যোধপুর
যোধপুর পৌঁছলাম রাত ১০ টার দিকে । হোটেল রুম থেকে মেহেরণগড় দুর্গ অন্ধকারে সোনালী আলোয় জ্বলজ্বল করছিল । এত বড় একটা দুর্গ , আর এত উঁচুতে যে অবাক না হয়ে পারা যায়না । রাতে হাঁটতে বের হলাম । খাওয়া দাওয়া করে ফিরছি এমন সময় দেখি একটা গাছ থিকে অনেক আওয়াজ আসছে । গিয়ে দেখি গাছ ভর্তি পাখি।
চড়ই পাখি । ছোট একটা গাছ , যে কেউ আক্রমণ করতে পারে । তারপরেও তারা নিশ্চিন্তে আছে । পাশেই এক বয়স্ক মহিলাকে দেখে এগিয়ে গেলাম , আমি জানতে চাইলাম এরা কি প্রতিদিন আসে ? যানা গেলো তারা এখনেই থাকে , রোজ সন্ধ্যায় আসে আর ভোরে আযান দিলে চলে যায় । কেউ তাদের বিরক্ত করে না । মহিলা তার স্বামীকে নিয়ে পাশেই একটা ঘরে থাকেন । দুই জনেরই বয়স অনেক ,দিন মজুরী করে চলতে হয়। তারাই পাখিদের খাওয়ান । আর কিছুক্ষণ গল্প করে হোটেলে ফিরে আসলাম । ভারতে আমি অনেক যায়গায় পাখি দেখেছি , যাদের কেউ বিরক্ত করে না । উল্টা খাওয়া দেয়। আমাদের এখানে হলে গুলি করে মেরে পিকনিক করে খেতাম । ভালো লাগলো পাখি গুলি নিরাপদে আছে দেখে ।
মেহেরণগড় দুর্গ
মেহেরণগড় দুর্গকে দানব বলাই উত্তম । এত বড় ! যাইহোক ঢুকে পড়লাম । টিকিটের সাথে লিফটের টিকিট করতে হল , এই লিফট নাকি ৭৫ বছর পুরনো ! ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দে রাও যোধা দুর্গটি নির্মাণ করেন। প্রাসাদ, সৈন্যাবাস, মন্দির, ঘরবাড়ি নিয়ে একসময় জমজমাট এই দুর্গ মুঘলদের কাছেও অজেয় ছিল। যোধপুরের রাজবংশের সঙ্গে মিত্রতাও গড়ে উঠেছিল মুঘলদের। আকবরের প্রধানা মহিষী যোধাবাঈ ছিলেন উদয়পুরের রাজকন্যা, রাও উদয়সিংহের ভগ্নী। উদয়সিংহ জাহাঙ্গিরের সঙ্গে নিজের কন্যার বিবাহ দেন। ১৫৮১ খ্রিস্টাব্দে উদয় সিংহকে রাজা খেতাব দেন সম্রাট আকবর। পর্যটকদের কাছে দুর্গের আকর্ষণ এখন মিউজিয়াম হিসেবে। কিন্তু সেই সাথে এই দুর্গ থিকে পুরা শহর দেখা যায় । এই শহরের বিশেষত্ব হচ্ছে নীল রঙের বাড়ী । যা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে । দুর্গের পিছনদিকে এখনো অনেক বাড়ী নীল রঙের । দুর্গ থিকে বের হয়ে যাচ্ছি এমন সময় একটা কোরিয়ানকে দেখে থেমে গেলাম। বলা হইনি যোধপুরে আসার পথে তার সাথে আমার বাসেই কথা হয়েছিলো ।