়বে এই আশায় আমরা যখন শীতবস্ত্র ছাড়াই অপেক্ষার প্রহর গুনছি, ঠিক তখনই কুয়াশার ঘন চাদর চারিদিক অন্ধকার করে আমাদের ঘিরে ফেললো। সেই সাথে উত্তাপের পরিবর্তে ঝাঁপিয়ে নামলো শীত। ব্যাপারটা এতো দ্রুত ঘটলো যে ব্যাক ইয়ার্ড থেকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে দুই বিল্ডিং-এর মধ্যবর্তী জায়গাটুকু পার হবার আগেই দু চার হাত দূরেও কোনো কিছু আর স্পষ্ট দেখা যায় না। প্রায় এক ছুটে ঘরে ফিরে রুম হিটারের সুইচ অন করে কম্বলের নিচে ঢুকে পড়লাম।
এখানে আরও একটা দিন থাকতে পারলে ব্রেকফাস্ট ঘরে আনিয়ে, গরম কফিতে চুমুক দিয়ে কম্বলের নিচে আয়েশ করে আধাবেলা দিব্যি কাটিয়ে দেয়া যেতো। কিন্তু ভাবনাহীন ছুটির দিন কাটাবারও কিছু ভাবনা থেকেই যায়। আজ সন্ধ্যায় আমাদের গলে থাকার কথা। সিহান তাহির সেভাবেই হোটেল বুক করে রেখেছেন। এ পর্যন্ত এক শহর থেকে আরেক শহরের দূরত্ব সবচেয়ে বেশি ছিল নিগম্ব থেকে অনুরাধাপুরা। কিন্তু এই প্রথম পথের দূরত্ব আড়াইশ কিলোমিটার ছাড়িয়ে যাবে। নুয়েরা ইলিয়া থেকে গলের দূরত্ব দুশ তিপ্পান্ন কিলোমিটার। অগত্যা কিছু পরেই উঠে পড়তে হলো। গরম পানিতে গোসল করে যখন নাস্তার টেবিলে এসে বসলাম ততোক্ষণে কুয়াশা উধাও। শীত সকালের ঝলমলে সূর্যের আলোয় নুয়েরা ইলিয়ার পাহাড়, পাহাড়ের পায়ে নীল রঙের লেক এবং লেকের ওপারে সবুজ বনাঞ্চল আবার হেসে উঠেছে।
টি বুশের ডাইনিং হলের তিনদিকে কাচের জানালা কাচের দরজা। নাস্তার লম্বা টেবিলে বসেই বাইরের পাহাড় বনানী চা বাগানের দৃশ্য দেখতে কোনো বাধা নেই। এখানে বুফের ব্যবস্থা নেই। এক এক করে আমরা আটজন এসে টেবিলে বসার পরপরই কিচেন থেকে পরটা-অমলেট, ব্রেড-বাটার, নুডুলস-ফাইড রাইস, আনারস-তরমুজ এবং শেষে চা-কফি- সবই এসে হাজির হলো। অতএব বুফে না থাকার সমস্যাটা ঠিক বুঝতেই পারা গেল না। বাঙালি নাকি বিনে পয়সায় আলকাতরা পেলেও খেতে দেরি না। কিন্তু টি বুশের বিশাল আকৃতির অমলেটের মধ্যে গোটা কয়েক শেষপর্যন্ত ফিরিয়ে দিতে হলো। ওরা কী এক একটি অমলেটের জন্যে একহালি ডিম ভেঙেছে, নাকি কোনো বিশেষ ধরনের মুরগির স্পেশালাইজড ডিম দিয়ে অমলেট তৈরি হয়েছে, তা জিজ্ঞেস করার সময় হয়নি। তার আগেই আল পাইনের ভূতবাংলো থেকে জোড়া কন্যা রিমঝিম এবং ঝিলমিলসহ ফারহানা-সাদি এসে হাজির।
