শিরোনামহীন
ফজলুল মিরাজ
এই লিখনিটি বাবা দিবসে র । তাই আমার বাবাই এর কেন্দ্রিয় চরিত্র। বাবা এমনই এক চরিত্র যার জন্য কোন শব্দই যথার্থ নয়। আমার বাবা যিনি তার ছয় বছর বয়সে পিতৃহারা হন। বড় বোনের বাড়িতে থেকে পড়ালেখা করেন। ব্যাবসা করেন , শেষে কৃষিকাজ করেন ।
অতি সাধারন একটি জীবন কাহিনি । অথচ তিনি ছিলেন অসাধারন। তিনি সোনালি ব্যাংক এ চাকুরি পেয়ে তা
না নিয়ে ব্যাবসা করেছেন , কৃষি কাজ করেছেন । তিনি উৎপাদনে বিশ্বাস করতেন । দাদা পরদাদার প্রাপ্ত সম্পত্তি কাজে লাগিয়ে আমাদের তখন গোলাভরা ধান , পুকুর ভরা মাছ আর গোয়াল ভরা গরু। গ্রামের সবচেয়ে সচ্ছল পরিবার বলতে সবাই আমাদের বুঝত । তার জীবন ছিল আদর্শে পরিপূর্ণ । তিনি জীবনে কারো কোন ক্ষতি করেছেন বলে আমার জানা নেই। তার কিছু উপদেশ আর কর্মকাণ্ড আজকের আলোচনার বিষয় । আমার বিশ্বাস পাঠকদের জীবনে উক্ত উপদেশ কাজে লাগতে ও পারে।
ছোট বেলায় আমি প্রচুর কথা বলতাম,এখনো বলি। যে কোন ব্যাপারে দুটো কথা না বলে শান্তি পেতাম না। নিজেকে আলোচনার অংশ মনে করে ধন্য হতাম। সেই কথা গুলো যে সব সময় যুক্তিপূর্ণ হতো না বাবা তা বুঝতেন। তখন বলতেন আগে জ্ঞান অর্জন করো পরে বিতরন করো অস্প বিদ্যা সত্যিই ভয়ংকর। সমাজের বিশৃঙ্খলা কিন্তু জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারনেই হয়। যেমন ধর্মে জিহাদের কথা আছে , তাই ভাংচুর । ধর্মে তো জিহাদের আগে শান্তির কথা ও আছে। দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ তাই হরতাল অবরোধে দেশকে পঙ্গু করে জালেম সরকারের হাত থেকে মুক্তি । তারপর যে সরকার আসবে সে জালেম হয়ে যাবে। আবার ভাংচুর হবে। কোন বিবেক বান জ্ঞানী লোক এসব করতে পারে না। আমরা অবুঝ তাই নিজের দেশের সম্পদ নিজেরা ভাংতে আমাদের একটু ও লজ্জা ও করে না।
ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চলছে বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে , মুসলমানদের হত্যা করা হচ্ছে । আমার প্রিয় বন্ধু আমার কাছে এসে বলল বাবরি মসজিদ এবং মুসলমানদের হত্যা করার কথা। আমাকে বলল আমরা আজ প্রতিবাদ মিছিল করব । আমি জিজ্ঞাস করলাম প্রতিবাদ মিছিলে কি হবে । সে বলল আমরা সবাই প্রতিবাদ মিছিল করলে , সরকারের টনক নড়বে , সরকার রাষ্ট্রীয় ভাবে প্রতিবাদ করলে ভারত সরকার তাদের দেশে আমাদের মুসলমান ভাইদের নিরাপত্তার উদ্যেগ নেবে। আমার কিশোর মন রাজনৈতিক হিসাব বুঝে না। তাই আমি ও নির্বিচারে হত্যার প্রতিবাদে মিছিলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমরা মাত্র বাজারে উপস্থিত হতে না হতেই একদল শুরু করল হিন্দু যে লোক সবছেয়ে ধনি তার বিল্ডিং এ হামলা। আমার বন্ধু আমাকে টেনে জটলার মধ্যে নিয়ে গেল। এমন সময় বাজার কমিটি বলল তোমারা যদি এ বিল্ডিং এ আগুন দাও পুরো বাজার পুড়ে যাবে। বাজার কমিটির সাথে মুক্ত চিন্তাশীল কিছু মানুষকে দেখা গেল। বাজার আগুন থেকে রক্ষা পেল । যথারীতি বাবার কাছে খবর এল আপনার ছেলে থাকায় কেউ কিছু বলেনি। বাবা আমাকে লোক পাঠিয়ে আমাকে নিয়ে গেল। তার পর বললেন তোমার মায়ের অসুখের সময় ঐ ডাক্তার যখন সারা রাত জেগে ছিল , সে কি ভেবেছিল কে হিন্দু আর কে মুসলমান । বাবা আমাকে বুঝিয়ে বললেন সাম্প্রদায়িকতার উপরে মানুষ সত্য । দেশের সম্পদের রক্ষা করার জন্য তোমাকে শিক্ষিত করা হচ্ছে , ধ্বংস করার জন্য নয়। যদি ও আমার মধ্যে ভাংচুরের কোন চিন্তা ছিল না আমি ভাংচুর করিনি তবু ও নিজেকে অপরাধি মনে হল। বাবা সেদিন সত্যিই দেশপ্রেম বুঝিয়ে ছিলেন অনেক সময় নিয়ে । আমি আর কোন দিন এ পথে হাটিনি। আমার দুঃখ হয় আমার ছাগু বন্ধুরা আজো সেই চেতনা ধারন করে। যখন সাইদিকে চাঁদে দেখা গেছে বলে কিশোর ছেলে গুলোকে দিয়ে পুলিশ হত্যা করায় অথবা মায়ের বুক খালি করে , আমার বুকের ভিতর কষ্ট হয় , আমার কৈশোরের স্মৃতি ভেসে উঠে, আমি ভাবি তাদের কেন আমার বাবার মত একজন বাবা নেই ?
