সাংবাদিকতার নৈতিকতা, সাংবাদিকের সময়কাল
ফকির ইলিয়াস
============================================
একটি ভয়াবহ সংবাদ দিয়ে শুরু করি। এখন বাংলাদেশে ‘ভয়াবহতম’ বলেই অনেক সংবাদকে আখ্যায়িত করা যায়। তাই কোনটা যে ‘খারাপ’ সংবাদ নয় তা পড়ার জন্যই উদগ্রীব থাকেন পাঠক সমাজ। ফেনীতে সাংবাদিকদের কোন্দলের শিকার হয়ে চাপাতির কোপ খেয়েছেন একজন সাংবাদিক। প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে, সম্প্রতি ফেনী প্রেসক্লাবে হামলা চালিয়ে প্রেসক্লাবের সভাপতি ও বাংলাভিশনের ফেনী প্রতিনিধি রফিকুল ইসলাম এবং তিন সাংবাদিককে কুপিয়ে জখম করেছে দুর্বৃত্তরা। ফেনী প্রেসক্লাবের সদস্য শেখ ফরিদ উদ্দিন মিডিয়াকে জানিয়েছেন, গত সোমবার রাত ৮টার দিকে একদল লোক প্রেসক্লাবে প্রবেশ করে সভাপতি রফিকুল ইসলামকে কুপিয়ে জখম করে। এ সময় একাত্তর টিভির ফেনী প্রতিনিধি জহিরুল হক মিলু, এশিয়ান টিভির ফেনী প্রতিনিধি জাফর সেলিম ও দৈনিক দিনকাল প্রতিনিধি মফিজুর রহমান তাদের ধারালো অস্ত্রের কোপে আহত হন। সভাপতি রফিকুল ইসলামকে গুরুতর আহত অবস্থায় ফেনী আধুনিক সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অন্যরা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। হাসপাতালে আহত রফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, সময় টিভির ফেনী ব্যুরো প্রধান বখতেয়ার ইসলাম মুন্না, মাছরাঙ্গা টিভির ফেনী প্রতিনিধি জমির বেগ, জয়লষ্কর ইউপি চেয়ারম্যান জয়নাল হাজারীর সাবেক পিএস মিলন তার ওপর হামলা করেছেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, যারা আক্রমণ করেছেন এরাও সাংবাদিক! তাহলে আসলে হচ্ছেটা কি?
বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় বিভক্তি নতুন কোনো বিষয় নয়। বিএফইউজে, ডিএফইউজে তো ভাগাভাগি হয়েছেই, এখন প্রায় প্রতিটি জেলায় সাংবাদিকদের একাধিক সংগঠন। এই ফণা এখন উপজেলা পর্যন্ত ছড়াচ্ছে। অনেকে বলবেন, ষোলো কোটি মানুষের দেশে সংগঠন তো বাড়বেই! হ্যাঁ তা বাড়ুক। কিন্তু এগুলো কি নৈতিকতা নিয়ে বেড়ে উঠছে?
আমরা জানি, সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা। সাংবাদিকরা অনেক কিছুই পারেন। প্রথম বিশ্বের দেশগুলোতে সাংবাদিকরা আগেই সংকেত দিতে পারেন, ওই দেশের রাজনীতি কোন দিকে মোড় নিচ্ছে। তা ফলেও যায়। এর অন্যতম কারণ এরা কোনোভাবেই রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট নয়। আর নয় বলেই তাদের চোখ খোলা। কান সজাগ। বাংলাদেশে এমন নৈতিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। না ওঠার অন্যতম কারণ হচ্ছে- রাজনীতিকরা সাংবাদিকদের প্রলোভন দেখিয়ে ক্রয় করে নেন। তারা নিজেদের প্রয়োজনে সাংবাদিকদের ব্যবহার করেন। বিশিষ্ট সাংবাদিক মওলানা আকরম খাঁ, জহুর হোসেন চৌধুরী, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, সিরাজুদ্দীন হোসেন প্রমুখ সাংবাদিক কিন্তু এই বাংলারই সন্তান। এরাও ছিলেন বাংলা ভাষাভাষি সাংবাদিক। দুঃখের কথা হচ্ছে, আজকের নবিস সাংবাদিকরা এদের জীবনাচার বিষয়ক বইগুলো মোটেই পড়াশোনা করেন না। বাংলাদেশে যারা সাংবাদিকতা বিষয়ে লেখালেখি করেন, তাদের লেখাগুলো নতুনরা পড়েন কি? একটু পেছন ফিরে তাকাই। মিডিয়া ব্যক্তিত্ব মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর তার একটি নিবন্ধে লিখেছেন- ‘অনেক সাংবাদিক ব্যক্তিগত গোপনীয়তা প্রসঙ্গে বলে থাকেন, ‘পাবলিক ফিগারের আবার প্রাইভেসি কি?’ এটাও একটা ভুল ধারণা। এই ধারণা নিয়েও আলোচনা করা দরকার। এ ধরনের ইস্যু নিয়ে আলোচনা প্রশিক্ষণের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হওয়া উচিত। কারণ, আজকের তরুণ সাংবাদিক একদিন সংবাদপত্র, টিভি বা বেতারে নীতিনির্ধারণী পদে যাবেন। তাকে বুঝতে হবে সাংবাদিকের নৈতিকতা কি। ধনী লোক বা বড় শিল্পপতি, বিখ্যাত ব্যক্তি, বড় তারকা কোনো বিপদে পড়লে অনেক সাংবাদিক উল্লসিত হন। তাদের সেই উল্লাস প্রতিফলিত হয় তাদের লেখায়। এটা সাংবাদিকের বিকৃত মানসিকতা। অসুস্থ মানসিকতা। এ ধরনের মানসিকতা সাংবাদিকতা পেশার জন্য উপযুক্ত নয়। সাংবাদিকের দৃষ্টি হবে বস্তুনিষ্ঠ। তথ্য, প্রমাণ দিয়ে তিনি লিখবেন। উভয় পক্ষের বক্তব্য প্রকাশ করা তাঁর প্রধান শর্ত।’ (ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও সাংবাদিকের নৈতিকতা, মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর, দৈনিক প্রথম আলো, তারিখ : ১৬-০১-২০১১)
বাংলাদেশে এখন অনেক অনলাইন মিডিয়ার ছড়াছড়ি। প্রায় প্রতিটি থানায় কয়েকটি ওয়েব ডেইলি। এতে সাংবাদিকদের সংখ্যা বাড়ছে প্রত্যন্ত এলাকায়। এসব সাংবাদিকের অনেকে টাকাকড়ি কামানোর ধান্ধাও করছেন। ফলে এরা পথভ্রষ্ট হচ্ছেন। ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে চাইছেন। আমরা দেখছি, বিশেষ করে অনলাইন মিডিয়াগুলোর কোনোটি ‘গসিপ’ নিউজের বন্যা বইয়ে দেয় মাঝে মাঝে। ‘ভেঙে গেল অমুকের সংসার’, ‘লাশ হয়ে ফিরলেন অমুক’, ‘যে দৃশ্য না দেখলেই নয়’- এরকম অনেক সংবাদ লিখে শেষে জানাচ্ছে, এটা একটি নাটকের, ছায়াছবির দৃশ্য! এটা কি ধরনের রিপোর্টিং? সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা হলো ব্লু্যাকমেইলিংয়ের। চাঁদা না দিলে রিপোর্ট করা হবে- এমন হুমকি দিতে গিয়ে প্রাণও গেছে কারো কারো! তারপরও গ্রামে গ্রামান্তরে গড়ে উঠছে এক ধরনের ‘সাংবাদিক’। ফেসবুকে, অনলাইন মিডিয়ায় এদের কারো কারো ভিজিটিং কার্ড দেখলে আঁতকে উঠতে হয়। অনেক পদবি তাদের। নিজে নামের সঙ্গে টাইটেল দিয়ে কার্ডের প্রচার করাটা কোন নৈতিকতার আওতায় পড়ে? বিশ্বের কোথাও এমনটি আছে কি?
মোটরসাইকেল, গাড়ির পেছনে ‘সাংবাদিক’ লিখে পার পেয়ে যাচ্ছে চোরাকারবারি, খুনিও। নির্বিকার সরকারি আইন প্রয়োগকারী বাহিনী। এর সবই হচ্ছে বাংলাদেশে। সাংবাদিকতা করার আগে এর বেসিক বিষয়গুলো জানা দরকার। বিশ্বব্যাপী অনেক সংগঠন আছে যারা এসব প্রশিক্ষণ দেয়। প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআইবি) প্রশিক্ষণ নিয়েছেন কজন গ্রামীণ সাংবাদিক? এদের অনেকে হয়তো পিআইবির নামও জানেন না। একটা উদাহরণ দিতে পারি। ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর জর্নালিস্টস (আইসিএফজে), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলকাতা ক‚টনৈতিক মিশন ও যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের সহায়তায় ২০১৬ সালের বসন্তে ‘বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস’-এর কর্মসূচির অংশ হিসেবে একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালা পরিচালনা করবে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় তারা ভারতের পূর্বাঞ্চলের স্থানীয় সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। মধ্যম সারির অভিজ্ঞ সাংবাদিক যারা কলকাতা (পশ্চিমবঙ্গ) ও পাটনা (বিহার) থেকে ইংরেজি অথবা স্থানীয় যে কোনো ভাষার সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে জড়িত এবং সাংবাদিকতার শিক্ষার্থীদের এই শহরে দুই দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ কর্মশালায় যোগদানের জন্য আবেদন করতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সাংবাদিকতার মান, নীতি- নৈতিকতা এবং নাগরিক সাংবাদিকতার বিষয়ে কর্মশালায় প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। প্রশিক্ষণ কর্মশালায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একদল অভিজ্ঞ প্রশিক্ষক সব মিলিয়ে ১২০ জন সাংবাদিককে সংবাদ সংগ্রহ ও প্রচারের ক্ষেত্রে প্রযুক্তি-নির্ভর সরঞ্জামের ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা দেবেন, একই সঙ্গে জনস্বার্থবিষয়ক প্রতিবেদনের মান উন্নতকরণ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেবেন।
