somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মেয়েদের বিয়ের বয়স ও তেতুলতত্ত্বের প্রবক্তাদের দিবাস্বপ্ন

১৪ ই অক্টোবর, ২০১৪ সকাল ৯:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

‘ওরে আমার অবুঝ পাখি সবুজ বনের টিয়া/আঠারো বছর হওয়ার আগে দিমু না তোর বিয়া’ বাল্যবিবাহ সম্পর্কে জন সচেতনতা বাড়াতে বাংলাদেশ টেলিভিশনে বেশ কিছু দিন এই গানটি প্রচারিত হয়েছে। সম্প্রতি বিয়ের বয়স কমিয়ে ষোল বছর করার একটি আলোচনা চারিদিকে চাউর হয়ে যাবার পরে মনে হলো, আমরা কি তাহলে এতোদিন ভুল জিনিস প্রচার করেছি!

প্রধানত ইউনিসেফের অর্থায়নে নারী ও শিশুদের উন্নয়নে গণযোগাযোগ প্রকল্পের টেলিভিশন অংশের পরিচালক হিসাবে প্রায় সাড়ে চার বছর বাল্য বিবাহ যৌতুক এবং নারীর ক্ষমতায়ণসহ সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে কাজ করার ফলে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত এখনও মাথার ভেতরে নড়াচড়া করে। উল্লিখিত গানটির মতো অনেক জনপ্রিয় গান, প্রথিতযশা নাট্যকারদের লেখা ও জন নন্দিত পাত্র-পাত্রী অভিনিত নাটক এবং অসংখ্য আলোচনা সমালোচনা প্রচারের পরেও পনের বছর বয়স হবার আগেই এ দেশের এক তৃতীয়াংশ মেয়েরই বিয়ে হয়ে যায়। শতকরা ৬৬ ভাগ মেয়ের বিয়ে হয় বর্তমানের আইনসম্মত বয়স অর্থাৎ আঠারো বছর বয়স পার হবার আগে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাল্য বিবাহের হার সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। এ দিক থেকে বাংলাদেশ তার প্রতিবেশি দেশগুলো থেকে পড়ে রয়েছে অনেক পেছনে। ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর রিসার্চ অন উয়ম্যান-এর গবেষণা অনুসারে বিশ্বে বাল্যবিবাহে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ এবং ভারত ও নেপালের অবস্থান যথাক্রমে ত্রয়োদশ ও সপ্তদশ স্থানে।

বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ সম্পর্কিত প্রচার প্রচারণার সূত্রে কয়েক বছর ধরে দেশের বিভিন্ন এলাকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে অসংখ্য কিশোরী মা ও বাল্যবিবাহের অসহায় শিকার মেয়েদের সাথে কথা বলার এবং তাদের বক্তব্য রেকর্ড করার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এ সব কথপোকথনের মধ্য দিয়ে যে দুঃসহ জীবন ও নিষ্ঠুর পারিবারিক পরিবেশের সাথে আমাদের পরিয়চয় ঘটেছে সেখানে আর যাই হোক, ‘বিবাহিত জীবনের স্বাদ/কোথাও রাখেনি কোনো খাদ’ বলে আতœতৃপ্তি লাভের কোনো সুযোগ নেই। বিয়ে সম্পর্কে কোনো ধারণা জন্মাবার আগে কোনো ধরনের শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি ছাড়াই তাদের ঠেলে দেয়া হয়েছে এক অমানবিক প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে।

এ সব প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছাড়াও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ের দেশের বিশিষ্টজনদের অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিয়েছেন। তাঁদের আলোচনায় যে বিষয়টি স্পষ্টভাবে সামনে এসেছে তা হলো, বিয়ের নির্ধারিত বয়স আঠারো হলেও আর্থিক অসঙ্গতি, বখাটেদের উৎপাত ও লেখাপড়া শিখেও ভবিষ্যতে কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তাসহ সামাজিক নানা কারণে অনেক অভিভাবকই মেয়ের বয়স গোপন করে পনের ষোল এমন কি তার চেয়ে কম বয়সে মেয়ের বিয়েতে উদ্যোগী হন। তবে মেয়ের অভিভাবকের মধ্যে মেয়েটিকে বিদায় করার জন্যে যে মানসিকতা প্রবলভাবে কাজ করে তার উৎসÑ সম্পত্তিতে কন্যা শিশুর অধিকার না থাকা।

