পরীক্ষা শেষ হবার পরের দিন বের হয়ে পরলাম একাই , গন্তব্য কলকাতা। এই ট্যুরটা অনেক আগে থিকেই প্ল্যান করে রেখেছিলাম। সেই ছোটবেলায় সত্যজিৎ রায়ের রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাস সোনার কেল্লা আমার মনে যে দাগ কেটেছিল। যে স্বপ্ন দেখিয়েছিল তার বাস্তব রুপ দেখার উদ্দেশে আমার যাত্রা শুরু। গন্তব্য ২০০০ কিমি: দূরের রাজস্থান ।
অন্য একটা দেশ , অনেক দূরে রাজস্থান , আর আমি কিনা যাচ্ছি একাই ! এটা শুনে আমার পরিবার আর বন্ধু মহল অনেক আবাক হয়েছিলো। কিন্তু এই রকম ট্যুরে আমি একাই যাওয়া ভালো মনে করেছিলাম। কারন আমি স্বাধীন ভাবে / নিজের মত ঘুরতে চেয়েছিলাম আর এটা অনেক লম্বা একটা ট্যুর ছিল । অনেক অনেক যায়গায় যাওয়ার প্ল্যান, যা আমি নিজেই ঠিক করেছিলাম। কোথায় যাবো ? কোথায় থাকবো ? কোথায় কয়দিন থাকবো ? সব আমার প্ল্যান করা ছিল। তাই একাই যাওয়া টাই ভালো মনে করেছিলাম । চাইলে অন্য কোন গ্রুপের সাথে যাওয়া যেত , কিন্তু সেক্ষেত্রে আপনার স্বাধীনতা থাকে না। স্বাধীনতা , এটাই সবচেয়ে বড় কথা। আপনি চাইলে যেকোনো সময় আপানার প্ল্যান পরিবর্তন করতে পারবেন , মন যা চায় তাই করা যায়। সেই সাথে এটা পরনির্ভরশীলতা দূর করারা ভালো উপায় , আমরা সাধারণত একা চলতে ভয় পাই , হাজারো প্রশ্ন মনে আসে । একা ভ্রমন একটা পরীক্ষাও বটে , নিজেকে চেনার পরীক্ষা , আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর পরীক্ষা ।
একা চলতে গিয়ে দেখা যায় অনেক মানুষের সাথে মিশার সুযোগ হয় , দেখা যায় আপনার মতো অনেকেই একাই এসেছেন। হ্যাঁ কিছুটা সতর্ক থাকতে হয় , কারন বিপদ তো আর বলে আসে না । কেউ যদি একা ( Solo travel ) ভ্রমন না করে তো তার পক্ষে এর মজাটা আনুভব করা মুশকিল , তাই দেখা যায় তারা বাঁকা চোখে দেখে এই ব্যাপারটা । ।এমন মানুষও দেখেছি যারা প্রচুর ভ্রমন করেন অথচ এই ব্যাপারটাই ( Solo Traveler ) জানে না । একা একা আবার ঘুরা যায় নাকি ! আর কত প্রশ্ন করে অনুৎসাহিত করার চেষ্টা করে এরা , আরে মশাই একবার একা ঘু্রেই আসেন না , তারপর নাহয় বলবেন একা ঘু্রা খারাপ। এটা ঠিক আমাদের দেশে এই ব্যাপারটা এখনো সেইভাবে প্রচলিত নয় । কিন্তু পশ্চিমার দেশ গুলি থিকে প্রচুর পর্যটক একাই আসেন ।
ইতিহাস আমার প্রিয় একটা বিষয় , আর রাজস্থান ইতিহাসের ভূমি । জয়সলমীর আমাকে টেনে আনলেও রাজপুতদের ইতিহাস জানার আর দেখার জন্য প্ল্যান করলাম, রাজস্থানের ৬ টা শহরে যাবো জয়পুর, আজমির , বিকানীর, জয়সলমীর, যোধপুর এবং উদয়পুর।
জয়পুর
রাজস্থানের রাজধানী জয়পুর। রাজস্থানের প্রবেশদ্বার বলা যায় জয়পুরকে । কলকাতা থিকে জয়পুরে আসতে সময় লাগলো ৩০ ঘণ্টার মতো । যখন জয়পুরে পৌঁছলাম তখন ভোর ৫ টা। কিন্তু জয়পুর ষ্টেশন জেগেই আছে। কুলিদের ছোটাছুটি আর অটো ড্রাইভারদের হাঁকডাকে পরিবেশ বেশ ভারি। "কোথায় যাবেন ? ভালো হোটেলে নিয়ে যাবো স্যার " আমাকে ২০ রুপি দিলেই হবে । এই যখন অবস্থা তখন উঠেই পরলাম । ৬০০ রুপি দিয়ে বেশ ভালই একটা হোটেলে উঠে পরলাম।
