গত সংখ্যার পর,
গত পর্বগুলোঃ পর্ব - ১
পর্ব - ২
কলেজ থেকে বেড়িয়ে সোজা মেসের দিকে পা বাড়াল ইসমাইল ফরাজী। ঢাকায় অতি আপন কেউ না থাকায় একমাত্র ভরসা ছিল হোস্টেল। কিন্তু হোস্টেল থেকে গতবার পরীক্ষা দিতে যাওয়ার পর জিনিসপত্র খোয়া গিয়েছিল। তাই ফরাজী এবার কোন ভুল না করে সোজা মেসে উঠেছে। যদিও সুবিশাল ঢাকা, তবুও মেস পাওয়া এখন অসাধ্য হয়ে গেছে। ব্যাচেলর যেন একটি ধর্ম, আর এই ধর্মের মানুষদের যেন অন্য ধর্মের মানুষদের সাথে মেলামেশা বারন রয়েছে। আর একারনেই ব্যাচেলরদের বাসা ভাড়া নেই। তা যদি হয় আবার এক মাসের জন্যে, তবে তো ষোলকলা পূর্ণ। ফরাজী তাড়াহুড়ো করে একটি লেগুনায় উঠে সিড়ির পাশের সিটেই বসে পড়ল। তবে সেই বসে থাকাটা দীর্ঘক্ষন স্থায়ী হয়নি। লেগুনার হেল্পার ছেলেটা দাত বের করে হেসে বলল, 'মামা আমনে একটু কষ্ট কইরা পিছে খাড়াইবেন? একজন মহিলা বইতে পারতো হেলে।'
এই উক্তিটির সাথে ফরাজী বেশ পরিচিত, নিয়মিতই জানাশোনা আছে এই মূল্যবান উক্তিটির সাথে। তার ইচ্ছে করছে ছেলেটির কানের ঠিক দুই ইঞ্চি নিচে ঠাটিয়ে একখানা চড় মারতে। কিন্তু বরাবরের মতই ফরাজী চক্ষুটা কিঞ্চিত লাল করে পেছনে সিড়িতে গিয়ে দাড়ালো। যথারীতি লেগুনায় যাত্রী ভরে যাওয়ার পরেও ড্রাইভার সাহেব অপেক্ষা করছেন আর মাত্র একটা যাত্রীর অপেক্ষায়। সম্ভব হলে তার মাথার উপর বসিয়ে নিয়ে যাবেন, তবুও একজন যাত্রী চাই। ফরাজীসহ আরো দুজন যাত্রী বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। পা রাখার স্থানটি পর্যাপ্ত বড় না হওয়ার কারনে এক পা বাইরে ঝুলিয়ে রাখতে হচ্ছে। ফরাজী খুব বেশি পরিমান বিরক্ত হচ্ছে তা চোখেমুখে স্পষ্ট। এরপর পেছনের রহস্য শুধু লেগুনা নয় বরং তার পরীক্ষা খারাপ হওয়াও সমানভাবে দায়ী। পরীক্ষা ভাল হলে হয়ত এই পেছনে দাঁড়িয়ে থাকার মাঝেও একপ্রকার সুপ্ত ভালোলাগা কাজ করত। ফরাজী খুব ভাল ছাত্র নয়, তবুও সে আশা করেছিল পরীক্ষায় ফাটিয়ে দিবে। এমনিতেই সেশন জটে আটকে থাকতে থাকতে বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। পরীক্ষাট ভাল হওয়াটা খুব দরকার ছিল কিন্তু ওরা আমায় ভাল হতে দিলোনা। কারা! হল টিচাররা। একটাদিন একটু ছাড় দিলে কি হত!