উপসাগরীয় যুদ্ধ শুরু হলো , আমেরিকা ইরাক দখল করল , আমি আমার বাবার সাথে বাজার করতে গেলাম। জ্বালানি তৈলের দাম হু হু করে বাড়বে ,সবাই যার যার সাধ্যমত তৈল কিনে রাখছে ।পরে যেন বেশি দাম দিয়ে কেনা না লাগে। দোকানী পূর্ব পরিচিত , বলল মিয়া সাহেব আপনাকে এক ড্রাম দিয়ে দিই। অনেক সাশ্রয় হবে । পরে বাজারে তৈল না পাওয়া যেতে পারে। বাবা বললেন না তা হয় না, আমাকে সব সময় এক গ্যালন দাও। এখনো ঠিক তাই দাও। আমি যদি এক ড্রাম নিয়ে যাই পঞ্চাশ জন লোক তো এমনিতেই তৈল পাবে না । সবাই যদি এভাবে মজুদ করে বাজারে তো এমনিতেই তৈলের সংকট পড়বে। তৈলের দাম এমনিতেই বাড়বে। আর যদি তৈলের সংকট পড়ে তবে দেশের অনেক মানুষই অন্ধকারে থাকবে, আমি ও না হয় আমার সন্তানদের নিয়ে অন্ধকারে থাকলাম । এলাকার মানুষ অন্ধকারে থাকবে আর আমি আলোতে থাকব তুমি ভাবলে কি করে। প্রিয় পাঠক আপনাদের মনে হতে পারে এটা একজন জনপ্রতিনিধির কথা , না তিনি কখনো জন প্রতিনিধি হবার চেষ্টা করেন নি । অনেকে আবদার করেছিল তিনি না করে দিয়েছেন।
আমার বড় দুই ভাই এবং এক বোন ও আমি আমরা চার জন চার টেবিলে চারটি হারিকেনের আলোয় পড়তাম। বাবা মাকে বললেন দেশে তৈলের সংকট পড়তে পারে , বাবা মা মিলে আমাদের দুই টেবিলে দুই হারিকেনের আলোয় নিয়ে আসলেন। এখন আমি বাবার সে মুহূর্তের দেশপ্রেম বুঝতে পারি । আমার কানে বাবার সেই কথাটি শুনতে পাই দেশের মানুষ অন্ধকারে থাকলে আমি ও আমার সন্তানদের নিয়ে অন্ধকারে থাকবো। বাবা তোমায় সালাম। বাবা তোমায় ভালোবাসি। বাবা তোমার ছোট ছেলে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিঙয়ে ব্যাচেলার শেষ করল । আমরা সবাই আশা করি দেশকে ভালবেসে তুমি চারটি বাতিকে দুটি করেছ । তোমার ছেলে যেন তা দুই কোটি বাতি জ্বালিয়ে পুরো বাংলাকে আলোকিত করে দেয়।
এভাবেই দেশের দুর্যোগে হাজার হাজার বাবা মায়েরা চারটি বাতিকে দুটি বাতিতে এনে দেশটাকে বাঁচিয়ে রাখেন। যার ফলাফলে অর্থনীতি। অথবা কোন এক বাবা বলে বসেন চার হাজার কোটি টাকা কোন টাকা না অথবা শেয়ার বাজার মোট অর্থ বাজারের এক শতাংশ । সেই বাবা ও দেশের জন্য এই বয়সে প্রচুর পরিশ্রম করেন। অথচ বেফাঁস মন্তব্যের কারনে আমার মত অধম ও তার সমালোচনা করতে বাধ্য হয়। আমি যখনই বাবার আদর্শ ভুলেছি তখনই বিপদে পড়েছি। প্রতিটি সন্তানের মানবিকতাবোধ শিক্ষা পরিবার থেকে প্রাপ্য। আপনার সন্তান যেন এ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত না হয়।
