জন্ম কথা
ফজলুল মিরাজ
এই লিখনীটি মা দিবসে পৃথিবীর শ্রেষ্ট মা আমার মা কে । প্রত্যেকের জন্যই তার নিজের মা শ্রেষ্ট ।
প্রত্যেক মানুষের জীবনে কিছু ঘটনা স্বরনীয় হয়ে থাকে। প্রকৃতির নিয়মে সাধারন মানুষের জীবনে অসাধারন ঘটনা ঘটে যেতে পারে । সাধারন মানুষের জীবনের অনেক ঘটনা প্রাদপ্রদীপের আলোয় আসে না । আবার অসাধারন লোকের সাধারন ঘটনা প্রাদপ্রদীপের আলোয় অসাধারন হয়ে উঠে । মাওলানা ভাষানী নিজে রান্না করছেন অসাধারন এক ছবি । নিচে হাজার হাজার মন্তব্য । কারন তিনি অসাধারন । হাজার হাজার সাধারন লোকের নিজে রান্না করে খাবার মত চাউল নাই, যার কোন ছবি ও নাই । কোন মন্তব্য ও নাই । অতি সাধারন তুচ্ছ ঘটনা ।
আমার জন্ম কথা ও অতি সাধারন তুচ্ছ ঘটনা । তবে যে অসাধারন মহীয়সী নারি আমায় গর্ভে ধারন করেছেন তিনি মহতি । এক একটি সন্তানের জন্য তার মা কি করেন তিনি তার ই প্রতিচ্ছবি । সন্তান মহৎ কি না সে প্রস্নের উত্তর আমার আলোচনার বিষয় নয়। প্রতিটি মায়ের সন্তানের জন্য যে পরিশ্রম তাই আজকের আলোচনার বিষয় । আমার মা তার এক অপূর্ব উদাহরন।
আমার জন্মের পূর্বেই আমার জননীর গর্ভে আর ও পাঁচ সন্তান এসেছিল । বড় ভাই শাখাওয়াত আজিম, মেজ ভাই মোজাম্মেল মকিম এবং বড় বোন মহিনুর লাবনী । প্রত্যেকের জন্মের এক দুই মাস আগেই আমার শ্রদ্ধেয় নানু জান তার বড় মেয়ের বাড়িতে চলে আসতেন। আমার বাবা তার জন্য রিজার্ভ রিকসা পাঠাতেন নানুজানের না করার সাধ্য নেই । বড় জামাই , এ জামাই বছরে দুই বছরে একবার শশুর বাড়িতে যান । তাও নিমন্ত্রণ ছাড়া তিনি শশুর বাড়িতে যান না । জমিদারের ছেলে বলে খ্যাত এ জামাই শশুর বাড়িতে যাওয়া মানে শশুর বাড়িতে আনন্দ উৎসব।
শ্রদ্ধেয় নানুজান দোয়া দুরুদে পাকা । সাথে কোরআন শরিফ, আয়াতুল কুরসি, নানা প্রকার তাবিজ পানি পড়া, ঔষধি , বনৌষধি সহকারে উপস্থিত হতেন । একে একে আমার মায়ের প্রথম তিন সন্তানের জন্মে আমার নানুর সাফল্য । জন্মের পর কিছু দিন থেকে তার মেয়েকে সুস্থ করে তুলে তিনি বিজয়ীর বেশে রিজার্ভ রিকসায় চেপে ফিরতেন। আমার মায়ের চতুর্থ সন্তান জন্মের এক সাপ্তাহ কি এক মাসের মধ্যেই সে মারা গেল। পঞ্চম সন্তানের ও একই পরিনতি। যাদের নাম রাখা হয়ে ছিল নুরু এবং আয়েশা। মৃতকে নাম রেখে কবর দিতে হয় । নুরু মারা যাওয়ার পর আমার নানু বিশেষ প্রস্তুতি নিয়ে আসলেন কিন্তু পঞ্চম সন্তান আয়েশাকে ও তিনি টিকিয়ে রাখতে পারলেন না। আমার নানুর সকল কেরামতি বৃথা গেল । দোয়া তাবিজ পানি পড়া পীর মুরশিদ। সবার ধারনা আচর। বাচ্চার উপর জ্বিন পরী, ভুত প্রেত , দেও দানব , আচর করে । তারা বাচ্চার জান খেয়ে ফেলে । আমার মা এখনো নামাজে বসলে তার ঐ দুই সন্তানের জন্য কাঁদেন । আমার মায়ের বিশ্বাস তারা নিঃস্পাপ শিশু , তারা বেহেস্তে আছে । মৃত্যুর পর তিনি তাদের দেখা পাবেন।