জানুয়ারীর ২ তারিখ সকালে বেরিয়ে পড়লাম সারাদিনের জন্য জয়পুর ঘুরতে। প্রথম গন্তব্য অ্যালবার্ট হল যা রাজস্থান রাজ্যের প্রাচীনতম যাদুঘর , এখনে মিশরের মমিও রয়েছে ।
অ্যালবার্ট হল
আম্বর দূর্গ ,হাওয়া মহল , জল মহল , নাহারগার দুর্গ , সিটি প্যালেস ঘুরতে আমার ২ দিন লেগে গিয়েছিল। জয়পুর অনেক সাজানো আর পরিষ্কার শহর। একে পিংক শহর বলা হলেও, এই পিংক এখন সব যায়গায় দেখা যায়না । এখনে সবকিছুই পর্যটনকে টার্গেট করে করা । হোটেল , খাবারের দোকান , কাপড়ের দোকান সব যায়গায়ই পর্যটকদের উপরেই চলছে। যদিও ভেবেছিলাম পাগড়ী পরা লোক আর লম্বা ঘোমটা দিয়া মহিলা দেখা যাবে , কিন্তু হতাশ হতে হল। যদিও হাতে গোনা কিছু চোখে কিছু পরেছিল ।
হাওয়া মহল
আম্বর দূর্গ
সাপের খেলা দেখাচ্ছে একজন সাপুড়ে
আম্বর দুর্গে হাতি
এখানকার মানুষের সততা আছে , একবার হল কি আমি একটা অটো নিয়ে নাহারগার দুর্গ দেখতে গেলাম , সাথে আর ২ জন রাস্তায় যোগ দিলো । আমরা দুর্গটা দেখা শেষ করে বাইরে এসে দেখি আমাদের ওই অটো নেই ! অটোতে আমার কিছু না থাকলেও ওই ২ জনের ব্যাগ ছিল । স্বাভাবিক ভাবেই আমরা চিন্তিত হয়ে পড়লাম । এই দিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে, এখান থিকে হেটে যাওয়া সম্ভব না । আমরা পুলিশের কাছে যাবো ভাবছিলাম , তখন অন্য অটোওয়ালারা আমাদের একটু অপেক্ষা করতে বললেও আমরা অস্থির হয়ে পরেছিলাম, পরে ২০ মিনিট পরে তাকে আসতে দেখে আমরা হাঁফ ছেরে বাঁচলাম । ক্ষমা চেয়ে বলল আমাদের দেরি হবে ভেবে সে খ্যাপ মারতে গেয়িছিল।
পরের দিন ওই অটোওয়ালাকে নিয়ে ঘুরতে বিরিয়েছিলাম । সকাল ৯ টায় আমার হোটেলের সামনে হাজির। কিন্তু একজন মহিলা লম্বা ঘোমটা দিয়ে বসে আছে , আমি বেশ অবাক হলাম , কারন আমি বুক করেছি একাই ঘোরার জন্য । পরে যানা গেল এই মহিলা তার বউ , তার কোলে একটা বাচ্চাও ছিল । বলল তার ছেলেটা খুব অসুস্থ । ডাক্তারের কাছে যাবে , আমার কাছে জানতে চাইল আমার কোনো অসুবিধা আছে কিনা ? "পরে ঘুরা যাবে আগে ডাক্তারের কাছে চলুন " বললাম তাকে । তার বউ ছেলেকে রেখে তারপর গেলাম ঘুরতে । সারাদিন এত টাকা খরচ করেছিলাম যে অটোর ভারা বাদে আমার কাছে ছিল মাত্র ১০০ রুপি । এই দিকে দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেছে । আমি জানতাম এরা সাধারণত হোটেলে বা কাপড়ের দোকানে কাস্টমের নিয়ে গেলে কিছু কমিশন পায় । তাই আমি তাকে খুলেই বললাম আমার সমস্যার কথা । তখন সে আমাকে নিয়ে গেল রাস্তার ধারে একটা ধাবায় , বলল এখানেই সে নিয়েমিত খায় । আলু পড়োটা আর ডাল সাথে বোরহানি , ২ জন মিলেই খেলাম । বিল আসলো মাত্র ৫৬ রুপি ! গরীব হলেও তার মনটা অনেক বড় , আমি শুধু তাকে বললাম "ধন্যবাদ , আপনি অনেক ভালো একজন মানুষ "। অমায়িক একটা হাঁসি দিয়ে বলল "চলুন আপনাকে হোটেলে রেখে আসি" , " আর পরের বার আসলে বউ সাথে করে আনবেন " আমি শুধুই হাসলাম ।
বিকাল হয়ে আসছে , আজমির যাবো এখন ।
পুরা অ্যালবাম দেখতে চাইলে
এই ট্যুরের ভিডিও দেখতে চাইলে ক্লিক করুন
আমার দেখা রাজস্থান - দ্বিতীয় পর্ব
আমার দেখা রাজস্থান - তৃতীয় পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১২:৩২