রাতেই একবার ভেবেছিলাম ফারহানা-সাদিকে ব্রেকফাস্টের আগেই চলে আসতে বলবো। পরে অবশ্য দুটি বিশেষ বিবেচনায় আমন্ত্রণ না জানিয়েই ফিরে এসেছিলাম। প্রথমত আমরা বেশ সকাল সকালই হোটেল থেকে বেরিয়ে যেতে চাই, সেক্ষেত্রে ওদের হয়তো ঘুম থেকে উঠেই তাড়াহুড়ো করে তৈরি হয়ে চলে আসতে হবে। দ্বিতীয়ত শ্রীলঙ্কার প্রায় সব হোটেলেই বেড এ্যান্ড ব্রেকফাস্ট-এর ব্যবস্থা রয়েছে। কাজেই সকাল বেলা ছুটির যে আয়েশটুকু নষ্ট না করে ধীরে সুস্থে নাস্তা শেষ করেই ওরা পরবর্তী দ্রষ্টব্য দেখতে অথবা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যেতে পারবেন। তবে আমর ভাবনা ভেস্তে দিয়ে বাবা-মাসহ দুই কন্যার আগমন সকলেই রীতিমতো হৈ চৈ ফেলে দিল। নাস্তা শেষে পাহাড়ের পটভূমিতে চা বাগানের সামনে দলবেধে প্রচুর ছবি তোলা হলো। আমাদের ছবি তোলার ফাঁকেই দুই কন্যা টি বুশের সামনের দোলানায় বসে দোল খেতে খেতে হোটেল সম্পর্কে তাদের মতামত স্পষ্ট জানিয়ে দিল। আর তা হলো, ‘তোমাদের হোটেলটা ভালো, আমাদের হোটেলটা পচা!’
কন্যাদ্বয় মতামত জানাবার আগেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল পরবর্তী দিন রাতের জন্য ফারহানা-সাদিরা এখানেই চলে আসবেন- টি বুশ তাদেরও বেশ পছন্দ হয়েছিল নিঃসন্দেহে। নয়নের মধ্যস্থতায় টি বুশের ম্যানেজার ফারহানা-সাদির জন্য একটা ভালো ডিসকাউন্ট দিতেও রাজি হয়ে গেলেন। সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবার পরে শুরু হলো ছবি তোলার পালা। শ্রীলঙ্কার পাহাড়ি শহর নুয়েরা ইলিয়ার খোলামেলা হোটেল চত্বরে বাংলাদেশের চারটি পরিবারের এক ডজন সদস্য এক সাথে অনেকগুলো ছবির ফ্রেমে আটকা পড়ে গেলাম। এরপরে চারজনকে রেখে আমরা আটজন গাড়িতে উঠে বসলাম।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই এসে পৌঁছে গেলাম হোটেলের ব্যাক ইয়ার্ড থেকে দেখা স্বচ্ছ নীলজলের বিস্তৃর্ণ জলাধার গ্রেগরি লেকের পাড়ে। উত্তর দক্ষিণে প্রায় ছয় মাইল বিস্তৃত কৃত্রিম এই জলাধারের জন্ম বৃটিশ শাসনামলে ১৮৭৩ থেকে ১৮৭৫ সালের মধ্যে। তৎকালীন সিলোনের এ্যাংলো আইরিশ গভর্নর উইলিয়াম গ্রেগরির নামে পরিচিত এই লেক জল বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য অথবা স্থানীয় মৎসজীবীদেও মাছ চাষে উৎসাহিত করার জন্য নাকি শুধুই বৃটিশ আমলা কর্মচারিদের অবসর বিনোদনের জন্য তৈরি হয়েছিল তা এখন আর সঠিকভাবে জানা যায় না। যাঁরা ইংরেজি সাহিত্যের একটু খোঁজ খবর রাখেন তাঁরা জানেন স্যার উইলিয়াম গ্রেগরি শুধু রাজনীতিবিদই নন তিনি ছিলেন একজন লেখক এবং তাঁর স্ত্রী অগস্তা গ্রেগরিও একজন খ্যাতিমান লেখক ও লোকগাথা সংগ্রাহক ।