আমিই আমার মায়ের জীবিত চতুর্থ সন্তান । প্রিয় পাঠক বুঝতেই পারছেন আমার জীবনের লড়াই জন্মের পূর্বেই শুরু । আমার জন্মের প্রস্তুতি তাই খুব আঁটসাঁট বেধে নেয়া হল। আমার বাবা কখনো ড্রিঙ্কস করতেন না। তিনি স্মোক করতেন , তিনি স্মোক ছেড়ে দিলেন। আমার মা ঘর দোর বন্ধ করালেন। এই বন্ধ মানে দরজা জানালা বন্ধ করে রাখা নয় । পীর মুরশিদ , হুজুর দিয়ে দোয়া পড়ে এবং মাটির ঢাকনার মধ্যে আরবি দোয়া লিখে প্রতিটি দরজায় লাগানো। চারপাশে কুন্ডলী দিয়ে দোয়া পড়া , যেন জ্বিন পরী দেও দানব এর ভিতর প্রবেশ করতে না পারে। বাবা মায়ের পোশাক পরিস্কার রাখার নির্দেশ। পবিত্র দেহ মনে থাকার নির্দেশ । বাবা মা তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেন। আমার মায়ের গর্ভে আমার জন্ম হল। মা প্রতিদিন ফজরের নামাজ পড়ে কোরআন তেলোয়াত করেন । বাবা মাকে ভালবাসায় সেবা সশ্রুতায় রাখেন । মায়ের জন্য আলাদা কাজের লোক নিয়োগ করা হল । এমনিতেই তখন তিন চার জন কাজের লোক । তবু ও বাবা মায়ের রন মূর্তি , যুদ্ধ প্রস্তুতি , পর পর দু দুটি সন্তান মারা গেল । এ সন্তান টিকে বাঁচাতেই হবে । মা নামাজ কাজা করেন না। বাবা নিয়মিত শিংমাছের জোল , খাঁটি গরুর দুধ সহ সংসারে যেন কোন কিছুর অভাব না পড়ে সে দিকে প্রস্তুতি নিয়ে রাখলেন। মা নিয়মিত মহা মনিষীদের জীবনি পড়লেন ,হযরত মোহাম্মদ সঃ, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, বাংলার বাঘ শেরেবাংলা একে ফজলুল হক। পর বর্তীতে মায়ের ইচ্ছায় আমার নামের প্রথম অংশ তার নাম অনুসারে রাখা হল। তার ছেলে যেন চৌকস হয় তার জন্য আমার মায়ের যে ত্যাগ তার তুলনা পাওয়া যায় না ।
এদিকে আমার নানুজান তিনি ও এক মা আমার গ্র্যান্ড মাদার । তার এবারের প্রস্তুতি অনেক বড় । তিনটি বিজয়ের পর তার পর পর দু , দুটি বড় পরাজয়। এবার হারলে নানুজানের সিরিজ টাই হয়ে যেতে পারে। বিজয়ের ধারায় ফিরতে তিনি মরিয়া। কোচ বদল , ( I miss u grand mother ). তিনি এবার দূর দুরান্ত থেকে বড় বড় পীর মুর্শিদের তাবিজ পানি পড়া নিয়ে তিন মাস আগেই উপস্থিত। মা কে সব সময় বিশেষ নজরদারীর মধ্যে রাখা হল । সে তাবিজ দিয়ে বিশাল এলাকায় মাটিতে পুতে গোলাকার কুন্ডলী করা হল । পুরো এলাকায় হুজুর , পীর মোরশেদ দিয়ে ঘিরে ফেলা হল । জ্বিনদের বিরুদ্ধে হুজুর রা যুদ্ধ ঘোষণা করল ।
