আমি সাইকেল চালানো শিখে ফেলেছি। আবারো গ্রামে গেলাম , সাইকেল চালানোর জন্য হাত পা নিশপিশ করছে।হন্যে হয়ে সাইকেল খুজঁছি। অবশেষে সাইকেল পেলাম আমার চাচারটা।যে সাইকেলটা ছিল EXCLUSIVE সাইকেল (পূর্ববর্তী পোষ্ট দ্রষ্টব্য)। তারপরও আমি এই EXCLUSIVE এর তোয়াক্কা করিনি, সাইকেল EXCLUSIVE নাকি ORDINARY এ নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যাথা ছিল না।কারণ আমার দরকার সাইকেল চালানো।আমাদের গ্রামের সাইকেল গুলো ছিল ইন্ডিয়ান হিরো সাইকেল, এই সাইকেলগুলো অনেক উঁচু হয়।আমি যতই সাইজে বড় হই না কেন ঐ উঁচু সাইকেলে কোনভাবেই উঠতে পারছিলাম না।তখন একটা বুদ্ধি বের করলাম, কোন একটা উঁচু জায়গার পাশে সাইকেলটাকে নিয়ে গিয়ে ঐ উঁচু জায়গা দিয়ে সাইকেলে উঠে পড়লাম।তারপর আমাকে আর পায় কে?? প্যাডেল দিতে দিতে চলে গেলাম রাস্তায়। গ্রামের এই মাথা থেকে ঐ মাথা পর্যন্ত সারাদিন সাইকেল চালাতাম।
এই ভাবে সাইকেল চালাতে চালাতে একদিন হঠাৎ মনে হলো সাইকেল চালিয়ে নানার বাড়ী চলে যাই। আমার দাদার বাড়ী থেকে আমার নানার বাড়ী ১০/১২ কিলো দুরে। মাঝখানে একটা ফসলের মাঠ, একটা গ্রাম আর একটা নদী আছে। আমার মামারা প্রায়ই সাইকেলে করে আমার দাদার বাড়ী আসতো আবার আমার বাবাও সাইকেলে করে নানার বাড়ী যেতো।আর আমিও আম্মার সাথে গরুর গাড়ীতে করে অনেকবার দাদা বাড়ী থেকে নানা বাড়ী আর নানা বাড়ী থেকে দাদা বাড়ী করেছি। তো যে ভাবা সেই কাজ।একদিন বিকালে কাউকে কিছু না বলে সাইকেল চালাতে চালাতে নানাবাড়ীর পথ ধরলাম ।আমার দাদা আর নানাকে ঐ এলাকার লোকজন চিনে তাই নদীতে খেয়া পারাপারেও কোন সমস্যা হলো না,দাদার নাম বলাতে মাঝি আর ভাড়া নিলো না । উল্লেখ্য আমাদের এলাকায় মাঝি, কামার ,নাপিত, মুচি এরা বছরে একবার বাড়ী বাড়ী গিয়ে ধান-চাল সংগ্রহ করে আর সারা বছর ফ্রি সার্ভিস দেয়।নানাবাড়ীতে পৌঁছাতেই তারা অবাক হয়ে গেল, এতো ছোট ছেলে একা একা কিভাবে আসলো??
