ফকির ইলিয়াস
=====================================
তিনি কবি। বাঙালীর কবি। বাংলাভাষার কবি। দাঁড়িয়েছেন
এই দেশের মানুষের পক্ষে। অধিকাংশ কবিতায় আবেগের তুণ নিক্ষেপ করে কবিতাকে বাঙালি পাঠকের বোধিসত্তায় পৌঁছে দেবার নিবিড় দায়িত্ব পালন করেছেন; তাই তিনি আমাদের প্রধান কবি।
‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতাটি এতবার এত জায়গায় আবৃত্তি করা হয়েছে যে, তা শুনে কেউ কেউ এরকম ভাবতেই পারেন, ওটাই তার সেরা কবিতাসমূহের অন্যতম।
না , তা নয়। তার '' আসাদের শার্ট '', '' সফেদ পান্জাবী '',
'' গেরিলা'' এমন অনেক কবিতা ধারণ করেছে সমগ্র বাংলাদেশকে।
মধ্যবিত্ত সমাজের মাঝারি শিক্ষিত লোকরাও যেভাবে তার কবিতার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে এবং বোঝা না-বোঝার ঘোর আর অনুভূতির ভেতর দিয়ে শেষ করেছে তার কাব্যপাঠ, তাতে বলা চলে, এ দেশের শহরবাসী বাঙালি মধ্যবিত্তকে আধুনিক কবিতা পড়তে শিখিয়েছেন শামসুর রাহমান।
দুই
তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে আমাদের স্বাধীকার , গণতন্ত্র,
খেটে খাওয়া স্বপ্নবাজ মানুষের কথা ।পচাত্তর পরবর্তীকালে দেখেছেন তিনি উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ। দেখেছেন রাজাকারের উত্থান। তাই হৃদয় খুলে, পিছুটান না রেখে, কারো বিরাগ-অনুরাগের তোয়াক্কা না করে, দ্রোহের অগ্নিবাণী উদ্গীরণ করে বলেছেন,
‘হে-দ্বীন ও দুনিয়ার মালিক, চোখের পলকে, হে সর্বশক্তিমান, আপনি আমাকে এমন তৌফিক দিন যাতে আমি আপাদমস্তক মনে প্রাণে একজন খাস রাজাকার হয়ে যেতে পারি রাতারাতি।’
আবারো বলেছেন,
‘হে পাক পারওয়ারদিগার, হে বিশ্ব পালক,
আপনি আমাকে লহমায় একজন তুখোড় রাজাকার ক’রে দিন।’
(একটি মোনাজাতের খসড়া)।
তিন
শামসুর রাহমান হতে পারতেন আমাদের পোয়েট লরিয়েট।
রাষ্ট্র তাঁকে সেই স্বীকৃতি দেয়নি।
কিন্তু কোন প্রয়োজনে তিনি কবিতা লিখেননি বাঙালি জাতির
জন্য ?স্বাধীনতার কবি, ভাষা-আন্দোলনের কবি, মুক্তিযুদ্ধের কবি, মানব সম্প্রীতির কবি, গণতন্ত্রের কবি, মৌলবাদের বিরুদ্ধে কবি, নানা অভিধায় তাঁকে অভিষিক্ত করা যায়। জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয়ের প্রতিটি স্তরসমূহে তার কবিতার বিশ্বস্ততার সঙ্গে আমাদের অনুচর হয়েছে। 'প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে ', 'বন্দী শিবির থেকে' , 'নিজ বাসভূমে ' 'আমি অনাহারী', ' উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ' , ' 'বুক তার বাংলাদেশের হৃদয় '
প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের তার কবিতার কালিক বোধ ও বিবর্তন সমাজ বদলের সমান্তরালে প্রবাহিত হয়ে তার কবিতাকে বাংলাদেশের কাব্যিক ইতিহাসের মর্যাদা দিয়েছে।