সামনে গিয়ে বললাম " হ্যালো , আমাকে চিন্তে পেরেছ ?" । " ইয়েস ইয়েস , তুমি তো ওই বাসে ছিলে " উত্তরে সে বলল । নাম তার হ্যারি , কোরিয়ান হলেও আমেরিকায় পরাশুনা করছে । সাথে একজন ভারতীয়কে দেখলাম । নাম তার শ্রী , চাকরি ছেরে দিয়ে এখন ঘুরে আর ব্লগ লিখে । ৩ জন ৩ দেশের মানুষ , কিন্তু উদ্দেশ্য এক, ঘোরতে বের হয়েছি সবাই । তারপর যা হওয়ার তাই হল । সবাই এক সাথে পুরাদিনটি ঘুরলাম । দিন শেষে আমরা আবার ওই মেহেরণগড় দুর্গে চলে এলাম সূর্যাস্ত দেখবো বলে। এই প্ল্যানটা ছিল হ্যারির। দুর্গের পিছনে যে নীল রঙের বাড়িগুলির কথা বলেছিলাম , ওই দিকে চলে গেলাম । একদম ভৌতিক অবস্থা। দুর্গ বন্ধ হতে শুরু করেছে , ৫ টায় দুর্গ বন্ধ হয়ে যায়। আর আমরা এমন একদিকে আছি , যেদিকে কেউ নেই । আসলে যাওয়ার নিয়ম নেই , আমরা একটা দুর্গের ভাঙ্গা কিছু অংশের উপর বসে পড়লাম ।
সূর্য ধীরে ধীরে নীল বাড়ী গুলিকে আলো বঞ্চিত করে বিদায় নিচ্ছে , যা না দেখলে অনুভব করা সম্ভব নয় । মুগ্ধ হয়ে আমরা সূর্যাস্ত উপভোগ করলাম । এইদিকে দুর্গে সন্ধ্যাবাতি জ্বলে উঠেছে। আমরা তারাতারি বের হওয়ার জন্য রওনা হলাম । বের হওয়ার পথে পড়লাম নিরাপত্তা রক্ষীদের সামনে । হ্যারি ছিল বলেই আল্পতে ছেড়ে দিয়েছিল , না হলে আর কিছুক্ষণ বকবক করত । হ্যাঁ , এটা ঠিক আমরা নিয়ম ভঙ্গ করেছিলাম , কিন্তু যে অভিজ্ঞতা হল তাতো অমূল্য । শহরের দিকে চলে আসলাম তিনজনে। রাতের খাবার খেয়ে বিদায় নিলাম।
এই শহরে আর আছে কলক টাওয়ার, উমেদ ভবন প্যালাস যেখানে বর্তমান রাজপরিবার থাকে। এত বিশাল একটা বাসায় কি করে থাকে এটাই একটা চিন্তার বিষয়।
উমেদ ভবন প্যালাস
পরের দিন সকালে আমরা ৩ জন বাস কাউন্টারে চলে এলাম । ৩ জনের গন্তব্য ৩ দিকে । আমি উদয়পুর , হ্যারি জয়পুর আর শ্রী পুস্কার যাবে । খারাপ লাগছিল, কিন্তু আমাদের সবার আলাদা আলাদা গন্তব্য আছে তাই কেউ কাউকে আটকালাম না। হ্যারি আর শ্রীকে বাংলাদেশে আসার দাওয়াত দিয়ে আমি উঠে পড়লাম বাসে।
শেষ গন্তব্য উদয়পুর , যাকে ভারতের ভেনিস বলা হয় ।
উদয়পুর
এক কথায় আমি মুগ্ধ। রাজস্থানে এই একটি শহর যেখানে প্রাকৃতিক আর ঐতিহাসিক নিদর্শনের যুগল বন্দী হয়েছে । যার কারনে এখনে অনেক পশ্চিমা পর্যটকদের দেখা যায় । এক আমেরিকানের সাথে কথা হল , যে গত ১২ দিন ধরে এখনেই আছে । শহরটা অনেক পরিষ্কার , লেকগুলির পানি স্বচ্ছ । ফতেহ সাগর লেক তার মধ্যে অন্যতম , সকাল বেলা বা সন্ধ্যায় হাটার জন্য উপযুক্ত যায়গা । বুকভরে বাতাস নিতে চাইলে এরচেয়ে ভালো যায়গা আমার অন্তত যানা নেই ।
ফতেহ সাগর লেক
সিটি প্যালেস দেখতে চলে আসলাম । লোকালদের টিকিট ২৫০ রুপি ! ক্যামেরা ২৫০ রুপি ! বলে কি । বর্তমান মহারাজা টাকার কাঙ্গাল তা বুজা গেলো । এর পক্ষে আর কিছু প্রমান পরে পেয়েছিলাম । এটি রাজস্থানের বৃহত্তম রাজপ্রাসাদ ও মহারাণার শীতকালীন আবাস।
সিটি প্যালেস