এদিকে সন্ধ্যার হয়ে গেলেও আমি বাড়ী না ফেরাতে দাদাবাড়ীর লোকজন আমাকে খোঁজা শুরু করলো।রাতেই আশে পাশে সব আত্মীয়স্বজনের বাড়ীতে খোঁজা হয়ে গেল আর পরদিন সকালে নানাবাড়ীতে লোক পাঠানো হবে এই সিদ্ধান্ত হলো । পরদিন সকালে যথারীতি এক চাচা আমার নানাবাড়ীতে উপস্থিত হয়ে গেল আর আমাকে দাদাবাড়ীতে নিয়ে যাওয়ার জন্য জোর করতে লাগলো। এদিকে নানাবাড়ীতে একটা ছাগী চাল খেয়ে অসুস্থ হয়ে গেছে। চাল খেলে নাকি ছাগল আর বাঁচে না। ছাগীটা শুধু ভ্যা ভ্যা করছিলো আর একটু পর পর মাটিতে পড়ে যাচ্ছিলো । ছাগীটার আবার দুইটা দুগ্ধপোষ্য বাচ্চা ছিলো, তাই সবাই চিন্তা করছিলো কি করা যায়।শেষ পর্যন্ত ছাগীটাকে জবাই করা হলো।তখন নানা বললো এখনই না গিয়ে দুপুরে ছাগীর মাংশ দিয়ে ভাত খেয়ে বিকাল বেলায় যেতে আর চাচাকে সকালেই দাদা বাড়ীতে পাঠিয়ে দেওয়া হলো।
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পরে আমি আমার বিমান(তখন আমার কাছে সাইকেল ছিলো বিমানের মতো) নিয়ে বের হলাম দাদা বাড়ী যাওয়ার জন্য। নানা নানী জিজ্ঞেস করলো একা যেতে পারবি তো, আমি বললাম পারবো।তারপর আবার সাইকেল চালাতে চালাতে দাদা বাড়ীর দিকে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছিলাম।নানা বাড়ীর গ্রাম পার হয়ে আসলাম, নদী পার হলাম, আরো একটা গ্রাম পার হলাম, ফসলের বড় মাঠটাও পার হয়ে দাদা বাড়ীর গ্রামের একদম কাছে চলে আসলাম। এমন সময় দেখলাম এক রাখাল ইয়া বড় বড় শিং ওয়ালা মোটা মোটা ৩ জোড়া মহিষ নিয়ে পুরোটা রাস্তা দখল করে আমার উল্টো দিক থেকে আসছে। আমি যে সাইড দিয়ে যাব সেই রকম কোন ফাঁক অবশিষ্ট নাই।আমি জোরে জোরে বেল বাজাতে লাগলাম আর ভাবতে লাগলাম রাখাল মনে হয় আমাকে একটু সাইড করে দিবে। কিন্তু না রাখালের মাঝে সেইরকম কোন লক্ষন দেখলাম না, সে আরেকটা রাখালের সাথে বিড়ি ধরাতে ব্যস্ত।একবার ভাবলাম যে সাইকেল থেকে নামি, আবার ভাবলাম নামলে যদি মহিষ গুতা দেয়।তাই আর নামলাম না। এদিকে মহিষ একটু একটু করে আমার দিকে এগিয়ে আসছে আর আমিও একটু একটু করে মহিষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আর বেল বাজাচ্ছি ।মহিষও এগিয়ে আসছে, আমিও এগিয়ে যাচ্ছি। ।মহিষও এগিয়ে আসছে, আমিও এগিয়ে যাচ্ছি। ।মহিষও এগিয়ে আসছে, আমিও এগিয়ে যাচ্ছি। এই রকম করতে করতে এক সময় আমি মহিষের মাথায় সাইকেল লাগিয়ে দিলাম।তখন মহিষটা কি করলো ?? মহিষটা মাথাটা একটু দোলালো (মানে শিং দিয়ে গুতা দিলো)। আর আমি?? সাইকেল সহ উড়ে গিয়ে রাস্তার পাশে খাদে গিয়ে পড়লাম।শীতের সময় হওয়াতে খাদে হাঁটু পানি ছিল।সাইকেল আর আমি কাদা পানিতে মাখামাখি হয়ে গেলাম।আশেপাশের লোকজন হৈ হৈ করতে করতে ছুটে আসলো।কেউ বলছে মাথায় পানি ঢাল, কেউ বলছে ছেলেটার বাড়ী কোথায়, কেউ বলছে কোথায় ব্যাথা লাগলো, কেউ আবার রাখালকে গালী দিতে লাগলো।এদিকে আমার মনে হচ্ছে আমি যেন স্বপ্ন দেখছি, তাই নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখলাম না আমি স্বপ্ন দেখছি না।তখন আম্মার কথা মনে হলো, আম্মা তো এমনিতেই আমার পিঠে লাঠি ভাঙ্গবে আর এই রকম কাদা মাখা অবস্থায় দেখলে তো কিয়ামত হয়ে যাবে। আমি তাড়াতাড়ি খাদের ভিতর থেকে দৌড় দিয়ে উঠে আবার সাইকেল চালাতে চালাতে দাদাবাড়ীতে পৌছে গেলাম। দাদাবাড়ীতে পৌছাতেই আম্মা আমাকে টিউবয়েলের কাছে নিয়ে গিয়ে গোসল করিয়ে দিল। আর সাইকেল কাহিনী এখানেই শেষ হলো।