কী এক প্রাণের স্পন্দন তিনি দিয়ে গেছেন তাঁর পাঠকদের।
গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের
জলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট
উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়।
বোন তার ভায়ের অম্লান শার্টে দিয়েছে লাগিয়ে
নক্ষত্রের মতো কিছু বোতাম কখনো
হৃদয়ের সোনালি তন্তুর সুক্ষ্মতায়
বর্ষীয়সী জননী সে-শার্ট
উঠোনের রৌদ্রে দিয়েছেন মেলে কতদিন স্নেহের বিন্যাসে।
ডালিম গাছের মৃদু ছায়া আর রোদ্দুর-শোভিত
মায়ের উঠোন ছেড়ে এখন সে-শার্ট
শহরের প্রধান সড়কে
কারখানার চিমনি-চুড়োয়
গমগমে এভেন্যুর আনাচে কানাচে
উড়ছে, উড়ছে অবিরাম
আমাদের হৃদয়ের রৌদ্র-ঝলসিত প্রতিধ্বনিময় মাঠে,
চৈতন্যের প্রতিটি মোর্চায়।
আমাদের দূর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা ।
[ আসাদের শার্ট ]
চার
তিনি জীবনকে দেখেছেন খুব ঘনিষ্টভাবে । তার কবিতায়
আমাদের সম্মিলিত দীর্ঘশ্বাস ধরা পড়েছে মাটি আর মৃত্যুর
ভালোবাসায় ।
একটি পাখী রোজ আমার জানালায়
আস্তে এসে বসে, তাকায় আশেপাশে।
কখনো দেয় শিস, বাড়ায় গলা তার;
আবার কখনোবা পাখাটা ঝাপটায়।
পালকে তার আঁকা কিসের ছবি যেন,
দু’চোখে আছে জমা মেঘের স্মৃতি কিছু;
নদীর স্বপ্নের জলজ কণাগুলি
এখনো তাঁর ঠোটে হয়তো গচ্ছিত।
কাউকে নীড়ে তার এসেছে ফেলে বুঝি?
হয়তো সেই নীড়, আকাশই আস্তানা।
তাই তো চোখ তার এমন গাঢ় নীল,
মেললে পাখা জাগে নীলের উৎসব।
যখন লিখি আমি টেবিলে ঝুঁকে আর
পড়তে বসি বই, তখন সেই পাখি
চকিতে দোল খায় আমার জানালায়-
খাতার পাতা জুড়ে ছড়িয়ে দেয় খুশি।
আমার মৃত্যুর পরেও যদি সেই
সুনীল পাখি আসে আমার জানালায়,
আবার শিস দেয়, আমার বইখাতা
যদি সে ঠোকরায়, দিও না বাধা তাকে।
[ আমার মৃত্যুর পরেও যদি ]
পাঁচ
তাঁর সাথে আমার ব্যক্তিগত স্মৃতি অনেক।বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকা কবিকে সংবর্ধনা দেবে, সে কথা আমাকে জানালেন লীগ অব আমেরিকার সভাপতি সাইদ-উর-রব। বললেন, আড্ডা হবে সাহিত্য বিষয়ে। ভীষণ আগ্রহী হয়ে গেলাম সে সন্ধ্যায়। ১৯৯০-এর গ্রীষ্মের চমৎকার বিকাল। আমেরিকান সামারের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। তার ওপর আবার নিউইয়র্ক শহরে। বলা হয় বিশ্বের রাজধানী নিউইয়র্ক। বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবিকে পেয়ে নিউইয়র্ক যেন আরও মেতেছিল আনন্দে সেদিন।
