যে যায় লঙ্কায়: শ্রীলঙ্কা সফর/১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
ভক্ত হনুমান টেম্পল থেকে বেরিয়ে নুয়ারা ইলিয়ার পাহাড়ি পথের দুপাশেই কখনও দূরে কখনও খুব কাছে একের পর এক চা বাগান পেরিয়ে বান্দারা এবারে যেখানে যাত্রা বিরতি দিলো সেটি ব্লু ফিল্ড টি গার্ডেন। বাগানের সাথেই চা তৈরির কারখানা, সেলস সেন্টার এবং রেস্টুরেন্ট। বাগান থেকে পাতা তুলে আনার পরে কারখানায় কি ভাবে তা পানযোগ্য চা’য়ের পাতায় রূপান্তরিত হয় ব্যাপারটা ঘুরিয়ে দেখাবার ইচ্ছে ছিলো আমাদের গাইড অনুরার। ওকে জানালাম আমাদের দেশেও চা বাগানের কোনো কমতি নেই এবং পাতা থেকে চা প্রসেসিং-এর প্রক্রিয়া আমাদের কারোরই অজানা কোনো বিষয় নয়।
ব্লু ফিল্ড টি গার্ডেনের চারিদিকেই গাঢ় সবুজ সুবিন্যস্ত চা বাগান। সে দিক থেকে এই চা বাগানের নাম গ্রিন ফিল্ড টি গার্ডেন হলেই মানানসই হতো। তবে বাংলো আকারের দোতলা সেলস সেন্টার এবং রেস্টুরেন্টের টিনের চালে গাঢ় নীল রঙের প্রলেপ দিয়ে হয়তো নামের সার্থকতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে। সেক্ষেত্রে এই বাগোনের নাম ব্লু রুফ টিগার্ডেন হতে পারতো। নাম যাই হোক, আমরা শেষপর্যন্ত ফ্যাক্টরি পরিদর্শন না করলেও নানা আকার আকৃতির সুদৃশ্য মোড়ক, টিনের ডিব্বা, বেত বাঁশের প্যাকেট অথবা কাঠের বাক্সে পরিবেশিত সাজানো চা পাতা কেনার প্রলোভন এড়াতে পারলাম না। চা ছাড়াও এখানে চায়ের প্রস্তুত প্রণালীর সাথে সম্পৃক্ত ঊনবিংশ শতকের পাত্র, সামোভার, ছাকনি, কেটলি এবং পাতা মাপার তুলাদ-সহ বেশকিছু জিনিসপত্র সাজিয়ে রাখা হয়েছে। আমাদের ঐতিহ্যবাহী অনেকগুলো চা বাগান থাকলেও কোথাও এমন চা সম্পর্কিত ছোটখাট জাদুঘর দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
ব্লুফিল্ডের রেস্তোরাটিও আসলে প্রচলিত অর্থে কোনো রেস্টুরেন্ট নয়। বাংলোর ড্রইংরুমে বসে বিকেলে এককাপ চা খাওয়ার মতো এখানকার চায়ের ব্যবস্থা। তবে কেউ শুধু চা না খেতে চাইলে কেক, পেস্ট্রি জাতীয় হালকা খাবারের ব্যবস্থা আছে। শুরুতে আমার মনে হয়েছিল, চা বাগানের এককাপ চা নিশ্চয়ই বুফিল্ডের সৌজন্যে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল প্রতিকাপ চায়ের দাম মাত্র পঞ্চাশ রূপি! আমাদের অবশ্য অবাক না হবার কারণ ছিল। শ্রীলঙ্কায় যেখানে পথে ঘাটে রাস্তার পাশের রেস্টুরেন্টে এককাপ চায়ের দাম ত্রিশ থেকে চল্লিশ রূপি, সেখানে ব্লু ফিল্ডের বড় সাইজর অসাধারণ এককাপ চা পঞ্চাশ রূপি হলে খুব বেশি নয়। সত্যিকারের ভাল চা তৈরি করা আসলেই কঠিন এবং সেই কঠিন কাজটি সহজে সম্পন্ন করার কায়দাটি এরা খুব ভালভাবে রপ্ত করেছে বলা যায়।
পথে আরও অনেকগুলো চা বাগান পেরিয়ে নুয়েরা ইলিয়ায় কেনাকাটার কেন্দ্রবিন্দু নিউ বাজারে এসে পার্কিংএর জায়গা পাওয়াই কঠিন হয়ে পড়লো। গাড়ি তার চালকের দায়িত্বে ছেড়ে দিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা শপিং এলাকায় ছড়িয়ে গেলাম। উপমহাদেশের যে কোনো ছোট পাহাড়ি শহরের বাজারের মতোই নুয়েরা ইলিয়ার নিউ বাজার। আসন্ন ঈদ উপলক্ষে এখানেও জামা জুতার দোকানে বেচাকেনা বেশ জমে উঠেছে বোঝা যায়। আমাদের পরিচিত ‘সোনি’ ‘সিঙ্গার’ এবং ‘বাটা’ ছাড়াও শ্রীলঙ্কার খ্যাতনামা ব্রান্ডের দোকানে ‘ঈদ মুবারক’ ছাড়াও ‘রমাদান করিম’ লেখা ব্যানার ঝুলছে। আমরা যে সমতল থেকে অনেক উপরে উঠে এসেছি সেটা বাজার এলাকায় ঘুরে চোখে দেখে বোঝা যায় না। কিন্তু বিভিন্ন পোশাক আশাকের পাশাপাশি কয়েকটি দোকানে রকমারি শীতবস্ত্র ঝুলতে দেখে মনে পড়লো মাসটা অগাস্ট হলেও এখানে সারা বছরই শীতকাল। বাজারে জন সমাগম বেশি বলেই হয়তো শীতের প্রকোপটা তেমন আক্রমনাত্মক হয়ে ওঠেনি। স্থানীয় মানুষের পোশাকেও তার প্রতিফলন নেই। এখানে সার্ট প্যান্ট, স্কার্ট এবং শাড়ির পাশাপাশি লুঙ্গি ফতুয়ারও অভাব নেই। লুঙ্গি সার্টের সাথে মাথায় টুপি পরা তেমনি একজনকে পাকড়াও করে নয়ন জিজ্ঞেস করলো, ‘এখানে ইফতার কোথায় পাওয়া যেতে পারে?’