লেগুনা অবশেষে টান দিলো। যাত্রীরা একটু জোড়ে ধাক্কা অনুভব করল, আর পেছনের যাত্রীরা তো রীতিমত কয়েক সেকেন্ড ময়লাযুক্ত বাতাস গিলে খেল। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা তিনজনের বাম পাশে সীমিত একটা পা রাখার জায়গা আছে, হেল্পার ছেলেটি সেই জায়গায় এক পা দিয়ে আর এক হাত দিয়ে ভেতরে ধরে রেখে এই মোহাম্মাদপুর, শ্যামলী, মিরপুর বলে ডেকে জোরে জোরে লেগুনার গায়ে আঘাত করতে লাগল। লেগুনা কয়েক ক্লেশ যাওয়ার পরই ছেলেটা যাত্রীদের কাছে ভাড়া আদায় করা শুরু করল। সর্বপ্রথমই শুরু করল ফরজীকে দিয়ে। বেচারার এমনি পরীক্ষা খারাপের কারনে মেজাজ খারাপ, এর উপর আবার সিট পেয়েও ঝুলে যেতে হচ্ছে, তার উপর আবার এই ব্যাটা ছোকড়া ভাড়া চাইছে! এই মুহুর্তে ফরাজীর অনেক কিছু করতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু নিজেকে সংযত রেখে ঠান্ডা করে ছেলেটিকে বলল, 'শ্যামলী যাবো, পরে নে।'
হেল্পার ছেলেটি মিনমিনিয়ে বলল, 'এহন দিলে সমস্যা কি মামা? পরেতো না দিয়াই চইল্লা যাইবেন।'
ফরাজী একবার চোখটা বন্ধ করল, এই ঘ্যানর ঘ্যানর শব্দটা এই মুহুর্তে বাসের সাইরেনের থেকেও বিরক্ত লাগছে। আর কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছেনা ফরাজীর। কোনভাবে কষ্ট করে একহাত দিয়ে লেগুনার উপর লোহার শিকগুলো ধরে অন্যহাত দিয়ে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করল। একই হাত দিয়ে মানিব্যাগের ভেতরে থাকা দশটাকার একটা নোট বের করার চেষ্টা করতে লাগল। ফরাজী কোন উপায় না পেয়ে মানিব্যাগের মাঝে মুখ ঢুকিয়ে মুখের সাথে দশটাকার নোটটি জোড়ে চেপে ধরে বের করে আনলো। ঠিক একই মুহুর্তে স্পিডব্রেকারে লেগুনা উপর থেকে নিচে নেমে গেল। লেগুনার পৃষ্ঠদেশে সজোড়ে আঘাত পেয়ে ছিটিকে রাস্তায় পরে গেল ফরাজী। হেল্পার ছেলেটি দ্রুত নেমে ফরাজীকে ধরল, মুখ থেকে রক্ত ঝড়ছে দেখে কি যেন মনে করে সোজা চলন্ত লেগুনায় উঠে গেল। বেচারা মনে মনে কষ্ট পেয়েছে হয়ত, একজন যাত্রীর কাছ থেকে ভাড়া আদায় করতে পারেনি বলে। লেগুনাটি অদৃশ্যে মিলিয়ে যাবার আগেই উঠে বসে পড়ল ফরাজী। সাদা শার্টে রক্ত লেগে জাপানের পতাকা হয়ে গেছে। এই মুহুর্তে একটি ছবি তুলে রাখার বড্ড ইচ্ছে হচ্ছে ফরাজীর। তুললে মন্দ হত না, সবাইকে বলে বেড়াতে পারত আন্দোলনে পুলিশের হামলার স্বীকার। ফরাজী একবার আশেপাশে চোখ বুলিয়ে গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত হল, কি অদ্ভুত এ শহর। এ শহরে সবাই ব্যাস্ত, সবাই অলস, সবাই সুখী, সবাই দুঃখী, সবাই নির্ঘুম আবার সবাই গভীর ঘুমে নিমজ্জিত। দোটানার শহরে বেহিসাবি অংকের সমীকরণ মেলানোর ব্যার্থ চেষ্টা করেছে সে অনেক আগেই। এইত সেদিন, গুলিস্থানে পুলিশ ষ্টেশনের মোড় থেকে পাচ টাকা দিয়ে এক খিলি পান কিনে মুখ ভরে কিছুক্ষণ গরুর মত জাবর কেটে পুত করে পানের পিক ফেলল রাস্তায়। পানের পিকের কিছু অংশ এসে পড়ল তার পায়জামাতে। ফরাজী কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অযথাই পায়জামায় হাত দিয়ে এমন খোটাখুটি করছে যেন সে আরেকটু সময় পেলে রং