ষড়যন্ত্রের রাজনীতি ও আজকের বাংলাদেশ
ফকির ইলিয়াস
=========================================
একটি সংবাদ পিলে চমকানোর মতো। মূল কথা হচ্ছে ওরা বসে নেই। তারা চাইছে যে কোনোভাবে বর্তমান সরকারের পতন। খবর বেরিয়েছে, জামায়াতের অর্থায়নে দেশে একটি ‘পরিবর্তন’ আনার অপচেষ্টা চলছে। ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের ঊর্ধ্বতন এজেন্ট ক্ষমতাসীন লিকুদ পার্টির নেতা মেন্দি এন সাফাদির ফেসবুক পেজে গিয়ে দেখা গেছে, বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা। এতে বাংলাদেশবিরোধী বিভিন্ন স্লোগান ও প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করা হচ্ছে। বিশেষ করে বেশ কয়েকজনের হাতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নির্যাতনবিরোধী প্ল্যাকার্ড দেখা গেছে। এসব প্ল্যাকার্ডের একটিতে সংখ্যালঘু নির্যাতন ও হত্যা বন্ধ করার স্লোগান রয়েছে।
ইসরায়েলি বার্তা সংস্থা জেরুজালেম ডটকমের বরাতে জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর কথিত নির্যাতনের বিষয়ে বিশ্ব বিবেককে সোচ্চার হতে বলছে ইসরায়েল। দেশটির দাবি, বাংলাদেশে বর্তমান সরকারের পতন হলে পরবর্তী সরকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন বন্ধ ও তাদের সম্মানজনক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবে। সংবাদ থেকে আরো জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারকে উৎখাতে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের ষড়যন্ত্রে এবার জামায়াতে ইসলামীর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। ষড়যন্ত্র সফল করতে মৌলাবাদী এই দলটির পক্ষ থেকে মোসাদের পেছনে এরই মধ্যে বিপুল অঙ্কের তহবিল জোগান দেয়া হয়েছে। ষড়যন্ত্রের ফ্রন্টলাইনে আছেন জামায়াতের দেশি-বিদেশি শক্তি ছাড়াও বিএনপির কয়েকজন নেতাও।
আরেকটি সংবাদ আমাদের নতুন করে ভাবাচ্ছে। সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছেন- খালেদা জিয়া পাকিস্তানের এজেন্ট। তিনি বলেছেন, নির্বাচনের জন্য ‘অব্যাহতভাবে আইএসআই এজেন্টদের কাছ থেকে অর্থ’ গ্রহণ করছেন বিএনপির চেয়ারপারসন। উল্লেখ্য, এর আগে খালেদা জিয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে কমনওয়েলথের একটি বৈঠকে আলোচনার প্রস্তাব তুলেছিল পাকিস্তান।
৫৩টি রাষ্ট্রের জোট কমনওয়েলথের মিনিস্ট্রিয়াল অ্যাকশন গ্রুপ সদস্য দেশগুলোর রাজনৈতিক পরিস্থিতির গুরুতর অবনতি ঘটলে তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। কোনো দেশে গণতন্ত্র নির্বাসিত হলে তা পুনরুদ্ধারের পদক্ষেপও আসে এই ফোরাম থেকে। সেই ফোরামে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা সারতাজ আজিজ প্রস্তাবটি তুলেছিলেন। কিন্তু লন্ডনে কমনওয়েলথ মিনিস্ট্রিয়াল অ্যাকশন গ্রুপের ওই বৈঠকে সদস্য অন্য দেশগুলোর প্রতিনিধিরা উড়িয়ে দেয়ায় ইসলামাবাদের ওই প্রস্তাব হালে পানি পায়নি। এ নিয়ে সজীব ওয়াজেদ জয় তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘আমি আগেই বলেছি খালেদা জিয়া পাকিস্তানি এজেন্ট। তিনি অব্যাহতভাবে নির্বাচনগুলোর জন্য আইএসআই এজেন্টদের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করে আসছেন। তিনি যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী বানিয়েছিলেন। এখন পাকিস্তানি সরকার তার পক্ষে প্রকাশ্যে তদবির করছে।’
এই যে বিষয়গুলো ঘটে যাচ্ছে, তা কিন্তু বাংলাদেশের ভাবার বিষয়। আমাদের জানা আছে ইসরায়েল কে, তারা বিশ্বে কি করছে। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আটকে রেখেছে এই ইসরায়েল। আমাদের মনে আছে ২০১৪ সালের নির্মম হত্যাযজ্ঞের কথা। ওই গাজা হত্যাকাণ্ড শিরোনাম ছিল কয়েক মাস ২০১৪ সালে। এ নিয়ে বিশদ লিখেছিলেন ম্যাক্স বুমেনথাল। যিনি একজন পুরস্কার বিজয়ী সাংবাদিক এবং একটি বেস্ট সেলার বইয়ের লেখক। তার সর্বশেষ বই হচ্ছে ‘গোলিয়াথ : লাইফ এন্ড লোদিং ইন গ্রেটার ইসরায়েল’।
গত ১১ জুলাই ২০১৪ একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা প্রচার করেছিল কানাডার বাল্টিমোর থেকে পরিচালিত ডেইলি ভিডিও নিউজ ও প্রামাণ্যচিত্র (ডকুমেন্টারি) প্রচারের সংবাদ সংস্থা ‘দ্য রিয়েল নিউজ নেটওয়ার্ক’ এর ওয়েবসাইট ‘দি রিয়েলনিউজ’ ডটকম। সাংবাদিক আবুনিমাহ এবং ম্যাক্স বুমেনথালের আলোচনায় সঞ্চালক ছিলেন দ্য রিয়েল নিউজ নেটওয়ার্ক-এর প্রযোজক এন্টন ওরোনজাক। ওই আলোচনায় ম্যাক্স বুমেনথাল বলেছিলেন- ‘গাজা উপত্যকায় যেসব ফিলিস্তিনি বসবাস করছে তাদের প্রায় ৮০ শতাংশই শরণার্থী। ১৯৪৭ ও ১৯৪৮ সালে যেসব ফিলিস্তিনিকে সরিয়ে বর্তমান ইসরায়েল হয়েছে তাদের উত্তরসূরি এসব শরণার্থী। এখন তাদেরকে বলা হচ্ছে এখান থেকেও সরে যাওয়ার জন্য। তাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। বোমার আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য কোনো আশ্রয়কেন্দ্র নেই গাজাতে। এই শরণার্থীদের কোথাও পালানোরও জায়গা নেই। মিসরে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যারা ক্ষমতায় এসেছে তারা রাফাহ ক্রসিং দিয়ে মিসরে প্রবেশ করতেও দেবে না। তাই এটা আরেকটা মানব বিপর্যয় হতে যাচ্ছে যেটা ইসরায়েল প্রতি দুবছর পরপরই এই গাজা উপত্যকায় ঘটিয়ে থাকে।’