ইতিহাস যাই হোক গ্রেগরি লেকের ভূগোল বর্তমানে পর্যটকদের দখলে। এয়ার ট্যাক্সি জাতীয় ছোট্ট উড়োজাহাজ মাত্র আধাঘণ্টায় কলম্বো থেকে উড়ে এসে নেমে পড়ে এই লেকের পানিতে। পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্নার নীল জলাধারে ভেসে বেড়ায় রাজহাঁসের আদলে তৈরি সোয়ান বোট। দেখলাম সকাল সাড়ে দশটাতেই একদল ছেলে মেয়ে টাট্টুঘোড়ায় চেপে ছুটে বেড়াচ্ছে লেকের পাড় ধরে। অশ্বারোহণ কিংবা নৌকা ভ্রমণ কোনোটারই সময় না থাকায় ঘোড়াওয়ালাদের সাদর আমন্ত্রণ রক্ষা করা সম্ভব হলো না। লেকের পাশে বেঞ্চে বসে অলস সময় কাটাবার অথবা লেক পাড়ের ওয়াকওয়ে ধরে হেঁটে বেড়াবার জন্য সন্ধ্যাবেলাটাই যথোপোযুক্ত সময়। তবে এখানে শুধুমাত্র বসে সময় কাটাবার জন্যেও প্রবেশমূল্য দিয়ে লেক সাইড পার্কে ঢুকতে হবে। প্রায় দেড়শ বছর আগে এই লেক কাটার সময় গ্রেগরি সাহেব এতোটা আশা করেননি নিশ্চয়ই!
নুয়েরা ইলিয়ার স্মৃতি হিসাবে লেক পাড়ের মিষ্টি রোদে কিছু সময় কাটিয়ে আমরা আবার পথে নামলাম। এবারে সত্যি সত্যিই সীতাদেবীর মন্দিরের সামনে এসে গাড়ি থামালো বান্দারা। অনূঢ়া বিজ্ঞের হাসি হেসে বললো, ‘নাউ দিস ইজ রিয়াল সীতা টেম্পল।’ প্রচলিত কাহিনী অনুসারে... ‘রামায়নের খল নায়ক লঙ্কাধিপতি রাবন স্ত্রী সীতাকে অপহরণের পরে ত্রিকূট পর্বতের স্বর্ণ প্রাসাদে তাঁর বসবাসের ব্যবস্থা করলে রামচন্দ্রের সতী সাধ্বি স্ত্রী তাতে অস্বীকৃতি জানান। অনোন্যপায় রাবন সীতাকে নিয়ে আসেন বর্তমানে সীতা ইলিয়া নামে খ্যাত এক পাহাড়ি বনভূমিতে। জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ে একটি অশোক গাছের নীচে আশ্রয় নেন বন্দিনী সীতা, কালক্রমে এই বনভূমি অশোক বাটিকা নামে পরিচিতি লাভ করে। রামচন্দ্রের প্রতিনিধি হিসাবে হনুমান অশোক কাননে এসে আঙুলের আঙটি দেখে সীতার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয় আর তারপরই শুরু হয় সীতা উদ্ধার অভিযান। রামচন্দ্র কর্তৃক সীতা উদ্ধারের পূর্ব পর্যন্ত রাবনের স্ত্রী মন্দোদরীও মাঝে মাঝে এখানে এসে সীতা দেবীর খোঁজ খবর নিয়ে গেছেন।’ নূয়েরা ইলিয়ার এই অশোক বনের কথা বর্তমানে আমাদের মতো সাধারণ পর্যটকসহ অনেকের জানা থাকলেও কবি কাজী নজরুল ইসলামের নিশ্চয়ই জানা ছিল না। হয়তো তাই তিনি লিখেছিলেন, ‘কোন সে সুদূর অশোক কাননে বন্দিনী তুমি সীতা...।’