প্রথম বড়ি পোল হয়ে ত্রিপোলিয়া গেট, যাতে তিনটি খিলান ও আটটি তোরণ আছে। ত্রিপোলিয়ার পরে গণেশ দেউড়ি, শিশমহল, কৃষ্ণা ভিলা, ভীম ভিলা, ছোট চিত্রশালি, দিলখুসমহল, মানকমহল, মোতি মহল, বড়ি মহল আর ১৬৭৬ সালে তৈরি কাঁচ কি বুরুজ। সব মিলিয়ে এগারটি মহল। প্রতিটি মহলই সূক্ষ্ম কারুকার্যমন্ডিত। অন্য এক ঘরে সূর্যমূর্তি, মানক বা রুবিমহলে কাচ ও পোর্সিলিনের সুন্দর সুন্দর মূর্তি। প্রাসাদের এক অংশে সরকারি মিউজিয়াম। আরেক অংশে হোটেল। অন্য এক অংশে রাজপরিবারের বংশধরেরা বসবাস করেন। প্রাসাদের গায়েই ১৪ শতকে তৈরি ১০ বর্গ কিমি জুড়ে পিছোলা লেক। চারদিকে পাহাড় ঘেরা। জলাশয়ের মাঝে মাঝে দ্বীপ, দ্বীপের মাঝে প্রাসাদ আর মন্দির। একদিকে সুন্দর বাগান আর অন্যদিকে ঘাটের পর ঘাট। লেকে বোটিং-এর ব্যবস্থাও আছে। পুরা ২ ঘণ্টার মতো লাগলো এই প্রসাদ দেখতে । দিনের বেলা লেকে বোটিং করতে চাইলে ৪০০ রুপি , আর বিকাল বেলা সূর্যআস্ত উপভোগ করতে চাইলে ৭০০ রুপি ! নাহ আর চেয়ে হোটেলের ছাদে বসে সূর্যআস্ত দেখেছিলাম । চা পান করতে করতে সূর্যকে বিদায় নিতে দেখলাম । এক কথায় অসাধারণ । সন্ধ্যায় চলে গেলাম বাগড় কি হাভিলিতে , যেখানে লোকাল নাচ , গান আর পুতুল নাচ হবে । যানা গেলো ৩০ /৪০ মিনিট আগে না গেলো ভালো সিট পাওয়া মুশকিল হবে। তাই আগে গিয়েই ভালো একটা সিট নিয়ে নিলাম । অনেকদিন পর পুতুল নাচ দেখলাম , ছোটবেলায় দেখেছিলাম এক দুবার । তারপর এলো গানের পালা আর গানের সাথে নাচ ।
শেষে এলো এক বয়স্ক মহিলা , লোকজন একটু নাখোশ হল এতে। কেউ কেউ পিছন থিকে বলেই ফেলল সরকারি অনুষ্ঠান মনে হয় । কিন্তু ওই মহিলা যা দেখালেন তাতে আমরা মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না । কখনো মাথায় ১০/১২ কলস নিয়ে নাচলেন আবার কখনো কাঁচের টুকরার উপর । শেষে সবাই দারিয়ে তাকে সম্মান জানালো ।
পরেরদিন চলে গেলাম মহারাজার পুরনো গাড়ির সংগ্রহ দেখতে । গাড়ি আছে মাত্র ১২ টার মতো আর টিকিট ২৫০ রুপি মাত্র ! আমি যখন প্রবেশ করলাম দেখি মহারাজার বিশেষ অতিথি এসেছে ,তাকে বিশেষ ভাবে গাড়ি গুলি দেখানো হচ্ছে । আমিও ভিরে গেলাম তাদের সাথে । সাধারণত এই গাড়ি গুলি নির্দিষ্ট দূরত্ব থিকে দেখতে হয় , কিন্তু অতিথি মশায়ের জন্য তা মানা হচ্ছে না, এমনকি গাড়ি খুলে দেখানো হচ্ছে । আর আমি এই সুযোগ কি হাত ছাড়া করি ! এখানে পৃথিবীর বিখ্যাত সব কোম্পানির পুরনো গাড়ি আছে । রলস রয়ালস সহ আর অনেক। তারপরেই পেলাম চমক । জেমস বন্ড মুভির শুটিং হয়েছিলো এই উদায়পুরে ১৯৮৩ সালে । ওই মুভিতে মহারাজার একটি গাড়ি ব্যাবহার করা হয়েছিলো , যা এখন এই গাড়ির যাদুঘরে আছে। এছাড়া এখনে ২ টা ঘোড়ার গাড়িও আছে ।