প্রশিক্ষণ কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীদের নিজ নিজ কমিউনিটির স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোকপাত করতে বলা হবে, যে বিষয়ে তারা আরো কার্যকরভাবে প্রতিবেদন তৈরি করতে আগ্রহী। কমিউনিটির স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়কে উদাহরণ হিসেবে নিয়ে প্রশিক্ষণ শেষের পরেও যেন ওইসব বিষয়ের ওপর প্রতিবেদন তৈরি করেন, সে ব্যাপারে অংশগ্রহণকারীদের আগ্রহ সৃষ্টি করা হবে। প্রশিক্ষণ কর্মশালায় প্রশিক্ষকদের সহায়তা নিয়ে সাংবাদিকরা এমন প্রতিবেদন তৈরির পরিকল্পনা হাতে নেবেন যার মাধ্যমে ডিজিটাল ও নাগরিক সাংবাদিকতার চর্চা একীভূত হবে। প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণকারীরা একে অন্যের এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশিক্ষকদের সঙ্গে ইমেইল এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যোগাযোগ করে পরামর্শ নেবেন এবং তাদের পরিকল্পিত নিজ নিজ প্রতিবেদন প্রস্তুত করবেন। যৌথভাবে এসব কাজ বাংলাদেশেও করা যেতে পারে। এজন্য উদ্যমী মানুষের দরকার। দরকার সত্যের পক্ষে দাঁড়াবার শক্তি। একটি সাধারণ তথ্য দিয়ে লেখাটি শেষ করতে চাই।
‘হলুদ সাংবাদিকতা’ বিষয়ে উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে- ‘হলুদ সাংবাদিকতা বলতে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ভিত্তিহীন রোমাঞ্চকর সংবাদ পরিবেশন বা উপস্থাপনকে বোঝায়। এ ধরনের সাংবাতিকতায় ভালো মতো গবেষণা বা খোঁজ-খবর না করেই দৃষ্টিগ্রাহী ও নজরকাড়া শিরোনাম দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করা হয়। হলুদ সাংবাদিকতার মূল উদ্দেশ্য হলো সাংবাদিকতার রীতিনীতি না মেনে যেভাবেই হোক পত্রিকার কাটতি বাড়ানো। অথবা টেলিভিশন চ্যানেলের দর্শকসংখ্যা বাড়ানো। অর্থাৎ হলুদ সাংবাদিকতা মানেই ভিত্তিহীন সংবাদ পরিবেশন, দৃষ্টি আকর্ষণকারী শিরোনাম ব্যবহার করা, সাধারণ ঘটনাকে একটি সাংঘাতিক ঘটনা বলে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা, কেলেঙ্কারির খবর গুরুত্ব সহকারে প্রচার করা, অহেতুক চমক সৃষ্টি ইত্যাদি।
আমেরিকার বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও সাংবাদিক ফ্র্যাঙ্ক লুথার মট হলুদ সাংবাদিকতার পাঁচটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন- ১. সাধারণ ঘটনাকে কয়েকটি কলামজুড়ে বড় আকারের ভয়ানক একটি শিরোনাম করা। ২. ছবি আর কাল্পনিক নকশার অপরিমিত ব্যবহার। ৩. ভুয়া সাক্ষাৎকার, ভুল ধারণার জন্ম দিতে পারে এমন শিরোনাম, ভুয়া বিজ্ঞানমূলক রচনা আর তথাকথিত বিশেষজ্ঞ কর্তৃক ভুল শিক্ষামূলক রচনার ব্যবহার। ৪. সম্পূর্ণ রঙিন রবিবাসরীয় সাময়িকী প্রকাশ, যার সঙ্গে সাধারণত কমিকস সংযুক্ত করা হয়। ৫. স্রোতের বিপরীতে সাঁতরানো পরাজিত নায়কদের প্রতি নাটকীয় সহানুভূতি। বাংলাদেশে এখন সাংবাদিকদের যে হানাহানি শুরু হয়েছে- এর নেপথ্যের কারণ এগুলোই। এরা না জেনে না বুঝে ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। নিজেদের আয়নায় নিজেদের মিলিয়ে না দেখা পর্যন্ত এই হানাহানি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।
---------------------------------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ ॥ ঢাকা ॥ শনিবার, ৭ মে ২০১৬
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মে, ২০১৬ ভোর ৬:৩১