কারুকার্যখচিত ছোট্ট মন্দিরটিতে বিগ্রহ বলতে রয়েছে কাল পাথরে তৈরি রাম সীতা লক্ষণ এবং হনুমানের মূর্তি। পেছনের গাছপালা ঘেরা পাহাড় থেকে বিপুল বেগে নেমে এসেছে সীতা ঝর্না নামের পাহাড়ি জলপ্রবাহ। ঝর্নার মুখে ছড়ানো বিশাল বিশাল প্রস্তর খ-ের কোনো কোনোটিতে নাকি এখনো হনুমানের পায়ের ছাপ দেখতে পাওয়া যায়। আমরা অবশ্য হনুমানের পদচিহ্ন খুঁজে বের করার চেষ্টা না করে ঝর্নার সামনে পাথরের চাঁইয়ের উপর দাঁড়িয়ে এবং বসে ছবি তোলাটা বেশি যুক্তিযুক্ত মনে করেছিলাম। ক্যান্ডি নুয়েরা ইলিয়া ব্যস্ত হাইওয়ের পাশে ছোট্ট এই মন্দির এবং মন্দির সংলগ্ন পাহাড়ি ঝোপ জঙ্গল আর তারও ওপারে পাহাড়ি শালবনকে অশোক কানন বলে বিশ্বাস হয় না। কথায় আছে ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর...’ কাজেই আমার বিশ্বাস অবিশ্বাসে কারো কিছু এসে যায় না। আমাদের দলের বিশ্বাসী দুজন মন্দিরে পূজা দিয়ে তিলক কেটে ফিরে আসার পরেই আবার যাত্রা শুরু হলো গলের পথে। আমার কেন যেনো ধারনা হয়েছিল এই পথেই আমরা গলের দিকে এগোচ্ছি। কিন্তু বান্দারা যখন গাড়ি ঘুরিয়ে আবার নুয়েরা ইলিয়ার পথ ধরলো কেবল তখনই বুঝতে পারলাম শুধুমাত্র আসল সীতা মন্দির দেখিয়ে নিয়ে যাবার জন্যেই ওরা উল্টো দিকে এতোটা পথ পাড়ি দিয়েছে।
গত কয়েকদিন শ্রীলঙ্কার বিখ্যাত রাম্বোদা ফলস্-এর ঝর্নাধারা ঝরে পড়তে দেখেছি দূরের পাহাড় থেকে। আজ চলার পথে একটা বাঁক পেরিয়ে হঠাৎ করেই অঝোর ধারায় অবিরাম শব্দে ঝরতে থাকা এক ঝরনার সামনে এসে পড়লাম। একেবারেই হাইওয়ের পাশে বলে গাড়ি পার্ক করে বেশ সতর্কতার সাথে রাস্তা পেরিয়ে ধারা প্রবাহের কাছাকাছি এসে দাঁড়ালাম। এখানে ঝর্নার জল হাত দিয়ে ছোঁয়া যায়, ঠাণ্ডা পানিতে পা ডুবিয়ে বসে থাকায়, ইচ্ছে করলে খানিকটা উপরে উঠে স্বচ্ছ জলপ্রবাহের মাঝে নিজেকে ছেড়ে দিয়ে রীতিমতো ধারাজলে স্নান সমাপন করা যায়। সবুজ লতাগুল্মে ছাওয়া অনতি উঁচু পাহাড় থেকে নেমে আসা জলের বেগবতি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছে ছোটবড় প্রস্তর খণ্ড। তেমনি একটা বড় পাথরের খণ্ডে অল্প কিছুক্ষণ বসার সুযোগ পেলাম। আসলে পথের পাশে পাহাড়ি জল প্রপাতের সামনে পাথরগুলো যেনো ছবি শিকারিদের প্রাকৃতিক স্টুডিওর দৃশ্যপট হিসাবে ব্যহারের জন্য রেখে দেয়া হয়েছে। এখানে আসন খালি পাওয়াই কঠিন।
প্রকৃত পর্যটকদের অনেকেই পাহাড়ের জঙ্গলাকীর্ণ সরু পথ বেয়ে উপরের দিকে উঠে যেতে দেখলাম। দূরে আরও দূরে অনেকটা উচ্চতায় লক্ষ করলে আমাদের দৃষ্টি সীমায় কিছু রঙিন পোশাক, কিছু মানুষের নড়াচড়া চোখে পড়ে। সম্ভবত জল প্রপাতের উৎস সন্ধানে তাঁরা এগিয়ে চলেছেন।
চলবে...
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ১০:৫২