লং আইল্যান্ড সিটির স্কাইলান রেস্টুরেন্ট মিলনায়তনটি মুখরিত হয়ে উঠেছিল বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকে আসা কবির শুভানুধ্যায়ীদের পদচারণায়। কবি এলেন। বাংলা কবিতার জীবন্ত কিংবদন্তি শামসুর রাহমানকে তরুণ প্রজন্মের শিশু-কিশোর-কিশোরীরা পুষ্প পাপড়ি ছিটিয়ে বরণ করে নিল। তার সম্মানে বক্তব্য রাখবেন প্রবাসের বিশিষ্টজনরা। বিনয়ী মানুষ শামসুর রাহমান খুব সংক্ষিপ্ত বক্তব্যই রাখলেন। বললেন, এই উত্তর আমেরিকায় বাঙালি প্রজন্ম যে বাংলা ভাষা বাংলা কবিতার পঙ্ক্তি বুকে লালন করে বেড়ে উঠছে তা আমাকে আনন্দ দিচ্ছে। আমি নতুন সূর্যরেখা দেখতে পাচ্ছি এই প্রবাস প্রজন্মের চোখেমুখে।
সংবর্ধনা সভা শেষ হলে আমরা ক’জন আড্ডায় বসলাম কবির সঙ্গে। জিজ্ঞাসা করলাম সমসাময়িক বিশ্ব কবিতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলা কবিতার উৎকর্ষতা কতটা সাধিত হচ্ছে? মুচকি হেসে কবি বললেন তা তো আপনারাই ভালো বলতে পারবেন যারা অভিবাসে আছেন। আমি বিনয়ের সঙ্গে বললাম, প্লিজ আপনি বলুন। কবি আবারও হেসে বললেন, বাংলা কবিতা অবশ্যই নিজস্ব শস্য ভাণ্ডারে সমৃদ্ধ পঙ্ক্তিমালা। কবি বললেন, আমাদের কবিতার যদি ব্যাপক এবং পরিশুদ্ধ অনুবাদ হতো তবে তা বিশ্ব কবিতা ভুবনে আরও বেশি আলোচিত, সমাদৃত হতো।
কবি গ্লুকোমা রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর ১৯৯৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী কবির সুহৃদরা তাকে চিকিৎসার জন্য নিউইয়র্কে নিয়ে আসেন। আবারও গ্রীষ্মকাল। আগস্টের দুপুর। এক বিকেলে আমরা বেরিয়ে পড়ি কবিকে নিয়ে ক’জন। হাডসন নদীর তীরে যেতেই কবি বললেন, সূর্যাস্ত দেখব। আমরা তার সঙ্গে সূর্যাস্ত দেখতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ভর চোখে কবি তাকিয়ে রইলেন আকাশের দিকে। সূর্যটা যেন যুবে গেল আটলান্টিক মহাসাগরে তার চোখের ওপর দিয়ে। কবি আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, এখন বাংলাদেশে ভোর হচ্ছে তাই না? আমি হ্যাঁ বললেই তিনি বললেন, আমি একদিন সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় থাকি। মনে পড়ছে হাডসনের তীরে বসেই পেস্তা-বাদাম চিবুতে চিবুতে ‘গেরিলা’ এবং ‘সফেদ পাঞ্জাবী’ কবিতা দুটি পড়েছিলেন কবি শামসুর রাহমান।
তার, প্রবাসীদের এক ভালবাসা ছিল অসীম। বলতেন, আপনারা প্রবাসীরা বিদেশে বাংলার মুখ। ম্যানহাটনে ড. জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের বাসায় সাহিত্য আড্ডা হয়েছিল। সে আড্ডযায় সলিমুলাহ খান কবিকে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করেছিলেন বারবার। তার ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতার সঙ্গে একজন ফ্রান্স কবির ‘দ্য লিবার্টি’ কবিতার মিল খুঁজে তুলনামূলক আলোচনাও করেছিলেন ড. সলিমল্লাহ খান। কবি শুধু বলেছিলেন, আমি এই ফরাসি কবির কটিতাটি কখনও পড়িইনি।