নয়নের কথা পুরোপুরি না বুঝলেও ভদ্রলোক নিশ্চয়ই ‘ইফতার’ শব্দটি বুঝতে পেরেছিলেন। তাকে সঙ্গে করে সমুচা, কাবাব এবং ডালপুরি জাতীয় ভাজাভুজির দোকানে হাজির করে ইফতার কেনার ব্যাবস্থা করে তারপরে বিদায় নিলেন। ফল মূলে ফরমালিনের ভয় না থাকলেও শ্রীলঙ্কার মানুষও ইফতারে ভাজাপোড়া বেশ পছন্দ করে বলেই মনে হলো।
নিউ বাজার থেকে আমাদের হোটেলের দূরত্ব বেশি নয়। ইচ্ছে করলে হোটেলে চেক ইন করে মিনিট দশেকের পথ পায়ে হেঁটেও বাজারে আসা যেতো। তারপরেও একবার গন্তব্যে পৌঁছে গেলে আর হয়তো বের হতে ইচ্ছে হতো না। সেই কারণে শেষ বিকেলের আলোয় রাস্তার দুপাশে শহরের ছিঁটেফোঁটা দেখতে দেখতে মূল রাস্তা থেকে যেখান একটি পাহাড়ি পথ ডাইনে ঘুরে উপরে উঠতে শুরু করেছে আমরাও সেই পথ ধরে উঠতে শুরু করলাম। পথের দুপাশে এখানে পাহাড়ের গায়ে একটা দুটো, হোটেল, রিসর্ট কিংবা হলিডে রেন্টালের দেখা মেলে। ডাইনে বাঁয়ে কয়েকবার মোড় ঘুরে পথের শেষপ্রান্তে আমরা যেখানে এসে দাঁড়ালাম তার তিন দিক ঘিরে পাহাড়ের ঢালে অল্প কিছু বাংলো বাড়ি বাদ দিলে পুরোটাই চা বাগান। প্রথম দৃষ্টিতে মনে হলো পরিত্যক্ত চা বাগানের ভেতরে শুধুমাত্র চায়ের ঝোপঝাড়ের সাথে মিলিয়েই এই আবাসের ‘টি বুশ’ নামটি যথার্থই হয়েছে।
আমি যখন ‘টি বুশ’ হোটেলের ফ্রন্ট ডেস্কে চেক-ইনের ফর্মালিটি নিয়ে ব্যস্ত সে সময় আমার স্ত্রী কন্যাসহ দীপু এবং পামেলা পাহাড়ের গায়ে রেলিং দিয়ে ঘেরা হোটেলের ব্যাক-ইয়ার্ডে উঠে মহা হৈচৈ শুরু করে দিয়েছে। ঘরে ঘরে লাগেজ পৌঁছাবার ব্যবস্থা করে পেছন দিকের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে হৈচৈ করার যথার্থ কারণ হিসাবে দেখা গেল এক অসাধারণ দৃশ্য। টিলার গায়ে রঙিন ছাদের ছোট ছোট বাড়ি ঘর পেরিয়ে লেক, লেকের ওপারে বনভূমি জুড়ে দীর্ঘ গাছের সারি আর তারও পরে পাহাড়ের মাথায় সন্ধ্যার লাল আভা ছড়াচ্ছে নুয়ারা ইলিয়ার পশ্চিমের আকাশ। আর রক্তিম আকাশের সীমানা ছাড়িয়ে আরও উপরে নীল সাদা মেঘের শরীর জুড়ে ফুটে আছে বিশাল এক রংধনু। ক্ষণস্থায়ী সেই দৃশ্য দেখতে দেখতেই ঝাঁপিয়ে এলো শীত। এখানে সন্ধ্যার পরে তাপমাত্রা দ্রুত নামতে থাকে, এদিকে আমাদের প্রায় কারও গায়েই তখন শীতবস্ত্র নেই। কাজেই একটু পরে প্রায় সকলেই ঠা-ায় কাঁপতে শুরু করেছে। অন্ধকার পুরোপুরি নামার আগেই ঘরে এলাম আমরা।
বিদেশে নিয়ম নাস্তি বলে একটা কথা আছে, কিন্তু রোজা রাখা সম্ভব না হলেও বিদেশে ইফতার করা যাবে না, এমন কোনো কথা নেই। অতএব নয়ন পামেলার ঘরে সোফা এবং বিছানায় ছড়িয়ে নুয়ারা ইলিয়ার নিউ বাজার থেকে কেনা ইফতারি নিয়ে বসে গেলাম আমরা। সুস্বাদু ভেজ-সমুচা এবং কাবাব তখন পর্যন্ত যথেষ্ট গরম। তবে ইফতারের সময় পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই।
