তথ্য চুরির অপরাধ ও রাজনৈতিক চালবাজি
ফকির ইলিয়াস
=======================================
লাভ রোডের কথা আপনাদের মানে আছে? সেটি ঢাকার একটি সড়ক। লাভ রোডের ‘লাভ’-এর নহর বইয়ে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। দৈনিক কাগজ করেছিলেন খুব জৌলুস নিয়ে। বিদেশি স্টাইল ফেল করেছিল তার কাছে। জিম থেকে শুরু করে মিউজিয়াম, চিড়িয়াখানা সবই থাকবে সেখানে। এমন পরিকল্পনা ছিল। খুঁটির জোর ছিল অন্য মানুষের টাকা। বেশ ডাক-হাঁক ছিল। না, তিনি কিছুই পারেন নি। পরে বিদেশে পালিয়ে গিয়েছিলেন সে যাত্রায়। অনেক সাংবাদিকের বেতন বাকি ছিল। এখনো অনেকে টাকা পাবেন- শোনা যায়। তা নিয়ে বাজারে অনেক কথা। বিলাতে তার পরিচয় ছিল- তিনি তালেয়া রেহমানের স্বামী। তার নাম শফিক রেহমান। তিনি বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় অনেক নাটকই করেছেন। তা জানেন সবাই। তার খুব খায়েশ ছিল- তিনি আওয়ামী লীগের ক্ষমতার উষ্ণতার ধারে-কাছে থাকবেন। কিন্তু পারেন নি। না পেরে পরে সরাসরি জড়িয়ে পড়েন বিএনপির রাজনীতিতে। এর পরের ধারাবাহিক ঘটনা সবার জানা। গেল সেপ্টেম্বর ২০১৫ তিনি নিউইয়র্কে এসেছিলেন নর্থ আমেরিকা বাংলাদেশ (এনএবিসি) কনভেনশনে। সেখানে একটি সেমিনারে অনেক বিতর্কিত কথাবার্তা বলেছিলেন তিনি। তিনি বলেছিলেন, আমি বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের বলে দিয়েছি, ডোন্ট টাচ মি! নিউইয়র্কে নর্থ আমেরিকা বাংলাদেশ সম্মেলনে একটি সেমিনারে যোগ দিয়ে কি নোট স্পিকার হিসেবে তার বক্তব্যে প্রচ্ছন্নভাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘মৃত্যুসংবাদ’ পাওয়ার আকাক্সক্ষা প্রকাশ করে তোপের মুখে পড়েছিলেন বাংলাদেশের আলোচিত সাংবাদিক ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা শফিক রেহমান।
৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ দুপুরে ম্যানহাটানের পেন প্লাজা প্যাভিলিয়নে নর্থ আমেরিকা বাংলাদেশ সম্মেলনের- ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্রায়নে গণমাধ্যমের ভূমিকা : চ্যালেঞ্জ ও করণীয়।’ শীর্ষক কি নোট স্পিকার ছিলেন শফিক রেহমান। তার সঙ্গে প্যানালিস্ট ছিলেন সাপ্তাহিক বর্ণমালা সম্পাদক মাহফুজুর রহমান, সাংবাদিক মনোয়ারুল ইসলাম, একুশে টিভি ইউএসএ’র ইমরান আনসারী ও আমেরিকান চ্যানেল এবিসির ফ্লোরিডার সাংবাদিক অনিভা জামান।
তার বক্তব্যে শফিক রেহমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং বর্তমান সরকারের সমালোচনা করার এক পর্যায়ে একটি রাশিয়ান জোকস যুক্ত করে বলেন, একজন পাঠক প্রতিদিন একটি দৈনিক পত্রিকা কিনে প্রথম পাতা দেখেই তা ফেলে দেন। একদিন পত্রিকার হকার সেই ব্যক্তির কাছে এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি একটি মৃত্যুসংবাদের অপেক্ষায় আছি- তার কথা শুনে হকার বলল মৃত্যু সংবাদ তো সচরাচর ভেতরের পাতায় তাকে। লোকটি তখন বলল, ‘না, আমি এমন একজনের মুত্যু সংবাদের অপেক্ষায় আছি যার মৃত্যু সংবাদ প্রথম পাতায় থাকবে।’ শফিক রেহমান যখন এই বক্তব্য প্রদান করছিলেন ঠিক তখনই দর্শক- শ্রোতাদের অনেকেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। পরে প্যানেলিস্ট সাংবাদিক মনোয়ারুল ইসলামকে প্রথম বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানালে তিনি শফিক রেহমানের এই বক্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করে বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশে এমন কোনো মৃত্যু সংবাদ পেতে চাই না যা পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বা ১৯৮১ সালের ৩০ মে’র ঘটনার পুনরাবৃত্তি করে।