আলোচকদের মতে নানামুখি সরকারি উদ্যোগ ও প্রণোদনা সত্ত্বেও বাল্যবিবাহ শিক্ষা ক্ষেত্রে পশ্চাদপদতার অন্যতম প্রধান কারণ। সপ্তম থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বিয়ে হয়ে যাবার ফলে প্রতি বছর অসংখ্য মেয়ে শেষপর্যন্ত স্কুলের পড়া শেষ করার সুযোগ পায় না। প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ে ধারনা না থাকায় কম বয়েসে বিবাহিত মেয়েরা অল্প বয়সে সন্তান ধারণ করে, ফলে আজীবন স্বাস্থ্য ঝুঁকি বয়ে বেড়ানো মা ও সন্তান উভয়ের জন্যেই তা অকাল মৃত্যুর কারণ হতে পারে। বয়সের কারণে সংসারের দায় দায়িত্ব সম্পর্কে অজ্ঞতা ও ঘরের কাজে অনভিজ্ঞতার ফলে প্রায়শই তারা নির্যাতন ও নিগ্রহের শিকার হয়। কম বয়সের বিয়ের মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাবে কিশোরী মায়েরা দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে যে প্রভাব ফেলে তা জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে অন্যতম অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।

মেয়েদের বয়স কমিয়ে বিয়ে দেয়ার প্রবণতা রোধ করতে সরকারের উদ্যোগে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ইতিপুর্বে নেয়া হয়েছিল। তার প্রথমটি হলো আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত সকলকে শিশু হিসাবে বিবেচনা করা এবং অন্যটি হলো সকল শিশুর জন্ম্ নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা। এখন বিয়ের বয়স কমিয়ে আনা হলে তা হবে দেশের প্রচলিত আইন শিশুনীতি-২০১১ এর সাথে সামঞ্জস্যহীন এবং জাতিসংঘ ঘোষিত শিশু অধিকার সনদের পরিপন্থী। বাংলাদেশ শিশু অধিকারের ক্ষেত্রে তার ঘোষিত অবস্থান থেকে এক লাফে দীর্ঘ পশ্চাদপসারণ সম্পন্ন করে ফিরে যেতে পারে শিশু বিবাহের যুগে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্রমাবনতি এবং নারী নির্যাতনের ভয়াবহ উর্ধ্বগতিসহ অন্যান্য মানদ-ের বিচারে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থান কোথায় দাঁড়াবে সে বিবেচনায় না গিয়েও বলা যায় এটি হবে একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।

নারী ও শিশুর জীবন মান উন্নয়নে সরকারের প্রচার প্রচারণার সবটাই যে বিফলে গেছে তা বলা যাবে না। মাঠ পর্যায়ে নেয়া বিভিন্ন কর্মসূচি এবং জন সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশে নারী ও শিশু মৃত্যু, বিশেষ করে প্রসূতি মা ও নবজাতকের মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। এ সব অর্জনের জন্যে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশংসিত হবার পাশাপাশি সরকারের সাফল্যের ভা-ারে কিছু সম্মানজনক পুরস্কারও যুক্ত হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, সরকার কি ‘মিলেনিয়াম ডেভলপমেন্ট গোল’ এর পথে তার অগ্রযাত্রা অব্যহত রেখে বাল্যবিবাহ, যৌতুক ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধসহ চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাবার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে নাকি সেই যাত্রায় ক্ষান্ত দিয়ে উল্টোপথে হাঁটতে শুরু করবে?

মেয়েদের বিয়ের বয়স কমিয়ে ষোল বছর করার অশুভ অভিপ্রায় থেকে স্বাভাবিক ভাবেই মনের মধ্যে সন্দেহ ঘণীভূত হবার সুযোগ পায়। সঙ্গত কারণেই মনে হয় নারীর প্রতি বৈষম্য দূরীকরণ বা ‘সিডোও’ সনদে স্বাক্ষর করেও ঘোষিত নারী নীতির পূর্ণ বাস্তবায়ন থেকে সরে আসা এবং ষোল বছরের মেয়েদের বিবাহযোগ্যা হিসাবে আইন সংশোধনের দুরভিসন্ধি একই সূত্রে গাঁথা। একটু গভীরভাবে দূরে দৃষ্টি মেলে দিলে এইখানে ষোড়শী বিবাহের দিবাস্বপ্নে বিভোর তেতুল তত্ত্বের প্রবক্তাদের দন্ত বিকশিত হাসির আভাস পাওয়া যায়। ভূতের পা পিছন দিকে বলে একটা কথা আছে এবং এ সব ভূত মাঝে মাঝেই আমাদের নীতি নির্ধারকদের কাঁধে ভর করে। তখন তাঁরা জনগণকে দেয়া প্রতিশ্রুতি এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন চুক্তিতে দেয়া স্বাক্ষরের কথা বেমালুম ভুলে যান।





সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই অক্টোবর, ২০১৪ সকাল ৯:১৩
৮টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×