ইচ্ছেটা শুরু হয় অনেকগুলো কাহিনীর সমন্বয়ে। এক, জহির খালু একজন রাজনৈতিক মাঠ পর্যায়ের কর্মী। ঘর সংসার জাহান্নামে গেলেও সবার আগে দলটাই প্রাধান্য পায়। তার প্রিয় দল ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে এলাকায় ব্যাপক প্রচরনা এবং কর্মকান্ডে সক্রিয় দেখা গেছে তাকে। অতঃপর পাঁচ বছর ঘনিয়ে এলো। নির্বাচনে পরাজয় এবং খালুর মাথায় হাত। জহির খালু পাঁচ বছর নিজেকে অনেক কষ্ট করে সংযম রেখেছেন। রাজনৈতিক কারনে তার চাকরিটাও খোয়া গেলো। তার পরিবার মহাসংকটে পরে গেলো। জহির খালু বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি খাল কেটে কুমির এনেছেন। ওদিকে আবার দেশে নাকি ধর-পাকড়, গুম, খুনের সংখ্যা বেড়েছে। জহির খালুর এক কাছের বন্ধুকেও খুজে পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও। অতঃপর তাকে কোনভাবে গৃহবন্দী করে রাখতে পারলেন হেনা খালা।
পাঁচ বছর কেটে গেলো প্রায়, স্থানীয় থানায় জহির খালুর বিরুদ্ধে সর্বমোট ১৭টি মামলা। এর মধ্যে রয়েছে পেট্রোল বোমা, ককটেল বিস্ফোরণসহ একাধিক ভীতিকর মামলা। যে মামলায় খালুর বাকি জীবনটা লাল বিল্ডিংয়ের মধ্যে কাটাতে হবে নির্ঘাত। সমস্যা হচ্ছে, লাল খালুর অপছন্দের রং। একই কারনে তিনি কম্যুনিস্টদের একদমই চোখে দেখতে পারেন না। তার মতে কম্যুনিস্টরা হল অলস একটা সংঘঠন। এরা ভাল-মন্দ প্রতিটা কাজে তাদের নাক গলাবে, চিৎকার-চেচামেচি করবে। তাদের এই চিৎকার-চেচামেচির অর্থ দেশের ৯০% মানুষই বুঝেনা। দেশের মানুষদের সাথে মিশতে হলে তাদের কাতারে এসে দাড়াতে হবে। নিজেরা একটা ইস্যু নিয়ে টকশোতে চিল্লাচিল্লি করে বাসায় গিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাবে আর আশা করবে দেশের মানুষরা তার হয়ে বাকি কাজ সম্পন্ন করে দিবে, এদের থেকে অলস আর কেউ হতে পারেনা।
আসলে মূল কথা হচ্ছে জহির খালু দীর্ঘসময় ধরে কম্যুনিস্ট ছিলেন। নানান জল্পনা-কল্পনা একে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতেন। অনেক কিছু আশা ছিল তার বামপন্থী হয়ে। পৃথিবীর ইতিহাস বামপন্থীদের হয়ে অনেক কিছুই বলে যা অনেক কিছুই অনুপস্থিত আমাদের দেশের কম্যুনিস্টদের মধ্যে। যাই হোক, জহির খালু কোন আশার বানী দেখতে পেলেন না। কারন পাঁচ বছর হয়ে গেলেও তার প্রিয় দল বিশেষ কোন কারনে নির্বচনে অংশগ্রহণ করছেনা। খালুর সকল আশা ভরসা একেবারে দুমড়ে-মুচড়ে গেল। নির্বচনে খালুর বিরোধী দল দেশ কাপিয়ে জয়ী হয়ে গেল। তার কিছুদিন পরই জহির খালুর বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে খোজ খবর নেয়ার গুঞ্জন উঠতে লাগল। এমনকি আমার খালাতো ভাই সগিরকে স্কুলে যাওয়ার সময়ে কিছু মানুষ জেরা করে খালু সম্পর্কে। সগিরের ব্যাগে লাল টেপ পেচানো টেনিস বলের মত কিছু একটা দেয়া হয় এবং সেটা বাসায় গিয়ে জহির খালুকে দিতে বলে। বাসায় আসার পর অবশ্য সাথে সাথে আমার খালা সেই লাল টেপ পেচানো বস্তুটা লুকিয়ে রাখতে সামার্থ হয়। যার কারনে সে যাত্রায় তল্লাশীতে বেঁচে যায় জহির খালু।