শামসুর রাহমান ছিলেন মহান মৃত্তিকার মতো। মাটি কোদাল দিয়ে কোপালে কোনও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া জানা-বোঝা যায় না। শামসুর রাহমান তেমনি শুধু দিয়েই গেছেন। চাননি কিছুই। তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়া হয়নি। তাতে কী? লাখ মানুষ তাকে শেষ প্রণাম-ভালবাসা জানিয়েছে। ষড়ঋতু যতদিন থাকবে, বাংলা ভাষা, বাংলা অক্ষর যতদিন থাকবে ততদিনই বেঁচে থাকবেন শামসুর রাহমান প্রাণে প্রাণে। তার আত্মা অবিনাশী। তার চেতনা কালে কালে বহমান থেকে যাবে সমুদ্রের মতো। তাঁর এই কবিতাটি আমার খুবই প্রিয়।
কবিকে দিও না দু:খ দিলে সে-ও জলে স্থলে হাওয়ায় হাওয়ায়
নীলিমায় গেঁথে দেবা দু:খের অক্ষর। কবি তার নি:সঙ্গতা
কাফনের মতো মুড়ে রাখে আপাদমস্তক, হাঁটে
ফুটপাতে একা,
দালানের চূড়ায় চূড়ায়, দিগন্তের অন্তরালে
কেমন বেড়ায় ভেসে, চাঁদের নিকট যায়, নক্ষত্র ছিটোয় য্ত্রতত্র
খোলামকুচির মতো। তাকে দু:খ দিও না, চৌকঠ থেকে দূরে
দিও না ফিরিয়ে।
ফেরালে নক্ষত্র, চাঁদ করবে ভীষণ হরতাল, ছায়াপথ তেজস্ক্রিয়
শপথে পড়বে ঝরে, নিমেষেই সব ফুল হবে নিরুদ্দেশ।
প্রায়শ পথের ধারে ল্যাম্পোস্টে হেলান দিয়ে খুব
প্রচ্ছন্ন দাঁড়িয়ে থাকে, কখনো বা সীমাহীন রিক্ততায়
রেস্তোঁরায় বসে
বান্ধববিহীন বিষাদের মুখোমুখি
নিজেই বিষাদ হ’য়ে। মাঝে মধ্যে চৌরাস্তা খুঁড়ে তোলে এক
গোপন ফোয়ারা পিপাসার্ত পথিকের আঁজলা ভরবে ব’লে।
আবার কখনো তার মগজের উপবনে লুকোচুরি খেলে
খুনী ও পুলিশ!
মধ্যরাতে শহরের প্রতিটি বাড়ির দরজায় কিছু ফুল
রেখে আসে নিরিবিলি কাউকে কিছু না ব’লে। কবি সম্মেলনে
রাজধানী আর মফস্বলে স্টেজে কয়েক ডজন
পঙক্তির জোৎস্নায় রৌদ্রে পুনরায় স্নান সেরে স্বকীয় গোপন ঘুলঘুলিটার
দিকে চোখ রেখে নীলিমার সঙ্গে বাণিজ্যের কথা ভাবে, ভাবে
সুদূর অনন্ত তাকে চোখ টিপে বেঘোরে ঘোরাবে কতো আর?
কবি সম্মেলনে তেজী যুবরাজ, প্রেমের নিকট বাস্তবিক
বড়ো নগ্ন, বড়ো অসহায়!
কবিকে দিওনা দু:খ, স্বপ্নের আড়ালে তাকে তীব্র
আবৃত্তি করতে দাও পাথর, পাখির বুক, গাছ,
রমণীয় চোখ,
ত্বক, হেঁটে যেতে দাও ছায়াচ্ছন্ন পথে, দাও সাঁতার কাটতে বায়ুস্তরে একা,
অথবা থাকতে দাও ভিড়ে নিজের ভেতরে। রোজ
হোক সে রূপান্তরিত বার বার। নিজস্ব জীবন রেখেছে সে
গচ্ছিত সবার কাছে নানান ধরনে অকপট।
কবিকে দিও না দু:খ, একান্ত আপন দু:খ তাঁকে
খুঁজে নিতে দাও।
[কবিকে দিও না দুঃখ ]
কবিতাটি বার বার পড়ি। আর তাকিয়ে থাকি আকাশের দিকে তাঁর নাম ধরে। #