উঠিয়েই ফেলবে। দূর থেকে এক পুলিশ সদস্য এসব দেখে ফরাজীকে এসে জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে। ফরাজী দেখালো পানের পিক পায়জামাতে লেগেছে। পুলিশ একটুখানি পানি এনে দিয়ে তার পায়জামার ঐ অংশটি ধুইয়ে দিল। আশেপাশের চলন্ত ব্যস্ত মানুষগুলোর ব্যস্ততা যেন নিমিষেই সব শেষ হয়ে গেল। তারা সবাই পর্যবেক্ষন করতে লাগল এই অসম্ভব দৃশ্যটি। মুহুর্তেই সেখানে গোটা ত্রিশেক মানুষের জটলা বেধে গেল। নতুন দর্শনার্থীরা ঠাহর করার চেষ্টা করল এখানে কি হয়েছে। সামনের দিকের মানুষরা পেছনে তথ্য ফাঁস করছেন, পুলিশের ডান্ডার বারি খেয়ে পা ফেটে গেছে। কেউ আবার বলছেন, ছিনতাইকারী ধরছে, কেউ কেউ বলছেন, পুলিশে পা ধরে মাফ চাইতেছে। সেদিন পরিস্থিতি আরো ঘোলা হওয়ার আগেই ফরাজী কেটে পড়েছিল। তবে সেদিন কোনভাবে একঘন্টা ওভাবে থাকতে পারলে প্রশাসনের পারমিশন ছাড়াই একটা জনসমাবেশ করা যেত। ফরাজী ভাবছে, সেই অলস মানুষগুলোই এখন কত কর্মঠ হয়ে গেছে। তার দিকে এগিয়ে আসার কেউ নেই এখন। হাসতে হাসতে মাথাটা হেলিয়ে দিলো রাস্তায়। কি অদ্ভুত ব্যাপার! আঘাত পেয়েছে মুখে, অথচ যন্ত্রণা হচ্ছে মাথায়। এমন অদ্ভুত অনুভূতি এই দ্বিতীয় ফরাজীর জীবনে। প্রথমবার হয়েছিল কণার বিয়েতে। ফরাজীর এখন বড্ড ঘুম পাচ্ছে, ভীষণ ঘুম। রাস্তাটা বিছানা হিসেবে মন্দ নয়।
অন্যরকম দূর্গন্ধে ঘুম ভাঙল ফরাজীর। প্রথমে চোখ খুলতে সমস্যা হলেও কয়েকমুহুর্ত পর নিজেকে আবিষ্কার করল হাউমাউ কেন্দ্রে। চল্লিশ বছর বয়সী একজন মহিলা, সাদা পোষাক আর মাথায় সাদা টুপির পাশে ছোট্ট একখানা লাল রঙের যোগ প্রতীক। ভদ্রমহিলা বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে ফরাজীর দিকে। ফরাজী এখন হাসপাতালে এটা বুঝার পরেও নার্সকে জিজ্ঞেস করল, 'আমি এখন কোথায়?' কিন্তু বলতে গিয়ে বাধল বিপত্তি। এতক্ষন পর তার মুখে ব্যাথা অনুভব হচ্ছে। চোখের মনি একটু নিচে নামিয়ে দেখার চেষ্টা করল তার মুখের উপর কি পরিমান অত্যাচার চলছে। তার অবশ্য বেশি কষ্ট করতে হল না। নার্স বলল, 'আপনার মুখে তিনটা সেলাই করা হয়েছে, ঠোট কিছুটা কেটে গেছে, সামনে থেকে একটা দাত পরে গেছে আর একটা দাতের কিছু অংশ ভেঙে গেছে।
ফরাজীর ভেতরটা কেঁপে উঠল এই অদ্ভুত কথা শুনে। তার এই সুদর্শন চেহারা দিয়ে তবে কি হবে যদি দাতই না থাকে! ফরাজী এখন তার সকল ব্যাথা ভুলে দন্ত হারানোর শোকে পাথর হতে শুরু করল। নার্স বলল, 'আপনার প্রচুর পরিমান রক্তক্ষয় হয়েছে, বাসায় গিয়ে বরফ লাগাবেন। আজ রাতে কিছু খাবেন না, সেলাইয়ের ক্ষতি হলে কিন্তু কাটা জায়গায় ঘা হয়ে যাবে। স্যার তিনটা ট্যাবলেট লিখে দিয়ে গেছেন, এগুলো কিনে নিবেন।'
ফরাজীর দিকে কাগজটি বাড়িয়ে দিলেন পরিচার্যিকা। ফরাজী অনেক কষ্টে মুখ থেকে বু বু শব্দ করে জানতে চাইলো তাকে এখানে কে নিয়ে এসেছে? নার্স কাজ করতে করতে বললেন, 'অপরিচিত একজন এসে আপনাকে দিয়ে গেছেন। উনি নাকি আপনাকে রাস্তার পাশে ঘুমাতে দেখছিলেন। কিন্তু পোষাক ভাল হওয়ার কারনে কাছে যেতেই আপনার এই অবস্থা দেখে নিয়ে এসেছেন। সময়মত না আনলে আরো ক্ষতি হতে পারতো।