বিপুল সতর্কতার মধ্যে রবিবার সূর্যোদয়ের সময় সূর্যের হাসি নিয়ে আমার পৃথিবীতে আগমন।
পৃথিবীতে আমার লড়াই শুরু হয়ে গেল । আমার নানু আমার চারপাশে লোহার বেষ্টনী দিয়ে রাখেন তাও আবার হুজুরের পড়া। চারিপাশে ছোট ছোট লোহার গুটি । আমাকে খুব বেশি রোদে নেওয়া হত না তার ফলে আমার ত্বক কিছুটা ফর্শা রয়ে গেল। তবে ছোটবেলায় খুব হালকা পাতলা ছিলাম বোধহয় খুব ভিটামিন ডি,র অভাবে অথবা দেও দানবের সাথে দীর্ঘ লড়াইয়ের ফলে । আমার নাম রাখা হল মিরাজ যার অর্থ ঊর্ধ্ব গমন। বাবা মা নানু সহ নিকটজনদের ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে আমি পৃথিবীতে টিকে গেলাম । আমার নানুর সিরিজ জয় নিশ্চিত হল। আমার ছোট চার ভাই বোন , জ্বিন পরি এমন ই ভয় পেল তাদের ও কাছে আসল না ।
জীবনটাই বোধহয় এমন একবার শুধু ঘুরে দাঁড়ান ভুত প্রেত আজীবনের জন্য ভাগবে।
ফুটবলটা ভালোই খেলছি । আমার খেলা শিখা বড়দের কাছে । তাই সমবয়সীদের সাথে খেলতে গেলেই বিপত্তি। গোলের ব্যাবধান ১১-০ , ১৫ -৩ এই রকম । কিন্তু বড়দের তো সব সময় পাওয়া যায় না । শেষে আমার পরিবর্তে তিন জন , চার জন দিয়ে আমি ফুটবল খেলতাম। কিন্তু খেলা বন্ধ হতো না। শেষে স্কুল বন্ধুদের সাথে পাশের এলাকায় গিয়ে খেলতে শিখলাম। সেই লড়াই আজো চলছে ,এখন প্রবাসে , এখনো খেলছি জীবনের জন্য , কতটা ভাল খেলছি সে হিসাব নেই , নেই কোন গোলের হিসাব। সেই কাহিনী অন্যদিন হবে । আজ শুধু মায়ের জন্য আজ যে মা দিবস।
আমার মায়ের সাথে আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক , মা আমাকে প্রায় বলেন তোর জন্য সবার কি কষ্ট হয়েছিল তুই কি জানিস। আমার নানু আমাকে সব বলেছে , মা ও কিছু কিছু বলেছে। আমি মা কে বলি আমি তোমাকে, তোমাদের কত ভালবাসি তোমরা কি তা জান । কেউ যদি তোমাদের এত ভালবাসে তোমরা তো তার জন্য আর ও বেশি কষ্ট করা উচিত ছিল । কথার কথা। বাবা, মায়ের তুলনা তারাই।
ছোট বেলায় আমরা যখন ঠিক নামাজ পড়তাম না, তখন আমার মা খুব রাগ করতেন বলতেন আমার দুই সন্তান জান্নাতে আছে তারা আমাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে । ( সন্তান জান্নাতে গেলে বাবা মা কে নিয়ে যায় )।তোরা বে নামাজি হচ্ছিস জাহান্নামে যাবি , ইহকালে ও কষ্ট দিলি পরকালে ও দিবি । মাগো আমার বাবা তো প্রয়াত তার সেই দুই সন্তান নিঃশ্চই তাকে জান্নাতে নিয়ে গেছে। তোমাকে ও একদিন নেবে । আমরা তোমাকে জান্নাতে নিতে পারি বা না পারি। এই পৃথিবীতে সুখে রাখতে চেষ্টা করি । পারি বা না পারি , মনে রেখ মা তুমিই আমাদের বেহেশত। এই পৃথিবীতে এবং আখেরাতে। মায়ের পায়ের নিচে যে সন্তানের বেহেশত।