মনোয়ারুল ইসলামের পর সাপ্তাহিক বর্ণমালা সম্পাদক মাহফুজুর রহমানও শফিক রেহমানের বক্তব্যের সমালোচনা করেন। শফিক রেহমানের ‘খণ্ড খণ্ড সত্য’ নিয়ে উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধের কঠোর সমালোচনা করে মাহফুজুর রহমান বলেন, ১৯৯১ সালে জাতীয প্রেসক্লাবে পুলিশের বর্বরোচিত হামলার ঘটনার মধ্য দিয়ে দেশের সাংবাদিকদের ওপর যে ন্যক্করজনক ঘটনার জন্ম দেয়া হয়েছিল তাই শেষ পর্যন্ত সাংবাদিকদের মধ্যে স্থায়ী বিভেদ তৈরি করে দেয়। শফিক রহমান তার ৩০ মিনিটের বক্তব্যে বর্তমান সরকারের সমালোচনামুখর ছিলেন নেতিবাচকভাবে। তিনি বলেন, আজকে দাবি করা হচ্ছে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ; এটা ডাহা মিথ্যা কথা। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হলে সমুদ্রপথে বিভিন্ন দেশ পাড়ি দিতে গিয়ে এতগুলো মানুষকে মরতে হতো না। আমি বলব বাংলাদেশের উন্নয়ন সব ভূমধ্যসাগর ও বঙ্গোপসাগরে ডুবে গেছে। বাংলাদেশে সভ্যতা, গণতন্ত্র, বাক-স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই। মধ্যম আয় নয়; সবার আগে দরকার মধ্যম সভ্য দেশ প্রতিষ্ঠা।
শফিক রেহমান বলেন, গণমাধ্যমকে সরকার যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে তা উদ্বেগজনক। এভাবে চলতে থাকলে দেশ কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়বে। জেল-জুলুম রিমান্ড কালচার দেশের গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবে না। আজকে যেভাবে বাক-স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে, তা সবার জানা। কেউ সত্য বলতে পারছে না। মুখ ফুটে কিছু বলার অধিকার নেই। কোনো আর্টিকেল পত্রিকায় ছাপানো হচ্ছে না। সরকারের সমালোচনা করার দায়ে জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল দিগন্ত, ইসলামিক টিভি ও চ্যানেল ওয়ান এবং আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ। আমি নিজে ‘মৃত্যুদণ্ড’ নিয়ে একটি বই লিখতে গিয়েও প্রেসের নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। তার বক্তব্যে প্রতীকী একটি কৌতুক ব্যবহার করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মৃত্যুসংবাদ কামনা করার কারণে সমালোচনার মুখে পড়েন শফিক রেহমান। সাংবাদিক মঈনুদ্দিন নাসেরের সঞ্চালনায় এই সেমিনারে সাপ্তাহিক বর্ণমালা সম্পাদক মাহফুজুর রহমান বলেন, আজকে শফিক রেহমান যেসব কথা বলেছেন তা সাম্প্রতিক সময়ের কিন্তু বিষয়বস্তু বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি আলোচনার দাবি রাখে। যদি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের কথা বলি আমরা তাহলে এর জন্য দায়ী কারা তা অকপটে বলতে হবে। ১৯৯১ এ গণতন্ত্র পাওয়ার অব্যবহিত পরেই সাংবাদিকদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তির শুরু। সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে অতীতে বিএনপির সেই আমলে। সে সময়ে জাতীয় প্রেসক্লাবে পুলিশ ঢুকে সাংবাদিক নির্যাতনসহ নানা বিষয়ই আজকের এই পরিণতি। সাংবাদিক মনোয়ারুল ইসলাম, শফিক রেহমানের বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মৃত্যু কামনার বিষয়টি নিন্দা করে দেশে আর কোনো ১৫ আগস্ট ও ৩১ মে’র মতো সরকারপ্রধানের হত্যাকাণ্ড সংঘটনের মতো কোনো ঘটনা যাতে না ঘটে তা কামনা করেন। একুশে টিভি ইউএসএ’র ইমরান আনসারী তার বক্তব্যে কি নোট স্পিকার শফিক রেহমানের সমালোচনা করে বলেন, বিএনপি সরকারের সময়ে একুশে টিভি বন্ধ করে দেয়া এবং সাম্প্রতিক সময়ে একুশে টিভির কর্ণধার আব্দুস সালামের গ্রেপ্তারের বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন শফিক রেহমান। সাংবাদিক অনিভা জামান বলেন, আমার আমেরিকাতে জন্ম। আমি একজন গণমাধ্যম কর্মী। প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের টিভিতে যেসব