বাবা সৌখিন কৃষক ছিলেন । তিনি শ,খানেক কাঠের গাছ এবং ফলের গাছ সাথে সিম বাগান করালেন । আমাকে দায়িত্ব দেয়া হল বিকালে পানি দেয়ার বিনিময়ে আমার পছন্দমত দোকান থেকে আমার টিপিন। আমি তখন ৫ম বা ৬ষ্ট শ্রেনীর ছাত্র । আমি আমার প্রথম পারিশ্রমিক পেতে শুরু করলাম। এভাবেই তিনি চেষ্টা করেছেন সন্তানকে শ্রমের মূল্য শিক্ষা দিতে। কয়েক সাপ্তাহ পরে আর পানি দিতে হয় না । গাছ গুলো বড় হয় , ফল হয় ,আমার ভিতর প্রচন্ড আনন্দ হয় আর আমি বুঝতে পারি সৃষ্টির আনন্দ । বাবা শশ্রদ্ধ প্রণাম তোমায়। পরে আমার ম্যাট্রিক এবং ইন্টারমিডিয়েটের বেতন এবং ফরম ফিলাপের টাকা বাবা সেই গাছ বিক্রি করে পরিশোধ করলেন। সন্তানকে কর্ম মুখী করতে এবং শ্রমের মুল্য শিক্ষা দিতে , তার খরচ বহনে এর চেয়ে ভাল উদাহরন কি হতে পারে।
স্কুল টিপিন আর কলেজের যাতায়াতের খরচ বাবা প্রতিদিন সকালে দিতেন। এতে বিরক্ত হতাম , প্রতিদিন সকালে বাবার কাছ থেকে টাকার জন্য দাঁড়িয়ে থাকা। বাবার এক বন্ধু বলল আপনি প্রতিদিন কেন দিন মাসের টাকা এক সাথে দিয়ে দিন। বাবা বললেন বাচ্ছা ছেলে একসাথে অনেক টাকা পেলে মাথায় কোন চিন্তা আসে , শেষে পড়াশোনার ক্ষতি হতে পারে। আর একটু বড় হোক । সত্যিই সন্তানকে নিয়মের মধ্যে পালন করার যে মহত্ত তার তুলনা আমার বাবা। আমি যত দিন বাবার নিয়ন্ত্রণে ছিলাম আমার কোন বদ অভ্যাস হয়নি।
আপনি কি আপনার সন্তানকে দেশপ্রেম আর মানবিক মুল্যবোধ শ্রমের মূল্য শিক্ষা দিচ্ছেন । দেশের প্রতিটি সন্তানকে নিয়েই আমাদের আগামি প্রজন্ম । যে প্রজন্মের নিয়ন্ত্রণ আমাদের নেই , সেই প্রজন্মের সমালোচনার যোগ্য আমরা নই । তাঁহারা তাঁহাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা নিশ্চই করেছেন। কোথাও সফল কোথাও নয়। যে প্রজন্ম বর্তমান তারা যেন ভেদাবেদ ভুলে যায়। যে প্রজন্ম অনাগত ইতিহাস যেন তাদের বিভ্রান্ত না করতে পারে। একটি দেয়ালের গাঁথুনি আর উপাদানের উপর নির্ভর করে তার শক্তি। আপনার সন্তানের সেই গাঁথুনি শক্ত করে দিন ,দেশপ্রেম , মানবিকতাবোধ , কর্ম তৎপর বিচক্ষনতায় । জীবনকে আর ভবিষ্যৎ কে মোকাবেলার শক্তি সে নিজেই খুজে পাবে।
যে দেশের বাবা মায়েরা চারটি বাতির কাজ দুটি বাতিতে করেন। সেই দেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ অবশ্যই আলোকিত। সেই আলোর জন্য প্রয়োজন যুগোপযোগী পদক্ষেপ। আমাদের এই দেশে প্রতিভার অভাব নেই । প্রয়োজন দিক নির্দেশনা । সেই দিক নির্দেশনা দেয়ার মত প্রতিভা ও দেশ থেকে এবং সারা বিশ্ব থেকে উঠে আসছে । বাংলাদেশ মাথা উচু করে দাড়াবেই ইনশা আল্লাহ্....।।