বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু আপাতত হচ্ছে না। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে প্রায় নয় হাজার কোটি টাকার ঋণসহায়তা স্থগিত করেছে বিশ্বব্যাংক।
দুর্নীতির তদন্ত শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত অর্থ ছাড় কিংবা দরপত্র-প্রক্রিয়া অনুমোদন করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। কবে নাগাদ দুর্নীতির তদন্ত শেষ হবে এবং অর্থ ছাড় করে দরপত্র-প্রক্রিয়া পুনরায় শুরু হবে, তা খোলাসা করেনি সংস্থাটি।
এতে প্রকল্পটি আদৌ বর্তমান সরকারের আমলে হবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। সরকার ২০১৩ সালের মধ্যে পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্পন্ন করে তা যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। সরকার প্রথমে বলেছিল, ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নির্মাণকাজ শুরু হবে। এরপর বলা হয়, ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে কাজ শুরু হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত মূল সেতু, নদীশাসন, টোল প্লাজা ও সংযোগ সড়ক নির্মাণসহ পদ্মা প্রকল্পের ছয়টি দরপত্র কার্যক্রম শেষ হয়নি। দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংকসহ উন্নয়ন-সহযোগীরা এসব দরপত্রের অনুমোদন দিচ্ছে না।
যদিও প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, গাড়ি ক্রয়সহ নানা কর্মকাণ্ডে ব্যয় হয়ে গেছে এক হাজার ২১ কোটি টাকা।
গতকাল সোমবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর জন্য তাদের প্রতিশ্রুত ঋণসহায়তা সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে।
এদিকে, এ নিয়ে বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের পরিচালক এলেন গোল্ডস্টেইন বলেছেন, ‘জালিয়াতি ও দুর্নীতি বিষয়ে সন্তুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত আমরা পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে আগাব না।’ বার্তা সংস্থা এএফপি গতকাল বিশ্বব্যাংকের এই কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে আরও জানায়, তারা ১২০ কোটি ডলারের এই ঋণসহায়তা স্থগিত করেছে।
সূত্র জানায়, অর্থমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টাসহ সরকারের উচ্চপর্যায়ের কয়েকজনকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী গত রোববার রাতে কথা বলেছেন। মন্ত্রিসভার বৈঠকের পরও প্রধানমন্ত্রী জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীদের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের অবস্থান নিয়ে কথা বলেন। সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী বিকল্প কোনো ব্যবস্থা করা যায় কি না, সে বিষয়ে পরামর্শ চান। কিন্তু অর্থমন্ত্রী এতে সায় না দিয়ে বলেন, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তি হয়ে গেছে। সেখান থেকে ফিরে আসার সুযোগ নেই।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বিশ্বব্যাংক ঋণ স্থগিত রাখার কারণে অন্য উন্নয়ন-সহযোগীদের ঋণসহায়তাও আটকে গেছে। পদ্মা সেতুতে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপানি ঋণদান সংস্থা জাইকা ও ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) ঋণসহায়তা দেওয়ার চুক্তি করেছিল। বিশ্বব্যাংক ছিল উন্নয়ন-সহযোগীদের সমন্বয়কারী।
ঋণসহায়তা স্থগিত হওয়ার কারণে সরকার চারদিকে সমালোচনার মুখে পড়েছে। এই অবস্থায় গতকাল পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) রফিকুল ইসলামকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এই উদ্যোগের মাধ্যমে সরকার কিছুটা চাপ সরানোর চেষ্টা করছে। একই সঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশন বিশ্বব্যাংকের কাছে পদ্মা সেতু প্রকল্পের দুর্নীতির বিষয়ে দুই পক্ষ এক হয়ে তদন্ত করার প্রস্তাব করে চিঠি দিয়েছে।
জানতে চাইলে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কোনো দরপত্র অনুমোদন করিনি। তাই দুর্নীতির প্রশ্নই আসে না।’ প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ কী—জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘আগামী জানুয়ারি মাস থেকেই কাজ শুরু করার মতো প্রস্তুতি আমাদের আছে। এখন বিশ্বব্যাংক কবে অনুমোদন দেবে, সেটা তাদের ব্যাপার।’
গত সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সাধারণ সভায় যোগ দিয়ে অর্থমন্ত্রী গত শনিবার দেশে ফেরেন। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ওই সফরেই বিশ্বব্যাংক অর্থমন্ত্রীকে জানিয়ে দেন, পদ্মা প্রকল্পের তদারকি পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেয়েছে বিশ্বব্যাংক। কানাডা পুলিশ ও বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতিবিরোধী ইউনিট এই বিষয়ে তদন্ত করছে। তদন্ত শেষ হলেই প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হবে। তদারকি পরামর্শক হিসেবে কানাডাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনকে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে বিবেচনা করে অনুমোদনের জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছে পাঠানো হয় গত জুলাই মাসে।