এভাবে বেশ অশান্তিতে জীবন যাপন করছিলেন তিনি। কিন্তু পরিবারের জন্যে কোনভাবেই আহার জোগার করতে পারছেন না। এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় চাকরী সংগ্রহ করলেও কোন এক কারনে সেই চাকরী ছাড়তে বাধ্য হন। আত্মীয়-স্বজনদের সাহায্য এবং সহযোগীতায় তার ফ্যামিলি কোনভাবে আহার জুটাতে পারে। কিন্তু সন্তানদের লেখাপড়া এবং আনুসাঙ্গিক খরচ কোনভাবেই জোটাতে পারছেন না। অতঃপর আমার বড় ভাইয়ের বুদ্ধিতে আমার মা ফোন দিলেন একজন বিশেষ মানুষকে। তিনি আমার মায়ের চাচাতো ভাই। তৎকালীন সরকার পক্ষের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন অভ্যন্তরীণ নেতা। তাকে ফোন দিয়ে আমার মা অনুরোধ করলেন জহির খালুর জন্যে বিশেষ কোন ব্যবস্থা করতে। মায়ের চাচাতো ভাই রিজভী মামা, তিনি এই সংবাদ শুনে আকাশ থেকে পড়লেন যে তারই এক অদুরবর্তী আত্মীয় এভাবে রাজনৈতিক কোন্দলের স্বীকার হয়ে ফ্যামিলি নিয়ে মাঠে বসেছেন। তিনি এক সপ্তাহের মধ্যে এলাকায় আসলেন, সব অবস্থা যাচাই-বাছাই করে একটি সমাধান বের করে দিলেন জহির খালুর জন্যে। সেটি হলো, রাজনৈতিক দল পরিবর্তন।
খালু এক সপ্তাহ গড়িমসি করতে লাগলেন। তিনি কোনভাবেই দলের প্রতি অনুগত্য ত্যাগ করতে পারবেন না। তাতে তার ফ্যামিলি না খেয়ে মরে যায় যাক। অতঃপর আমার বাবার কড়া কিছু কথাতে তার মন গললো। তিনি দ্বিতীয় বারের মত তার ঈমান ত্যাগ করে তৃতীয় কোন দলে অংশগ্রহন করলেন। ব্যস, মাত্র একমাসের মধ্যে দৃশ্যপট পরিবর্তন। মামলাগুলো যেভাবে হাওয়া হয়ে এসেছিলো, সেভাবেই উবে গেলো। জহির খালু এখন আরামে আয়েশে দিন যাপন করছেন। পরিবারের জন্যে জোগান দিচ্ছেন আহার। আর প্রতি মাসে নতুন দলের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করছেন। প্রথম দিকে অনেক খারাপ লাগলেও এখন সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে গেছে তার।
জহির খালুর এই রাজনৈতিক কর্মকান্ড আমায় অনুপ্রাণিত করেছিল রাষ্ট্রনায়ক হতে। তবে সেটা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ব্যস্ততাময় শহরে ব্যস্ততার ভীরে ভুলেছি এই ইচ্ছেটা। কিন্তু এরপরই আবার ইচ্ছেটা নাড়াচাড়া দিয়ে উঠেছে দ্বিতীয় গল্পটির জন্যে।
চলবে...
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১০:২৮