তখন আমি ছোট। ক্লাস 3 কি 4 এ পড়ি। বাবা চাকরি করতেন গাজীপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরীতে। সেই সূত্রে আমরা থাকতাম ঐ ফ্যাক্টরীর অফিসার্স কলোনীতে।সেখানে বিভিন্ন আর্থিক অবস্থা সম্পন্ন পরিবারের বসবাস ছিল।আমরা কিছুটা দূর্বল আর্থিক অবস্থাসম্পন্ন ছিলাম।সবল আর্থিক অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের আমাদের বয়সী ছেলে মেয়েরা ছোট ছোট সাইকেল চালাতো কলোনীর রাস্তায় , লোভাতুর দৃষ্টিতে আমরা তাকিয়ে থাকতাম।বাবা মায়ের কাছে সেইরকম সাইকেল চেয়ে যে বায়না ধরিনি তা না। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে তা আর পাওয়ার খাতায় যোগ হয়নি।
আমাদের বাড়ী কুষ্টিয়া জেলায়।প্রতি বছরই ২/১ বার বাড়ীতে যাওয়া হয়। গ্রামের প্রতি বাড়ীতে কমপক্ষে একটি সাইকেল আছেই(কোন মাফ নাই), কোন কোন বাড়ীতে ২/৩ টা সাইকেলও আছে ।যে একদম গরীব সেও হয়তো এই সাইকেলে করে মদন কটকটি বা বাদাম ভাজা কিংবা আইসক্রিম বিক্রির ব্যবসা করে।গ্রামে আবার কিছু EXCLUSIVE সাইকেল আছে, যেসব সাইকেলের EXTRA CARE নেওয়া হয়।গ্রামে গেলেই এর ওর সাইকেল নিয়ে টানাটানি শুরু করে দিতাম। অনেকেই সাইকেল দিতে চাইতো না, ফেলে দিয়ে ভেঙ্গে ফেলবো সেই জন্য। অনেকে আবার বকাও দিতো।তারপরও কোন না কোনভাবে একটা সাইকেল নিয়ে নিতাম। সেই সাইকেলে চড়তে পারতাম না ঠিকই কিন্তু সাইকেল নিয়ে টানা হ্যাঁচড়া অবিরত থাকতো। তারপর হয়তো আবার গাজীপুরে চলে আসতাম।বছর ঘুরে ঈদ আসলে আবার গ্রামে যাওয়া হতো।সাইকেল নিয়ে আবার টানাটানি।এইবার এক দাদা দেখিয়ে দিল কিভাবে MONKEY STYLE এ সাইকেল চালাতে হয়।শুরু হলো MONKEY STYLE এ সাইকেল চালানোর সংগ্রাম। কখনো সাইকেল পড়ে যায়, কখনো আমি পড়ি , কখনো আবার সাইকেল সহ আমি পড়ে যাই।ভালো মতো CONTROL করতে পারিনা।প্যাডেল দিতে গেলে হ্যান্ডেল ঠিক থাকেনা আবার হ্যান্ডেল ঠিক করতে গেলে প্যাডেল দিতে পারিনা।এই যখন অবস্থা তখন এক চাচা একটা ঢাল দেখিয়ে দিল, ঢালের উপরে উঠে সাইকেল ছেড়ে দিলে আর প্যাডেল করা লাগে না।এইভাবে আরও কিছু দিন চললো। তারপর একসময় MONKEY STYLE এ EXPERT হয়ে গেলাম।গ্রামের অনেক ছেলেকে দেখেছি MONKEY STYLE এ DOUBLE চালাতে । আমিও MONKEY STYLE এ উঁচু নিচু , ভাংগা রাস্তায় চালাতে লাগলাম। এরপর হয়তো আবার গাজীপুরে ফিরে আসতাম, আবার স্কুলে যাওয়া শুরু হতো।