বর্তমানে ওপেন একসেস জার্ণাল নামে কিছু ধান্দাবাজি শুরূ হইছে [তার মানে কিন্তু সব ওপেন একসেস জার্ণাল খারাপ বা মানহীন নয়]। ২/৩ টি অভিজ্ঞতা শেয়ার করি।
(১) আমার একছাত্র বিদেশী এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে। তার পাশ করার জন্য প্রকাশনা/গবেষণাপত্র দরকার, আর হঠাত দেখল যে, দেশে একটা জার্ণাল বের হয়েছে যারা বিভিন্ন বিষয়ে লেখা ছাপে। নিজের দেশ বলে কিছু সুবিধা পাবে [সাধারণ মাত্রই এরকম ধারণা করে], এই আশায় তাদের সাথে যোগাযোগ করল। তারা যথারীতি খুব ভাব নিয়ে বলল যে, তাদের সম্পাদনা পর্ষদ রয়েছে, খুব কঠিন প্রক্রিয়ার মধ্যে লেখা বাছাই করা হয়, লেখা রিভিউ হয়, ইত্যাদি, ইত্যাদি। যাই হোক ব্যাচারা, ভয়ে ভয়ে তার পেপার দিল, অনতিবিলম্বে উত্তর পেল..."অভিনন্দন, আপনার লেখা আমাদের পরবর্তী সংখ্যায় প্রকাশিত হওয়ার জন্য মনোনীত হয়েছে। তাড়াতাড়ি ৫ হাজার ঠাকা পাঠান [বিদেশীদের জন্য রেট ২০০ ডলার]"। তার খানিকটা খটকা লাগল। সে ঐ জার্ণালকে বলল, টাকা দিব কিন্তু আমাকে রিভিউয়ারের কমেন্ট দাও। এইবার জার্ণালটি বলছে, রিভিউয়ারের কমেন্ট কিছু দিনের মধ্যেই পাবেন, আগে টাকা দেন।
(২) ইন্ডিয়ান এক জার্ণাল থেকে একটি মেইল পেলাম একদিন। বাংলাদেশের কারও একজনের লেখা আমি রিভিউ করতে রাজী আছি কিনা, সেজন্য তারা একটা পেপারের সারসংক্ষেপ পাঠালো। আমি রাজী থাকলে পুরো লেখা পাঠাবে। এর বিনিময়ে আমি পরবর্তীতে যদি কখনো তাদের জার্ণালে লেখা ছাপাই তাহলে তারা ছাপানোর খরচের উপর ১০% কমিশন দিবে। লেখা ছাপানোর খরচ ৫০০ ডলার !!! আমি কোন কিছু না বলে, নেটে একটু ঘাটাঘাটি করে দেখি প্রায় ভুয়া একটা জার্ণাল।
(৩) আমার পিএইচডি-র ২য় বছর একটা কনফারেন্সে শ্রীলংকা গেছিলাম। মানে আমার ডিপার্টমেন্ট টাকা দিলো আর আমি ও গেলাম এই আর কি । তো ভাসা ভাসা ধারণা নিয়ে লেখা একটি পেপার পড়ছিলাম। কনফারেন্স কমিটি ঐ লেখা আবার তাদের ওয়েবসাইটে আপলোড করে। হঠাত করে ইউ.এস-চায়না রিভিউ, আমেরিকা থেকে মেইল আসছে। আমার লেখা নাকি সেই রকম হইছে, ওরা লেখাটা ছাপবে আমি রাজী হইলে। তো, আমি তো খুশী, বললাম যে, রাজী। এইবার বলল, প্রতি পেইজ এর জন্য ওদের ৩০ ডলার করে দিতে হবে। আমি প্রমাদ গুনলাম, কারণ আমার পেপার ১৪/১৫ পেইজের মতো। আমি বললাম যে, টাকা নাই, আমি ছাপাবো না। ওরা এইবার বলে যে, কিছু মনে কইরো না, আসলে আমাদের সামান্য অফিস খরচ, ইত্যাদি চালানোর জন্য এই টাকাটা দরকার, কিন্তু তুমি চাইলে আমরা কমেও করতে রাজী আছি, আমি বললাম যে, টাকা নাই, এ্ইবার বলে যে, কতো হইলে পারবা [পুরা ফুটপাতের দামাদামি]। আমার ওদের এই এপ্রোচ টা ভালো লাগে নাই। তাই আমি আর কোন আগ্রহ দেখাই নাই।
বর্তমানে বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্ন কাজে [পড়াশুনা বা গবেষণা সম্পর্কিত, যেমন, ভর্তি, চাকুরী ইত্যাদি] প্রকাশিত লেখার দরকার পড়ে এবং পিয়ার-রিভিউড [সঠিক বাংলা কি হবে?] প্রকাশনা/গবেষণা দরকার হয়। আর এই সুযোগ গুলোই নিচ্ছে নামসর্বস্ব এইসব ধান্দাবাজ জার্ণালগুলো। এই সব জার্ণাল এর নামগুলো হয় খুব মনোলোভা- ধরেন, ওয়াল্ড জার্ণাল অফ অমুক, ইন্টারন্যাশনাল জার্ণাল অফ তমুক...অনেকটা অ্যামিরিকান ওয়াল্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের মতো।
বিখ্যাত নেচার জার্ণাল বলছে যে, ২০১২ ছিল এইসব ধান্দাবাজদের রমরমা অবস্থা। এইখানে গেলে যেসব জার্ণালের প্রকাশকরা সন্দেহজনক তাদের একটা তালিকা পাবেন ।
এসব প্রকাশকদের থেকে মুক্ত থাকতে নেচার কিছু টিপস দিচ্ছে এখানে ।
(ক) জার্ণালের সাথে যোগাযোগের সম্পূর্ণ ঠিকানা দেখুন। যদি কেবল অনলাইন ঠিকানা থাকে, বা কোন ফর্ম দিয়ে যোগাযোগ করতে বলে তবে তা সন্দেহযুক্ত।
(খ) সম্পাদনা পর্ষদ দেখুন, এরপর দেখুন কাউকে পরিচিত মনে হয় কিনা, পরিচিত হলে মেইল করে জার্ণালটি সম্পর্কে খোজ নিন।
(গ) দেখুন, লেখা ছাপানোর ফি স্পষ্টভাবে লিকা আছে কিনা?
(ঘ) ইতোমধ্যে প্রকাশিত লেখাগুলো দেখুন, আর দেখুন সেগুলোর মান।
(ঙ) দেখুন যে, জার্ণালটি Directory of Open Access Journals (http://www.doaj.org) বা Open Access Scholarly Publishers Association (http://www.oaspa.org) এর সদস্য কিনা । সদস্য হলে আপনার চিন্তা কম। ইত্যাদি।
পরিশেষে বলব, আমার মতে প্রথমেই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের প্রকাশিত জার্ণাল টার্গেট করা উচিত। তারপর নামকরা গবেষণা সংস্থা, প্রকাশক দেখে পা বাড়ানো হবে বুদ্ধিমানের কাজ। একটা লেখা লিখতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়, একটা লেখা কোন মতেই নিজের সন্তানের চাইতে কম নয়। তাই সন্তান জন্মদানের পর তার বেড়ে উঠা, ভবিষ্যত ইত্যাদি নিয়ে যেমন আমাদের চিন্তার ত্রুটি থাকেনা, তেমনি এক্ষেত্রেও যত্নবান হওয়া দরকার। কারণ নিজের লেখা বাজে কোথাও ছাপা হলে পরিচিতদের কাছে খুব লজ্জার কারণ হবে। আর এভাবে লেখা হয়ত ছেপে যাবে কিন্তু ঐ লেখা দিয়ে তেমন কোন লাভ হবে না।
সবার জন্য শুভকামনা।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মে, ২০১৪ রাত ১০:০৬