সূত্র আরও জানায়, শুধু তদারকি পরামর্শক নিয়োগের দরপত্র নয়, নদীশাসন দরপত্রের প্রাক-যোগ্যতা যাচাইয়েও দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বাদ দেওয়ার বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। এর আগে মূল সেতুর প্রাক-যোগ্যতা যাচাই দরপত্রে দুর্নীতি হয়েছে—এমন অভিযোগ করে বিশ্বব্যাংকে নালিশ দেয় চীনা কোম্পানি সিআরসিপি-ভেঞ্চার এন্টারপ্রাইজ (যৌথ) ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এটিও তদন্ত করছে বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতিবিরোধী ইউনিট।
পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। এর মধ্যে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা ঋণসহায়তা থেকে ব্যয় হবে।
অর্থমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন: অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গতকাল সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর সাংবাদিকদের বলেন, নির্মাণ-প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় পদ্মা সেতুর জন্য বিশ্বব্যাংক আপাতত কোনো অর্থ দেবে না। সেতুর জন্য সংস্থাটির প্রতিশ্রুত ঋণ সাময়িকভাবে বন্ধ থাকবে।
পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন স্থগিত প্রসঙ্গে প্রথমে সাংবাদিকদের কিছু বলতে চাননি অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমি আজকেও কোনো কথা বলব না, বরং একটি সম্মেলন ডেকে লিখিত বিবৃতি দেব।’ তিনি অবশ্য বলেন, পদ্মা সেতুর দরপত্র-প্রক্রিয়া এখনো শুরুই হয়নি। শুধু দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংক অভিযোগ করেছে, এতে দুর্নীতি হতে পারে। সেই ভিত্তিতে বলা যায়, সেতু নির্মাণ-প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজটি আপাতত বন্ধ আছে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে গতকাল অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমরা তাদের (বিশ্বব্যাংক) কাছে সব কাগজপত্র দাখিল করেছি। পরামর্শকদের প্রাক-যোগ্যতা যাচাই, তাদের নিয়োগ এবং নদীশাসন—এ তিনটি বিষয়েই প্রশ্ন তুলেছে তারা। একটি অভিযোগ করেছে কানাডায়, আরেকটি আমাদের কাছে।’ অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের বিবেচ্য হলো, জটিলতাগুলো কীভাবে নিরসন করা যায়।’
তাহলে কি পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজটি স্থগিত হয়ে গেল—এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘হ্যাঁ, আমি তো আগেই বলেছি। সাময়িকভাবে এটা বন্ধ (টেম্পোরারিলি স্টপড) থাকবে।’
বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের বিষয়ে সরকার তদন্ত করবে বলেও জানান অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘অবশ্যই তদন্ত করা হবে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইতিমধ্যেই তদন্ত শুরু করেছে।’
বিশ্বব্যাংকের তোলা দুর্নীতির অভিযোগ সরকারের একজন মন্ত্রীর মালিকানাধীন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কি না—এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমি কোনো মন্তব্য করব না।’
পিডি বাতিল: পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) রফিকুল ইসলামকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। গতকাল সোমবার এ-সংক্রান্ত চিঠি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে সেতু বিভাগে এসেছে।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীর পদ থেকে অবসরে যাওয়ার পর রফিকুল ইসলামকে দুই বছরের জন্য পদ্মা সেতু প্রকল্পের পিডি হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছিল সরকার। চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল আগামী বছরের মার্চ মাসে।
যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন গতকাল রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির অনুমতিক্রমে পিডির চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হয়েছিল। বাতিলও করা হয়েছে রাষ্ট্রপতির অনুমতিতেই।’ কেন বাতিল হয়েছে, জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, জনস্বার্থে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর বেশি কিছু বলতে চাননি তিনি।
সূত্র জানায়, রফিকুল ইসলাম যোগাযোগমন্ত্রীর খুব আস্থাভাজন ছিলেন। তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য সেতু বিভাগের সচিব সম্প্রতি মন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব পাঠান। কিন্তু মন্ত্রী এই বিষয়ে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। তার পরও প্রস্তাবটি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠালে সেখান থেকে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। গত রোববার সেই অনুমোদন পাওয়া যায়।
লিংক Click This Link