গোত্রগত সংঘাতের উৎসের সন্ধানে
ফকির ইলিয়াস
========================================
শিয়া-সুন্নি ইস্যুতে আবারও কেঁপে উঠছে মধ্যপ্রাচ্য। ইরাকে যে সহিংসতা চলছে, সেটার মূল কারণই ছিল গোত্রগত সংঘাত। আলজিরিয়া, লেবানন, আফগানিস্তানে এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আজ গোটা বিশ্বের জন্য আতংকের বিষয়। এর উপর ভর করেই আজ বিভিন্ন দেশে জঙ্গি গ্রুপগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। সৌদি আরবে একজন শিয়া নেতা নিমর আল নিমরসহ ৪৭ জনের শিরশ্ছেদ করা হয়েছে। নিমরের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি পূর্বাঞ্চলীয় শিয়া অধ্যুষিত প্রদেশে ২০১১ সালে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সৌদি আরব বলেছে, জঙ্গিদের সমর্থন দিচ্ছে এমন সমালোচনা উঠে আসায় জঙ্গিদের শিরশ্ছেদ কার্যকর করা হয়। তা নিয়ে বিশ্ব আবার সমালোচনামুখর হয়ে উঠেছে। প্রতিক্রিয়ায় সৌদিবিরোধী ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে মধ্যপ্রাচ্যের শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে। বিক্ষুব্ধ যুবকরা ইরানের রাজধানী তেহরান ও দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মাশহাদে অবস্থিত সৌদি কনস্যুলেট অফিসে আগুন দিয়েছে। ইরান সৌদি রাষ্ট্রদূতকে তলব করে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। সৌদি সরকারও রিয়াদে ইরানি রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে। আমাদের মনে আছে, বিক্ষোভের ঘটনায় ১৯৮০ সালে এক দিনে ৬৩ জনের মৃত্যুদ- কার্যকর করেছিল সৌদি আরব।
নিমর আল নিমরসহ অন্যদের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সৌদি আরব মূলত একটি ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার আগুন জ্বালাতে চাইছে। সৌদি আরবের সুন্নি মুসলমানরা শিয়াদের বিভিন্নভাবেই চাপের মুখে রেখেছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। নিজের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে তিনি নিমরকে ‘শহীদ’ আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, এ জন্য সৌদি আরবকে ‘খোদার প্রতিশোধ’ ভোগ করতে হবে। খামেনি বলেন, ‘নিমর লোকজনকে অস্ত্র হাতে নেয়ার আমন্ত্রণ জানাননি এবং কোনো ষড়যন্ত্রেও জড়িত ছিলেন না। একটি কাজই তিনি করেছিলেন, আর সেটা হলো প্রকাশ্যে সমালোচনা।’ পরে ইরানের রাষ্ট্রীয় টিভিকে খামেনি বলেন, ‘সৌদি কর্তৃপক্ষ এই মৃত্যুদ- কার্যকর করার মধ্য দিয়ে অন্যায়ভাবে একজনের রক্ত ঝরিয়েছে। নিঃসন্দেহে শিগগিরই এ শহীদের রক্তের প্রভাব দেখা যাবে এবং খোদার প্রতিশোধের হাত থেকে সৌদি আরবের রাজনীতিবিদরা রক্ষা পাবেন না।’
খোদার প্রতিশোধ যাই হোক, সৌদি আরবকে যারা সেইফ গার্ড দিয়ে যাচ্ছেন তারা এমন শিরশ্ছেদ আইনের বিরুদ্ধে কি বলছেন? শিয়া নেতার মৃত্যুদ- কার্যকরের প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘ। উত্তেজনা কমাতে তৎপরতা দ্বিগুণ করার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর। দপ্তরের মুখপাত্র জন কারবি এক বিবৃতিতে সৌদি সরকারকে মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে এবং তা সুরক্ষার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। বিচারপ্রক্রিয়ায় নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার কথাও বলা হয়েছে। এছাড়া ভিন্ন মতাবলম্বীদের শান্তিপূর্ণ উপায়ে মতপ্রকাশের অনুমতি দিতে সৌদি সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন এক বিবৃতিতে বলেছেন, শিয়া নেতাসহ ৪৭ জনের মৃত্যুদ- কার্যকরের ঘটনায় সহিংস প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ায় তিনি ‘মারাত্মক আতঙ্কিত’। মহাসচিবের মুখপাত্র বলেছেন, জাতিসংঘ প্রধান সবাইকে শান্ত ও ধৈর্য ধারণ করা এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা এড়ানোর জন্য আঞ্চলিক নেতাদের কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
ইরাকের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতারা শেখ নিমরের মৃত্যুদ-কে কেন্দ্র করে সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্কছেদের দাবি জানিয়েছেন। সিরিয়ার তথ্যমন্ত্রী ওমরান আল-জোহবি বলেছেন, সৌদি আরবকে এ হত্যাকা-ের চরম মূল্য দিতে হবে। লেবাননের প্রভাবশালী সংগঠন হেজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহ এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, সৌদি সরকার গণতান্ত্রিক দাবিকে দমাতে হত্যাকাণ্ডের পথ বেছে নিয়েছে।