ফরাজী ভাবনায় পড়ে গেল। আহ, এই জমানাতেও এত ভালো লোক আছে! ভাবলেই পরান জুড়িয়ে যায়। ভদ্রলোককে সামনে পেলে পা ছুয়ে সালাম করত, আর বয়সে ছোট হলে বুকে জড়িয়ে নিতো তাকে। কিন্তু এইসব লোকগুলো এতটাই মহান হয় যে তারা নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করে। তাই হয়ত ফরাজীর কাছেও তার পরিচয় গোপন করে উপকার করে গেছেন নিরবে নিভৃতে। ফরাজী সেই মহান লোকটির পরিচয় জানতে চাইলো না আর নার্সের কাছে। এমনিতেই কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে।
জরুরী বিভাগ থেকে বেড়িয়ে চারদিকে অন্ধকার দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে ফরাজী। রাত হয়ে গেল কিভাবে তা ভেবে সময় নষ্ট করার কোন প্রয়োজনীয়তা দেখল না ফরাজী। হাসপাতালের সামনে থেকে বিনা টাকায় কিছু ঐষধ নিয়ে রাজপথে নামে সে। ক্লান্তিতে দু পা সামনে এগুচ্ছে না। খুব তাড়াতাড়ি একটা সিএনজি নিয়ে বাসায় যাওয়া দরকার। পকেটে হাত দিতেই হুশ ফিরল। এই রে, মানিব্যাগ উধাও। তিনবছর ধরে ব্যবহার করা বাটনওয়ালা মোবাইল উধাও। উচ্চ মাধ্যমিকের সময় কাদের সাহেবের দেয়া ক্যাসিও ঘড়িটাও উধাও। মনে মনে অনেকগুলো বাংলা গালী চলে আসলেও সবগুলোকে একসাথে রুপান্তরিত করে একটিমাত্র ইংরেজী শব্দ দ্বারা বহিঃপ্রকাশ করল আবেগের। ঢাকার ছেলেরা এই শব্দটি আবার বেশ চমকপ্রদভাবেই ব্যবহার করে থাকে, বেশ ভালই লাগে শুনতে। শিক্ষিত হলে বুঝবে গালী, অশিক্ষিত হলে বুঝবে ফাকা জায়গার কথা বলা হচ্ছে। সে যাই হোক, ফরাজী কোনকিছুর হিসেব মেলাতে পারছেনা। কে বা কাহারা তার এই সর্বনাশ করেছে! কিছুক্ষণ অংক কষার পর সে নিউটনের তৃতীয় সুত্র প্রয়োগ করে চোরের সন্ধান পেল। যে মহান ব্যাক্তি তাকে হাসপাতালে পৌছে দিয়েছে, খুব সম্ভবত তার দ্বারাই সংঘঠিত হয়েছে এই মহান কাজটি। সাথে সাথেই উপকার করা ভদ্রমহহোদয়ের উপর জমানো সম্মানটুকু ঘৃণায় রুপান্তরিত হল। 'ব্যাটা হারামখোর, আমার টাকা খেয়ে আবার আমাকেই হাসপাতালে রেখে গিয়ে সাধু সাঝা হচ্ছে! ফকির যেন কোথাকার।' আপাতত এসব বিড়বিড় করেই মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করছে ফরাজী।
সারা পথ হেটে হেটে ক্লান্ত ফরাজী যখন মেসে গেটে, তখন রাত একটা বেজে সতেরো মিনিট। গেটে একবার নাড়া দিয়েই বুঝতে পারল ভেতর থেকে তালাবদ্ধ অবস্থায় আছে। সে মোটামুটি মানুষিকভাবে তৈরি হয়ে নিয়েছে আজ রাতটা রাস্তাতেই ঘুমাতে হবে। আজ দুপুরেও রাস্তায় ঘুমাতে হয়েছিল। খুব একটা খারাপ লাগেনি। সব ঘুমই শান্তির ঘুম, সেটা হোক নরম তুলতুলে বিছানা বা কংক্রিট, অশান্তির ঘুমের মধ্যেও শান্তি শব্দটা আছে। পুরো পৃথিবী যদি ঘুমাতে পারে রাতের আঁধারে, ক্লান্ত এ শরীরটাও ঠাই খুজে পাবে তার দেয়ালে। ঘার্মাক্ত শার্টে হয়ত একটু ভিজে যাবে তার দেয়াল, দূর্গন্ধযুক্ত শরীরটাকে তবুও দিরিয়ে দিবেনা সে। সন্তানরা তার কোলে মাথা দিলে সারারাত তার আঙুলের পরশ স্পর্শ করবে ভেজা চুলগুলো। কোটি টাকার বিছানা ছাড়াই ডূবে যাবে অজানা কোন রাজ্যে।
চলবে...
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই এপ্রিল, ২০২১ রাত ১১:৩৩