খুন-রক্তপাত দেখানো হচ্ছে তা দেখে বিস্মিত পুরো বিশ্ব। আমার আম্মু মাঝে মধ্যে বলেন, এসব দেখাচ্ছে কেন; ভয় লাগছে। আমি বলি দেখানো উচিত। আরো অনেক ঘটনা আছে, এসব প্রকাশ করাই হচ্ছে স্বাধীনতা। অনেক সাংবাদিক সত্য বলে খুনের শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশে। এটা ঠিক না। চুপ করে থাকা যাবে না। সত্য প্রকাশ করতে হবে। এই সেমিনারে পরে শফিক রেহমানকে উপস্থিত দর্শকরা নানা প্রশ্ন করেন। তারা জানতে চান, ২০০১-২০০৬ সময়ে দেশে যখন জঙ্গিবাদ চলছিল, বাংলাভাই-শায়খ আবদুর রহমানের রাজত্ব ছিল তখন তিনি প্রতিবাদ করেন নি কেন? এর জবাবে তিনি বলেন আমাদের সামনে এগোতে হবে- পেছনে নয়। দর্শকরা তখন ছি ছি দিতে থাকেন। এই হলো শফিক রেহমানের চরিত্রের খণ্ডচিত্র। এরকম আরো অনেক আছে। সেই শফিক রেহমান গ্রেপ্তার হওয়ার পর এখন দেখা যাচ্ছে- অনেকেই গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে শফিক রেহমানের পক্ষে কথা বলছেন। এরা মূলত যে নিজেরাই ঘাপটি মেরে বসেছিলেন- সেটাই প্রমাণিত হচ্ছে কালে কালে। একটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার- সজীব ওয়াজেদ জয় কিংবা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও মানবাধিকার পাবার দাবি রাখেন। তারা সুবিচার চাইতেই পারেন। হ্যাঁ, আমি বলতে চাইছি, বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষই সুবিচার পাক। আমেরিকার যে মামলার সূত্র ধরে শফিক রেহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে- তা খোলাশা হওয়া দরকার। তাকে সাংবাদিক হিসেবে, তার লেখালেখির জন্য এ্যারেস্ট করা হয়নি। তাই বিচার, আইনি প্রক্রিয়ায়ই চলতে দেয়া উচিত।
আমরা দেখছি, গণজাগরণের নেতা ইমরান এইচ সরকার ‘মত প্রকাশ’ ও ‘মানবাধিকারের’ নামে শফিক রেহমানের পক্ষে কথা বলার পর এখন তিনি এমন অনেকের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছেন- যারা তীব্রভাবে গণজাগরণের বিপক্ষে ছিলেন। তাহলে তাদের মতলবটি কি? সেই ‘নালায়েক ইমরান’ এখন আপনাদের ‘হিরো’ হয়ে গেলেন? অতএব সমীকরণটি খুবই সোজা। তা কারও না বুঝার কথা নয়। কারও ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করা একটি বড় ধরনের আন্তর্জাতিক অপরাধ। সেই অপরাধের কারণেই নিউইয়র্কে আমেরিকান আইনে অপরাধীদের সাজা হয়েছে। এর নেপথ্যে বাংলাদেশের কে বা কারা ছিল- তা বাংলাদেশ খতিয়ে দেখার ক্ষমতা ও দাবি রাখে। এখন সেটাই হচ্ছে। এতে ডেভিড বার্গম্যান নামের ভাড়াটেরা কি বলল না বলল- তাতে বাংলাদেশের কিছুই আসে যায় না। কথাও নয়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক চালবাজি করতে গিয়ে অনেকেই নীতি পাল্টেছে। স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে মৌলবাদী-জঙ্গিবাদীদের ক্ষমতায় আনতে নানা ধরনের উপদেশ বিতরণ করেছে। এদের মুখোশ এখন খসে পড়ছে। যাদের ‘টাচ’ হবার কথা ছিল না- তারা ‘টাচড’ হচ্ছে। এটাই আইনের ধারাবাহিকতা। আমরা সব অপরাধের বিচার চাই। সব অপরাধীদের বিচার চাই। তার অর্থ এই নয়- একটি অপরাধকে অন্যটির সঙ্গে তুলনা করে মানুষের চোখে ধুলো দেবার চেষ্টা করা হবে। সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী পুরো চক্রের তালিকা প্রকাশ করা হোক। যারা বাংলাদেশে আরেকটি ১৫ আগস্টের পাঁয়তারা করে- তাদের চিহ্নিত করা হোক। আবারো বলি, ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করে খুন, ছিনতাই, কিডন্যাপ, রাহাজানি অনেক কিছুই করা যায়। তাই এই বিষয়টিকে আইনিভাবেই মোকাবেলা করা হোক বাংলাদেশে, দরকার হলে বিদেশি তথ্য-উপাত্ত আরো সংগ্রহ করে হলেও।
--------------------------------------------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ ॥ ঢাকা ॥ শনিবার, ২৩ এপ্রিল ২০১৬