গত বছর হজের সময় পদপিষ্ট হয়ে সিংহভাগ ইরানি হাজির মৃত্যুর পর দু’দেশের উত্তেজনা কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছিল। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ইস্যুর পাশাপাশি চলতি সপ্তাহে শিয়া ধর্মযাজকের মৃত্যুদ-কে ঘিরে সৌদি-ইরান বিভেদ পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে দ্বিখ-িত করার হুমকি সৃষ্টি করেছে। মূলত শিয়া এবং সুন্নীদের একটি চ্যালেঞ্জ মনে করছেন সমাজ বিশ্লেষকরা।
মধ্যপ্রাচ্যে যে রাজতন্ত্র চলছে, এর প্রধান রক্ষক হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কারণ আমেরিকার সরাসরি সাহায্য ছাড়া ওই রাজা-বাদশাহদের বিরুদ্ধে সেই দেশসমূহের মানুষ যেকোনো সময়ই বিদ্রোহ করতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্র তাদের সামরিক বেস বসিয়ে রেখেছে সেই অজুহাতে। আমেরিকার ভাষ্য হচ্ছে- আমরা তোমাদের শাহী তখত সুরক্ষিত করবো। এর বদলে তোমরা আমাদের তাঁবেদার হয়েই থাকবে। এবং সেটাই হচ্ছে। কিন্তু কথা হচ্ছে- মধ্যপ্রাচ্যে আইন কি সবার জন্য সমান? না- নয়। কারণ বাইরে থেকে যারা মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে যান- তাদের সাথে ব্যবহার করা হয়, প্রভু এবং ভৃত্যের মতো। অথচ এই মধ্যপ্রাচ্যের মাটিতে দাঁড়িয়েই মহানবী (সঃ) বিদায় হজের ভাষণে বলেছিলেন- আজ থেকে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হলো। মানুষ মানুষের প্রভু নয়- মহান আল্লাহই মানুষের একমাত্র প্রভু।
আমরা দেখছি সেই সৌদি আরবেই, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ৩৪টি মুসলিম প্রধান দেশ নিয়ে একটি নতুন সামরিক জোট গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশও এই জোটে যোগ দিয়েছে। এই জোটের প্রধান লক্ষ্য কি? তা নিয়ে প্রশ্ন উড়ছে বিশ্বব্যাপী। এ বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বিবিসিকে জানিয়েছেন- ‘প্রাথমিক আলোচনায় সৌদি আরব আমাদের যে ধারণা দিয়েছে, তা হচ্ছে এটা যুদ্ধ করার সামরিক জোট নয়। এটি মূলত গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ের একটি কেন্দ্র হবে। এবং অভিজ্ঞতা বিনিময়ের ব্যাপারেও গুরুত্ব দেয়া হবে।’ তিনি আরও বলেছেন- ‘সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রী আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে জানিয়েছেন যে, তারা রিয়াদে একটি সন্ত্রাসবিরোধী কেন্দ্র করতে চান। সন্ত্রাস ও উগ্র সহিংসতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের জিরো টলারেন্স এবং যে অবস্থান রয়েছে, সেজন্য তারা বাংলাদেশকে এই উদ্যোগে রাখতে চায়। ফলে আমরা এই উদ্যোগে যোগ দিয়েছি।’ প্রতিমন্ত্রী যোগ করেছেন- ‘নতুন এই উদ্যোগে যোগ দেয়ার ক্ষেত্রে কোন শর্ত নেই। সদস্য দেশগুলো স্ব স্ব অবস্থান এবং সামর্থ্য থেকে সহযোগিতা করতে পারবে।’
এখানে কিছু বিষয় স্পষ্ট হওয়া দরকার, যে সৌদি আরব নিজেই ধর্মীয় সহিষ্ণুতায় বিশ্বাস করছে না, যারা মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না- তারা সন্ত্রাসবিরোধী জোটের কি নেতৃত্ব দেবে? আজকের বিশ্বের অন্যতম আতংক হচ্ছে শিয়া-সুন্নীদের দাঙ্গা। মধ্যপ্রাচ্য ছাড়িয়ে তা বাংলাদেশেও গিয়ে পৌঁছেছে। এটা ভয়ঙ্কর সংবাদ। বিশ্বের মানুষ নিজ নিজ ধর্ম মেনে জীবনযাপন করবে- এটা সকল ধর্মেই বলেছে। তারপরও এই আক্রমণ করা হচ্ছে কেন? যে সৌদি আরব এত বড় গলা দেখাচ্ছে, তারা কি শক্ত হাতে নির্যাতিত ফিলিস্তিনিদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে কখনও? না- দাঁড়ায়নি। বিশ্বে রাজতান্ত্রিক আগ্রাসনের অবসান দরকার। মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হওয়া দরকার। শুধু মুখেই নয়- কাজে সেটা প্রমাণ করতে হবে বিশ্বের শান্তিকামী রাজনীতিবিদদের। তা না করতে পারলে এভাবেই মানুষের ক্ষোভ জ্বলতেই থাকবে আগ্নেয়গিরির মতো।
সৌদি রাজতন্ত্রের অপশক্তির বিরুদ্ধে কথা বলার লোক মধ্যপ্রাচ্যে কম। এই সুযোগ নিয়েই তারা যা ইচ্ছে তা করে বেড়াচ্ছে। অন্যতম মদদ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। অনেক মিডিয়ার মতে- সৌদি আরব সিরিয়াতে হামলা চালাতে যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থ সাহায্য দেয়। ইয়েমেনে ড্রোন হামলা চালাতে মার্কিন বাহিনীদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করে সৌদি আরব। বিষয়গুলো নিয়ে আজ বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে ভাবতে হবে। কারণ গোত্রগত সংঘাত গৃহযুদ্ধকে উসকে দেয়। যার পরিণাম হয় দীর্ঘমেয়াদি রক্তক্ষরণ।
---------------------------------------------------------------------------------------------
দৈনিক আজকের পত্রিকা ॥ ঢাকা ॥ ১৬ জানুয়ারি, ২০১৬ শনিবার
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জানুয়ারি, ২০১৬ সকাল ১১:১৮