শ্রীলঙ্কার সমতল ভূমিতে যখন গরমে সবার হাঁসফাঁস অবস্থা তখন নুয়ারা ইলিয়ার তাপমাত্রা সন্ধ্যায় বারো ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে। এই চমৎকার আবহাওয়ার কারণে বৃটিশরা তাদের ইচ্ছে মতো পাহাড়ের গায়ে গায়ে বাংলো বানিয়ে দিব্যি সুখে দিনাতিপাত করে গেছে। এ সব বাংলোর আচ্ছাদন রঙিন টিন অথবা লাল টুকটুকে টালির, দেয়ালের আধখানা পর্যন্ত ইট সিমেন্টের হলেও বাকিটা হয়তো কাঠের, ঘরের মেঝেতে কাঠের পাটাতন আর প্রত্যেক ঘরেই রয়েছে ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বালাবার ব্যবস্থা। হোটেলে আমাদের ঘরে ঢুকেও দেখা গেল কার্পেটে ঢাকা কাঠের মেঝে এবং কাঠের সিলিং। ঘরে এয়ার কন্ডিশনার তো দূরের কথা সিলিংয়ে ফ্যান পর্যন্ত নেই। প্রত্যেক ঘরে ফায়ার প্লেস আছে তবে বর্তমানে এ সব ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বালাবার ব্যবস্থা নেই, তার পরিবর্তে আছে বৈদ্যুতিক রুম হিটার।
দলের দুই কণিষ্ঠ সদস্য অমিত এবং আনিকা টি বুশের হেড বাবুর্চির সাথে আলাপ জমিয়ে রাতের খাবারের সেট মেনু প্রায় পুরোটাই বদলে দিয়েছিল। রাতের চমৎকার ডিনারের পরে বাইরে শীতের দাপট উপেক্ষা করে আমাদের এক দেশী বন্ধুকে খুঁজতে বেরোলাম। তাঁরা একই দিনে গল থেকে সপরিবারে নুয়ারা ইলিয়ায় এসে পৌঁছেছেন।
ঢাকায় থাকতে যাদের সাথে ছ মাস বছরে একদিনও দেখা হয় না, বিদেশে তাদের সাথে এই আকস্মিক সাক্ষাত সবার জন্যেই বেশ স্মরণীয় একটা ঘটনা হয়ে রইলো। পাহাড়ের পায়ের কাছে ‘আলপাইন’ নামে ভূত বাংলোর মতো পুরোনো একটি বাড়িতে বেশ কিছুটা সময় আড্ডা দিয়ে আমরা যখন ঘরে ফিরে ঘুমাতে গেলাম তখন শ্রীলঙ্কা সফরের ষষ্ঠ দিন শেষ হয়ে সপ্তম দিন শুরু হয়ে গেছে। গায়ে দেবার জন্যে একাধিক কম্বল থাকলেও ঘুমাবার আগে রুম হিটারের সুইচ অন করার কথা কাউকেই মনে করিয়ে দিতে হয়নি।
চলবে...
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন
জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন
এখানে সেরা ইগো কার?
ব্লগারদের মাঝে কাদের ইগো জনিত সমস্যা আছে? ইগোককে আঘাত লাগলে কেউ কেউ আদিম রোমান শিল্ড ব্যবহার করে,নাহয় পুতিনের মত প্রটেকটেড বুলেটপ্রুফ গাড়ি ব্যবহার করে।ইগো আপনাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছে, টের পেয়েছেন... ...বাকিটুকু পড়ুন
এবং আপনারা যারা কবিতা শুনতে জানেন না।
‘August is the cruelest month’ বিশ্বখ্যাত কবি টিএস এলিয়টের কালজয়ী কাব্যগ্রন্থ ‘The Westland’-র এ অমোঘ বাণী যে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এমন করে এক অনিবার্য নিয়তির মতো সত্য হয়ে উঠবে, তা বাঙালি... ...বাকিটুকু পড়ুন
=বেলা যে যায় চলে=
রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।
সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন
মার্কিন নির্বাচনে এবার থাকছে বাংলা ব্যালট পেপার
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলার উজ্জ্বল উপস্থিতি। একমাত্র এশীয় ভাষা হিসাবে ব্যালট পেপারে স্থান করে নিল বাংলা।সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের ব্যালট পেপারে অন্য ভাষার সঙ্গে রয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন