প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধীদের শরিয়া আইনে বিচার ও কিসাস কায়েম করা সম্পর্কে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার তীব্র সমালোচনা করেছেন বিভিন্ন ইসলামী দল ও সংগঠনের নেতারা। পৃথক প্রতিক্রিয়ায় তারা বলেন, শরিয়া আইন প্রয়োগের জন্য আগে ইসলামী সমাজব্যবস্থা কায়েম করতে হবে। কোরআন ও সুন্নাহকে সব আইনের উত্স হিসেবে উল্লেখ করে সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। কোনো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে শরিয়া আইন প্রয়োগের ঘোষণা হাস্যকরই নয়; এটা আইন নিয়ে সম্পূর্ণ উপহাসের শামিল। এর মাধ্যমে মুসলমানদের ইমানের ওপর আঘাতের পাশাপাশি তিনি গর্হিত কাজ করেছেন। কারণ যিনি সংবিধানে আল্লাহর ওপর আস্থা সহ্য করতে পারেন না, মাদরাসা শিক্ষার্থীদের ভর্তিতে শর্তসহ ইসলামবিরোধী নানা কর্মকাণ্ড করেন, তার মুখে শরিয়া আইন প্রয়োগের ঘোষণা মানায় না। এটা এক ধরনের ধোঁকাবাজি ও ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত। তবে তিনি যে উদ্দেশেই হোক, যেহেতু বিচারের ক্ষেত্রে শরিয়া আইন প্রয়োগে ঘোষণা দিয়েছেন, এজন্য তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে অবিলম্বে দেশের সব কর্মকাণ্ডে এ আইন চালুর দাবি জানান ইসলামী দলের নেতারা।
জামায়াতে ইসলামী : প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে উপহাস ও ঠাট্টা-বিদ্রূপাত্মক হিসেবে আখ্যায়িত করে এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী ইসলামী শরিয়া অনুযায়ী ‘কিসাস’ প্রয়োগ করার বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য করে সারাবিশ্বের মুসলমানের ইমানের ওপর আঘাত দিয়েছেন। এ ধরনের মন্তব্য করার এখতিয়ার কোনো মানুষের নেই। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত ইসলামী শরিয়াতের বিধান ‘কিসাস’ নিয়ে উপহাসমূলক বক্তব্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী গর্হিত কাজ করেছেন। শতকরা ৯০ জন মুসলমানের দেশের প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে জাতি এ ধরনের অন্যায়, অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেত বক্তব্য আশা করে না।
এক বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, সবাই জানেন যে, ইসলামী শরিয়া অনুযায়ী বিচার-ফয়সালা কোনো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে চলে না। শরিয়া প্রয়োগ করতে হলে আগে ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এর পরে কোরআন ও সুন্নাহকে দেশের আইনের উত্স ঘোষণা করে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। তার পরেই কেবল ইসলামী শরিয়া মোতাবেক কিসাস চলতে পারে। কিন্তু এসব না করে প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের উপহাসমূলক বক্তব্য কীভাবে দিতে পারলেন? তার এ বেআইনি ও অন্যায় বক্তব্যে দেশবাসী, বিশেষ করে দেশের আলেম সমাজ শঙ্কিত, বিস্মিত, মর্মাহত ও বিক্ষুব্ধ। এ বক্তব্য দিয়ে দেশের ধর্মপ্রাণ জনগণের ইমান-আকিদার ওপর আঘাত দিয়েছেন। এ ধরনের বক্তব্য প্রদান করা থেকে বিরত থাকার জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানান।
ইসলামী ঐক্যজোট : ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মুফতি ফজলুল হক আমিনী এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, শরিয়া আইন তো ভালো, তবে শুধু বিচারে কেন, দেশের সব ক্ষেত্রে এ আইন চালু করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী যদি নিজের মতলবের জন্য এ আইন চালু করতে চান, তাহলে এটা ধোঁকাবাজি ও শরিয়া আইনের সঙ্গে ঠাট্টা করার শামিল। তিনি বলেন, যারা শরিয়া আইন পরিবর্তন করে, শরিয়া আইনে তাদেরও বিচার করা হবে। তিনি গতকাল বাদ আসর লালবাগের কার্যালয়ে বি.বাড়িয়া থেকে আসা ইসলামী ঐক্যজোট নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে এসব কথা বলেন।
খেলাফত মজলিস : খেলাফত মজলিসের আমির অধ্যক্ষ মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য হাস্যকর। কারণ শরিয়া আইন প্রয়োগের আগে সংবিধানে শরিয়া আইন ঘোষণা করতে হবে। শরিয়া সম্পর্কে বিজ্ঞ ব্যক্তিকে বিচারক, উকিল ও তদন্ত কর্মকর্তা বানাতে হবে। সাক্ষীদেরও আল্লাহর নামে সাক্ষ্য দিতে হবে। তিনি বলেন, যারা সংবিধানে আল্লাহর ওপর আস্থা সহ্য করতে পারে না, বিসমিল্লাহ বিকৃত ও ইসলামী শিক্ষা সঙ্কোচন করেন, তাদের মুখে শরিয়া আইন প্রয়োগের কথা মানায় না।
খেলাফত আন্দোলন : খেলাফত আন্দোলনের আমির মাওলানা শাহ আহমদুল্লাহ আশরাফ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, এতে প্রমাণিত হয়েছে প্রচলিত আইনের প্রতি সাধারণ জনগণ তো দূরের কথা, খোদ প্রধানমন্ত্রীরও আস্থা নেই। তাই দেশ থেকে সব ফেতনা-ফাসাদ দূর করে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় শরিয়া আইনের কোনো বিকল্প নেই। তবে তা বিশেষ মতলবে নয়, বরং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সব স্তরে চালু করতে হবে।
ইসলামী আন্দোলন : ইসলামী আন্দোলন ঢাকা মহানগর সভাপতি অধ্যাপক এ টি এম হেমায়েতউদ্দিন বলেন, ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। এর অংশবিশেষ মানলে হবে না। প্রধানমন্ত্রী শরিয়া আইনের একটি অংশের কথা বলেছেন। এভাবে ব্যক্তি বা দলীয় বিবেচনায় হয় না, দেশের সার্বিক ক্ষেত্রে শরিয়া আইন চালু করতে হবে।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস : বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ুন কবীর এক বিবৃতিতে বলেন, সংবিধান সংশোধন করে প্রধানমন্ত্রী একদিকে দেশকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে প্রমাণ করছেন; অপরদিকে শরিয়া আইন কায়েমের ঘোষণা দিয়েছেন—এটা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধান কিসাসকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করা ছাড়া কিছুই নয়। যদি তিনি সত্যিকার অর্থে শরিয়া আইন বাস্তবায়ন করতে চান, তাহলে সব ক্ষেত্রে শরিয়া আইনের ঘোষণা দিয়ে দেশের সংবিধানকে শরিয়া মোতাবেক ঢেলে সাজাবেন। অন্যথায় দেশের মানুষ তাকে নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধানকে ব্যবহারকারী তথা ধর্মের অপব্যবহারকারী হিসেবে আখ্যা দেবে।
ঐক্য আন্দোলন : ইসলামী ঐক্য আন্দোলন ঢাকা মহানগরী আমির মোস্তফা বশীরুল হাসান ও সাধারণ সম্পাদক ডা. এস এম সাখাওয়াত হুসাইন এক বিবৃতিতে বলেন, প্রধানমন্ত্রী যদি রাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থায় শরিয়া আইনের বাস্তবায়ন করেন, তাহলে দেশ সোনার বাংলাদেশে পরিণত হবে। শুধু বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলকে প্রতিরোধ ও দমন অভিযানে শরিয়া আইনে বিচার করলে বরং শরিয়ত লঙ্ঘনের আশঙ্কা দেখা দেবে। তারা বলেন, সংবিধান থেকে আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস তুলে দিয়ে মুখে শরিয়া আইন অনুযায়ী বিচারের কথা চরম ধোঁকাবাজি।
নেজামে ইসলাম পার্টি : নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি মাওলানা আবদুর রকিব অ্যাডভোকেট ও মহাসচিব মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী এক বিবৃতিতে বলেন, শুধু মানবতাবিরোধী নয়, জাতীয় জীবনের সব স্তরে শরিয়া আইন প্রবর্তন করতে হবে।
সুশীল ফোরাম : সুশীল ফোরামের সভাপতি মো. জাহিদ ও সাধারণ সম্পাদক সানোয়ার হোসেন সাহেদ এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিন্নমত দমনে শরিয়া আইনের আশ্রয় নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের মতো একটি দলের পক্ষেই এটা সম্ভব। কারণ ক্ষমতা ও রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার পর থেকেই ধর্মকে ব্যবহার করে আসছে। এ ঘোষণা থেকে সরে আসার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তারা।
এছাড়া তাহফিজে হারামাইন পরিষদের সভাপতি মাওলানা সাদেক আহমদ সিদ্দিকী এক বিবৃতিতে ইসলামী আদালত গঠন করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানান।
প্রসঙ্গত, শুক্রবার গণভবনে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকের শুরুতে দেয়া বক্তব্যে দলের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে যত বাড়াবাড়ি হবে, বিচার ততই তাড়াতাড়ি করা হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিচার বন্ধে বেশি বাড়াবাড়ি করলে বিকল্প পথ জানা আছে। কী করতে হবে, তা আমাদের জানা আছে। দরকার হলে শরিয়া আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে, কিসাস তো আছেই।’