আমার মনে রে বোঝাই কিসে – লালন ফকির
আমার মনে রে বোঝাই কিসে।
ভব-যাতনা আমার
জ্ঞান-চক্ষু আন্ধার
ঘিরল রে যেন রাহুতে এসে।।
যে আশাতে আমার ভবে আসা হল,
অসার ভাবিয়ে জন্ম ফুরাইল;
পূর্বে যে সুকৃতি ছিল
পেলাম সেহি ফল,
না জানি কি আর হবে রে শেষে।।
আমি গুনে আনি দেয়া, হয়ে যায় রে কুয়ো
আমার হল তেমনি সকল কর্ম ভুয়ো
কারে বলব এসব কথা
কে ঘুচাবে ব্যথা,
মন আগুনে মন দগ্ধ হতেছে।।
এ ভুবনে বিধি বড় বল ধরে
কর্মফাঁসে বেন্ধে মারিল আমারে;
কেন্দে লালন ফকির সদায়
দিছে গুরুর দোহাই
আর যেন আসি নে এমন দেশে।।
আমার ঘরের চাবি পরেরই হাতে – লালন ফকির
আমার ঘরের চাবি পরেরই হাতে।
কেমনে খুলিয়া সে ধন দেখবো চক্ষেতে।।
আপন ঘরে বোঝাই সোনা
পরে করে লেনা দেনা
আমি হলাম জন্ম-কানা
না পাই দেখিতে।।
রাজি হলে দরওয়ানি
দ্বারা ছাড়িয়ে দেবেন তিনি
তারে বা কৈ চিনি শুনি
বেড়াই কুপথে।।
এই মানুষে আছে রে মন
যারে বলে মানুষ-রতন
লালন বলে, পেয়ে সে ধন
পারলাম না চিনতে।।
আপনাকে আপনে যে জন জানে – লালন ফকির
আপনাকে আপনে যে জন জানে,
আপন আত্মাকে দেখেছে নয়নে।
সবে বলে আমি আমি,
আমি কে তা কেউ না জানে।।
ও মন আপনাকে যে চিনেছে,
নিগূঢ় তত্ত্ব সেই পেয়েছে,
সে জন নিগুমে বসে
আগমে ধরে টানে।।
ও মন মালাকুতের মোকামে পানি,
লাহুতের মোকামে অগ্নি,
জবরুতের মোকামে পানি
হাওয়া চালাচ্ছে নাসুতের মোকামে।।
ও মন তার উপরে মণিকোঠা
তাতে কিছু না যায় টোটা
সে তো বসিয়ে আছে হয়ে টোটা
সে ঢাকায় বসে দিল্লীর খবর জানে।।
আজব আয়না-মহল মণি গভীরে – লালন ফকির
আজব আয়না-মহল মণি গভীরে।
সেথা সতত বিরাজে সাঁই মেরে।।
পূর্ব দিকে রত্ন-বেদী
তাহার উপরে খেলছে জ্যোতি
তারে যে দেখেছে ভাগ্যপতি
সে জন সচেতন সব খবরে।।
জলের ভেতরে শুকনো জমি
আঠার মোকামে তাই কায়েমি
নিঃস্বাদ স্বাদের উদ্গামি১
সে মোকামের খবর জান গে যা রে।।২
মণিপুরের হাটে মনোহারী কল
তেহাটা ত্রিপিণী আছে বাঁকা নল
মাকড়শার আশে বন্দী সে জল
লালন বলে সঙ্গী বুঝবে ফেরে।।
আপন ঘরের খবর লে না – লালন ফকির
আপন ঘরের খবর লে না।
অনায়াসে দেখতে পাবি
কোনখানে কার বারামখানা।।
কোমল ফোটা কারে বলি
কার মোকাম তার কোথায় গলি
কোন সময় পড়ে ফুলি
মধু খায় সে অলি জনা।।
অন্য জ্ঞান যার সখ্য মোক্ষ
সাধক উপলক্ষ
অপরূপ তার বৃক্ষ
দেখলে চক্ষের পাপ থাকে না।।
শুষ্ক নদীর শুষ্ক সরোবর
তিলে তিলে হয় গো সাঁতার
লালন কয়, কৃতি-কর্মার
কি কারখানা।।
আছে আদি মক্কা এই মানব দেহে – লালন ফকির
আছে আদি মক্কা এই মানব দেহে
দেখ না রে মন চেয়ে।
দেশ-দেশান্তর দৌড়ে এবার
মরিস্ কেন হাঁপিয়ে।।
করে অতি আজব ভাক্কা
গঠেছে সাঁই মানুষ-মক্কা
কুদরতি নূর দিয়ে।
ও তার চার দ্বারে চার নূরের ইমাম
মধ্যে সাঁই বসিয়ে।।
মানুষ-মক্কা কুদরতি কাজ
উঠছে রে আজগুবি আওয়াজ
সাততলা ভেদিয়ে।
আছে সিংহ-দরজায় দ্বারী একজন
নিদ্রাত্যাগী হয়ে।।
দশ-দুয়ারী মানুষ মক্কা
গুরুপদে ডুবে দেখ না
ধাক্কা সামলায়ে।
ফকির লালন বলে, সে যে গুপ্ত মক্কা
আমি ইমাম সেই মিঞে।
ওরে সেথা যাই
কোন পথ দিয়ে।।
অমাবস্যার দিনে চন্দ্র থাকেন যেয়ে কোন শহরে – লালন
অমাবস্যার দিনে চন্দ্র থাকেন যেয়ে কোন শহরে।
প্রতিপদে হয় সে উদয়, দৃষ্ট হয় না কেন তারে।।
মাসে মাসে চন্দের উদয়
আমাবস্যা মাস-অন্তে হয়
সূর্যের অমাবস্যার নির্ণয়
জানতে হবে নেহাজ করে।।
ষোল কলা হলে শচী
তবে তো হয় পৌণমাসী
পনরই পূর্ণিমা কিসি
পণ্ডিতেরা কয় সংসারে।।
জানতে পারলে দেহ-চন্দ্র
স্বর্গ-চন্দ্রের পায় সে খবর
সিরাজ সাঁই কয়, লালন রে তোর
মূল হারালি কোলের ঘোরে।।