যে বিজ্ঞান এখন পর্যন্ত অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করেছে, করেছে অনেক রহস্যের সমাধান সেই বিজ্ঞানের একটি অংশ যা আমাদের শরীরের রহস্য নিয়ে কাজ করে তা হলো চিকিৎসা বিজ্ঞান। যার চিহ্ন হলো লাঠির সাথে পেচানো দুটি সাপ(মতান্তরে জলপাই গাছের গুড়ি পেচিয়ে থাকা দুটি নির্বিষ সাপ)। এই চিহ্নের পেছনেও আছে অনেক মজার একটা গল্প যা অনেকটা
আমাদের ছোটবেলায় শোনা রূপকথার গল্পের মতই।
এই গল্পের নায়ক এসক্লেপিয়াস যাকে গ্রিক উপকথাতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের বা চিকিৎসার দেবতা ধরা হয়।সে ছিল দেবতা এপোলো আর মানব রাজকুমারী করোনিস এর সন্তান। তবে তার যে পরিচয়টা বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হলো সে পৃথিবীর প্রথম পেট কেটে বের করা বাচ্চা অর্থাৎ সিজারিয়ান বেবী। গ্রিক পুরাণ অনুসারে এসক্লেপিয়াস যখন করোনিস এর গর্ভে তখন রাজকুমারী এই পৃথিবীর এবং নিজের রাজ্যেরই একজনের প্রেমে পরে। দেবতা এপোলো এই কথা জানতে পেরে রাজকুমারীকে আগুনে পুড়িয়ে মারে। রাজকুমারীকে আগুনে ফেলে দেয়ার পর এপোলোর মাথায় চিন্তা আসে যে গর্ভের সন্তানের তো দোষ নেই তাই এপোলো তখন পুড়তে থাকা রাজকুমারীর পেট কেটে এসক্লেপিয়াসকে বের করে। এটাকে ধরা হয় পৃথিবীর প্রথম সিজারিয়ান অপারেশন। এসক্লেপিয়াস নামটা
এপোলোই রাখে যার অর্থ 'to cut open'।
এপোলো এসক্লেপিয়াসকে সেন্টর কীরন এর কাছে রেখে যায়।(সেন্টর হলো অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক ঘোরার মত দেখতে প্রাণী) কীরন এসক্লেপিয়াসকে উপযুক্ত শিক্ষার সাথে চিকিৎসার বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী করে তুলতে থাকে।কিন্তু দেবী এথেনার যে বরের কারণে এসক্লেপিয়াস চিকিৎসা করার ক্ষেত্রে কিংবদন্তি হয়ে ওঠে সে সময়ের গ্রিসে তা ছিল গর্গনের রক্ত।(গর্গন হলো সাপের মত চুলবিশিষ্ট প্রাণী যার চোখের দিকে তাকালে জীবন্ত যেকোনো কিছু পাথর হয়ে যেত। তখন বিশ্বাস করা হত যে গর্গনদের ডান পাশের রক্ত মানুষকে বাচাতে পারে আর বাম পাশের রক্ত মেরে ফেলতে পারে।)এই রক্তের তৈরী ঔষধ দিয়ে এসক্লেপিয়াস গ্রিসে ঘুরে ঘুরে সবার রোগ সারাতে থাকে আর অসম্ভবকে সম্ভব করতে থাকে।
তার সাথে থাকত একটা লাঠি আর তাতে পেচানো দুটি সাপ। এই সাপের বিশেষ অর্থ ছিল। সেই সময়ে মনে করা হত যে সাপের কামড়ই সবচেয়ে বড় রোগ। এতে মৃত্যু অনিবার্য। শুধু এসক্লেপিয়াসই পারে এটা সারাতে তার সাপ পেচানো লাঠি দিয়ে। সকল কঠিন রোগের চিকিৎসা হিসেবে ধরা হত এটাকে। এখন পর্যন্ত চিকিৎসা বিজ্ঞানের চিহ্ন এটাকে ধরা হয়।
ব্যক্তিগত জীবনে এসক্লেপিয়াস এপিওনি (ব্যথা কমানোর দেবী) কে বিয়ে করে। তাদের ৩ছেলে আর ৬মেয়ে ছিল যারা চিকিৎসা বিজ্ঞানের কোনো না কোনো অংশের সাথে জড়িত। হাইজেনিয়া(পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার দেবী), ল্যাসো(আরোগ্য লাভের দেবী), একিও(ক্ষত নিরাময়ের দেবী), এজিলেয়া(যত্নের দেবী), প্যানাসিয়া(রোগ প্রতিকারের দেবী) মেডিত্রিনা (সাপের বাহক)। তিন ছেলে ম্যাসিওন, প্যালেইরীয়স, ট্যালেসফরস যুগান্তরী চিকিৎসক হিসেবে জানা যেত।
এসক্লেপিয়াস দেবতা ছিলনা কিন্তু সে মৃত মানুষকে বাচাতে পারতো তাই সবাই তাকে দেবতার আসনে বসায়। এতে স্বর্গ আর পাতালের দেবতারা অখুশি হয় বিশেষ করে মৃত্যুপুরীর দেবতা হেডিস। সে তার ভাই স্বর্গের দেবতা জিউসকে নালিশ জানায় যে এসক্লেপিয়াস এর কারণে তার পাতালপুরীতে মৃত আত্মার সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এসক্লেপিয়াস থিসিউস এর ছেলে হিপ্পোলাইটাসকে মৃত অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনে আর তার বিনিময়ে স্বর্ণ মুদ্রা নেয়। তখন হেডিস রেগে গিয়ে জিউস এর বজ্র নির্মাণকারী সাইক্লোপস(এক চোখ বিশিষ্ট দানব) কে মেরে ফেলে। জিউস তখন ভেবে দেখে যে এসক্লেপিয়াস আসলেই ভুল করছে যে সে মৃত মানুষকে বাচাচ্ছে। এতে করে প্রকৃতির যে নিয়ম তা ভঙ্গ হচ্ছে। তাই জিউস বজ্র নিক্ষেপ করে এসক্লেপিয়াস কে মেরে ফেলে এটা দেখাতে যে মানুষ মরণশীল ই সে যেই হোক না কেন।জিউস এসক্লেপিয়াসকে মেরে ফেললেও মানুষে সেবা আর মানুষের ভালো করার পুরস্কার স্বরূপ তাকে স্বর্গে দেবতার মর্যাদা দিয়ে অফিউকাস তারা হিসেবে জায়গা দেয়। এসক্লেপিয়াস মারা যাওয়ার পর ও তার ভক্তরা মানুষের সেবা করে যেতে থাকে।এর জন্য মন্দির বানানো হয় যেগুলোকে বলা হত এসক্লেপিওন। এসব মন্দিরে রোগী আসলে বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হত। এই সময়ে রোগীকে সারারাত মন্দিরের নিরাময় কক্ষের মেঝেতে শুয়ে থাকতে হত।তার আশেপাশে ছেড়ে দেয়া হত কিছু অবিষাক্ত সাপ। এগুলোকে বলা হত এস্কালপিয়ান সাপ রোগীকে রাতে ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখাত এসক্লেপিয়াস। রোগী সকালে সেই স্বপ্নের কথা মন্দিরের পুরোহিতকে বলত। স্বপ্নের বর্ণনা অনুযায়ী পুরোহিত ঠিক করত কিভাবে চিকিৎসা দিতে হবে। এসব মন্দিরে অনেকেই চিকিৎসার জ্ঞান অর্জনের জন্য যেত। মেডিসিন এর জনক হিপক্রিটাস ও এমন এক এসক্লেপিওন
মন্দির থেকে তার শিক্ষা গ্রহণ করেন।আসল যে হিপক্রিটিক শপথ ছিল সেখানে এপোলো,এসক্লেপিয়াস এর সাথে সাথে এসক্লেপিয়াস এর মেয়েদের নামও ছিল তা পরে বাদ দেয়া হয়।এসক্লেপিয়াস এর সম্মানে উদ্ভিদ বিজ্ঞানের অনেক ঔষধি গাছের নাম তার নামেই নামকরণ করা হয়েছে।এমন কি নির্বিষ সব সাপকে এখন সারা পৃথিবীতেই এস্কালপিয়ান সাপ নামেই ডাকা হয়।
হোক গল্প বা রুপকথা, হোক উপকথা বা কল্পনা এসক্লেপিয়াস এর সেই সাপ লাঠি এখনো চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাথে জড়িতই আছে। সাপ লাঠির সেই চিহ্ন একটু খেয়াল করলেই আমরা সব হসপিটালের কোথাও না কোথাও দেখতে পাব।এখন গালি দিলে দয়া করে আমাদের গুরুকেই দিবেন।কারণ আমরা কসাইরা যে তার ই শিষ্য।
এসক্লেপিয়াস নিক দিয়ে এখানে ব্লগিং করছি তাই নামের পিছনের ইতিহাস নিয়ে লেখার এই চেষ্টা।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১২ বিকাল ৩:৩১