এই হলো ইসরায়েলের চরিত্র। যে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের ক‚টনৈতিক যোগাযোগ নেই। তারপরও তারা এখন বাংলাদেশে খবরদারি করতে চাইছে। কথাগুলো আরো স্পষ্ট করে বলেছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। তিনি বলছেন, সরকারের কাছে খবর আছে, বিএনপি ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহার করে বাংলাদেশকে একটি ধর্মান্ধ মুসলিম দেশ হিসেবে উপস্থাপন করে তারা তাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছে।
প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ‘বিএনপি ক্ষমতায় গেলে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি হবে। এটা যে কত বড় অপরাধ! আমার মনে হয় এখন সময় এসেছে এসব সাক্ষ্য-প্রমাণকে এক জায়গায় করে বাংলাদেশে বিএনপির রাজনীতি করার অধিকার আদৌ আছে কি না। নৈতিক অধিকারের বাইরে গিয়ে বলব, তাদের কোনো অধিকারই নেই। কারণ তারা অব্যাহতভাবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে যাচ্ছে।’
সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এখন অনেক চাপের মুখোমুখি। মাত্র কয়েক দিন আগে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল। প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার সঙ্গেও বৈঠকে মিলিত হয়েছেন। সব বৈঠকে উভয় পক্ষ একমত হয়েছেন আঞ্চলিক নিরাপত্তার স্বার্থে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের ওপরই নির্ভর করতে হবে। এই সরকার অস্থিতিশীল হয়ে পড়লে তা দেশকে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত করবে, তেমনি আঞ্চলিক নিরাপত্তার ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেবে। সফর শেষে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে এক টুইট বার্তায় বাংলাদেশ সফরকে ‘ফলপ্রসূ’ উল্লেখ করে নিশা বিসওয়াল লিখেছেন, ‘খুনি ও সন্ত্রাসীরা মৌলিক স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে অবমূল্যায়ন করার পাশাপাশি ভয়ের বীজ বপন করতে চায় এবং তাদের ঠেকানো আমাদের অভিন্ন লক্ষ্য।’
এরপরও আমাদের ভাবতে অবাক লাগে, ইসলামের নামে রাজনীতি করা কিছু দল কিভাবে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে হাত মেলাতে পারে, যারা প্রতিনিয়ত ফিলিস্তিনি মুসলমানদের হত্যা করছে। আসলে তারা ইসলামের কথা বলে সাধারণ মানুষের ধর্মীয় আবেগকেই শুধু কাজে লাগাতে চায়। ভয়াবহ খবরটি হচ্ছে- ‘জেরুজালেম অনলাইন ডট কম’ এর প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সরকারকে ‘বাংলাদেশে মুসলিম ব্রাদারহুড সরকার’ বলে অবিহিত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘বর্তমান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য কাজ করছেন ইসরায়েলের প্রভাবশালী নেতা মেন্দি এন সাফাদি। এরপর নতুন একটি সরকার আসবে যারা ইসরাইলের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে ক‚টনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলবে। সংখ্যালঘুদের নির্যাতনকারীদের বিচারের আওতায় আনতে এবং বঞ্চিত হাজার হাজার নৃতাত্তি¡ক গোষ্ঠীর বিলীন হওয়া ঠেকাতেও কাজ করছেন সাফাদি।
বাংলাদেশ ৪৫ বছর সময় ইসরায়েলকে বাদ দিয়েই বিশ্বে চলতে পেরেছে। আজ বাংলাদেশের সেসব ‘মুসলিম’ কেন ইহুদিদের সঙ্গে হাত মেলাবার জন্য এত উদ্গ্রীব হয়ে পড়লেন? এতে কি প্রমাণিত হচ্ছে না- ক্ষমতার কাছে তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ খুবই তুচ্ছ! বাংলাদেশ এখন ব্যবসা-বাণিজ্যের উর্বর ভূমি। ব্যবসায়ী ইহুদিরা সেই মাটিটুকু চাইছে। আর এদের মদত দিচ্ছে বাংলাদেশের সুবিধাবাদীরা। এদের শিকড় চিহ্নিত করা দরকার। দেশের মানুষকে তা বিশদভাবে জানানো দরকার। কারা ষড়যন্ত্র করছে, কেন করছে। সরকার এ বিষয়ে কঠোরতম না হলে যে কোনো অঘটন ঘটে যেতে পারে।
--------------------------------------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ ॥ ঢাকা ॥ শনিবার, ১৪ মে ২০১৬
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মে, ২০১৬ ভোর ৬:২৪