বছর দুয়েক পরে আবার গ্রামে যেতাম। এইবার অনেকেই উতসাহ দিলো PROMOTION এর জন্য অর্থাত MONKEY STYLE কে ORGINAL STYLE এ CONVERT করার জন্য । অনেক গ্রামের অনেক ছেলেকে দেখতাম প্যাডেলের নাগাল পাচ্ছে না কিন্তু হাফ প্যাডেলে বা ফুল প্যাডেলে দারুনভাবে ORGINAL STYLE এ সাইকেল চালাচ্ছে। গ্রামে যাওয়ার পর সবার উতসাহে আমিও ORGINAL STYLE এ চালানোর জন্য চেষ্টা শুরু করলাম। কিন্তু ২/১ মিনিটের বেশী আমি সাইকেলের উপরে থাকতে পারছি না। কিন্তু চেষ্টা চলছেই। CONVERT করার এই প্রচেষ্টাকে অনেকটা অসমাপ্ত রেখেই আবারো ফিরে যেতে হলো গাজীপুরে।গাজীপুরের কলোনীতে আমার বেশ কয়েকটা ক্লাসমেট ছিলো।আমার সেই সব ক্লাসমেটরা সাইকেল চালনার এই প্রচেষ্টায় যে হাত গুটিয়ে বসে আছে তা কিন্তু নয়। তারাও তাদের মতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।তাদের সমস্যাটা হলো সাইকেলের অভাব। একসময় তারাও আবিস্কার করে ফেললো এক জায়গায় সাইকেল ভাড়ায় পাওয়া যায়।এক ঘন্টা ৫ টাকা করে সাইকেল ভাড়ায় পাওয়া যেতো। সেই জায়গা থেকে সাইকেল ভাড়া নিয়ে এরই মধ্যে ২/১ জন সাইকেল চালানো শিখে ফেলেছে। আর সাইকেল চালানো শিখে ফেলার পরে সাইকেল চালানোর নেশার কথা মনে হয় কাউকে বলে বুঝাতে হবে না। তারা সেই নেশার তৃষ্ণায় তৃষ্ণিত । হাতের কাছে আমাকে পেয়ে তারা আমাকে ধরলো , তাদের সাথে চুক্তি হলো আমি ৫ টাকা দিয়ে সাইকেল ভাড়া করবো আর তারা আমাকে সাইকেলে চালানো শিখিয়ে দেয়ার পর বাকি সময়টা তারা চালাবে।যে কথা সেই কাজ। একদিন সকালে আমরা ৩ জন চলে গেলাম যেখানে সাইকেল ভাড়া পাওয়া যায় সেইখানে । জায়গাটার নাম শিমুলতলী ,বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস তথা টাকশালের খুব কাছে, আমাদের বাসারও কাছে।টাকশালে ঢোকার পথে একটা লম্বা রাস্তা আছে, তখন টাকশাল কেবল তৈরী হচ্ছে , টাকশালের রাস্তাও নতুন আর বেশ মসৃন। যথারীতি সাইকেল ভাড়া নেওয়া হলো, টাকশালের রাস্তায় চলে গেলাম ৩ জন, সাইকেলটা ছিল লাল আর বেশ নিচু (আমি আবার সাইজে বড়তো তাই নো প্রবলেম)। তারা আমাকে সাইকেলের উপরে তুলে দিলো আর ২ জন ২ দিকে সাইকেলের ক্যারিয়ার ধরে দাড়ালো আর আমাকে বললো প্যাডেল দিতে। আমি প্যাডেল দিচ্ছি, সাইকেল সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আর ওরা ২ জন ২ পাশে ধরে দৌড়াচ্ছে।অনেক দুর যাওয়ার পর হঠাৎ খেয়াল করলাম ওরা সাইকেল ছেড়ে দিয়েছে আর আমি একাই সাইকেল চালাচ্ছি। তারপর অনেকক্ষন টাকশালের রাস্তায় সাইকেল চালানোর পরে সাইকেলটা ওদেরকে দিয়ে আমি বাসায় চলে আসি।
বি:দ্র: আমি যতদুর জানি সাইকেলের সিটে না বসে নিচ দিয়ে চালানোকে MONKEY STYLE এ সাইকেল চালানো বলে।
চলবে ।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জুলাই, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:৫৫