সেই গাড়িটি
পিছোলা লেক । দ্বীপের মাঝে প্রাসাদ আর মন্দির। একদিকে সুন্দর বাগান আর অন্যদিকে ঘাটের পর ঘাট।
এটা লেক পিছোলা প্যালেস , এখন হোটেল হিসাবে ব্যাবহার হয়
এই লেককে ঘিরে ছড়িয়ে আছে নানান গল্পকথা। প্রচলিত কথা, পিছোলার জল পান করলে তাকে আবার এখানে ফিরে আসতেই হবে। লেকের মাঝে এক দ্বীপে রয়েছে এক নর্তকীর স্মৃতিস্তম্ভ। জনশ্রুতি, মহারাণার সঙ্গে এক নর্তকীর এই শর্ত হয় যে, সে যদি, দড়ির ওপর নাচতে নাচতে এপার ওপার করতে পারে পুরস্কারস্বরূপ অর্ধেক রাজত্ব পাবে। সে প্রায় অন্য পাড়ে পৌঁছে যাচ্ছে দেখে প্রধান মন্ত্রী দড়িটি কেটে দিলে নর্তকীর সলিল সমাধি হয়।
মনসুন প্যালেস যাওয়ার জন্য একটা অটো নিলাম । যেখান থিকে পুরা উদায়পুর সিটি দেখা যায় । কিন্তু আমার কপাল খারাপ , ওই দিন কোন কারনে তা বন্ধ ছিল । এখন কি করা যায় ? অটোওয়ালা একজন প্রবীণ বেক্তি , আমাকে বলল চলেন আপনাকে অন্য একটা যায়গায় নিয়ে যাই । তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন শিল্পী গ্রামে । যেখানে ভারতের বিভিন্ন গ্রামের ঘরের মডেল আর বিভিন্ন নাচ, গানের শিল্পীদের সমাবেশ করা হয়েছে । দারুন কিছু গান আর নাচ দেখার সুযোগ মিলল এখনে ।
অটোওয়ালা আমাকে নিজেই সবকিছু দেখালেন , আর বুঝিয়ে দিলেন কোনটা কোন রাজ্যের গ্রামের বাড়ী । সেই সাথে তার থেকে যানা গেলো উদায়পুরের অনেক কথাই। সন্ধ্যা হয়ে আসছে , রাতেই ট্রেন । ফিরার জন্য মনটা অস্থির হতে শুরু করেছে , মাত্র ১৩ দিন কিন্তু মনে হচ্ছিলো কতদিন বাসা থেকে দূরে । রাত ১২ টায় অনন্যা এক্সপ্রেসে উঠে পড়লাম , গন্তব্য কলকাতা ।
৪৫ ঘণ্টার ট্রেন ভ্রমন শেষে কলকাতা , তারপর ঢাকায় ফিরলাম আর ১২ ঘণ্টা পরে। তারপরেই শেষ হল আমার রাজস্থান ভ্রমন ।
কিভাবে যাবেনঃ
ট্রেনে গেলে অনেক ট্রেন আছে কলকাতা থেকে , আজমির এক্সপ্রেস , যোধপুর এক্সপ্রেস এবং অনন্যা এক্সপ্রেসে যাওয়া যায় রাজস্থান ।
ভাড়া ৭০০ রুপি থিকে ৫০০০ রুপি পর্যন্ত ।
কখন যাবেনঃ
সাধারণত রাজস্থানে অনেক গরম হয় , তাই যাওয়ার ভালো সময় হচ্ছে শীতের সময় । ডিসেম্বর থিকে ফেব্রুয়ারী সবচেয়ে উত্তম সময় ।
কোথায় থাকবেনঃ
প্রচুর হোটেল আছে । ৬০০ থিকে শুরু হয়ে ৫০০০ রুপিতে রুম পাওয়া যায় । আপানার বাজেট মতো মতো উঠে পরবেন । নিজে খুজে না পেলে অটোওয়ালাকে বললেই হবে , তারাই নিয়ে যাবে ।
পুরা অ্যালবাম দেখতে চাইলে
আমার দেখা রাজস্থান - প্রথম পর্ব
আমার দেখা রাজস্থান - দ্বিতীয় পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১:০৯