ক্রাইস্টচার্চের ঘটনায় নিউজিল্যান্ডের সরকার এবং মানুষগুলো পুরো বিশ্ববাসিকে যা দেখালো তা সত্যিই মানবতার এক জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত। কতটা শোকাহত হতে পারে অন্য কোন মানুষের বেদনায় তা বোধহয় তাদের দেখেই শেখা উচিৎ। তারা নিহতদের ভাই নয়, বোন নয়, নয় কোন আত্মীয়-স্বজন। কিন্তু তারা এতটাই মর্মাহত হয়েছে যে বারবার আমার কাছে মনে হচ্ছিল তাদের খুব কাছের আপনজন ছিল হামলায় নিহত ৫০জন। হ্যা, তারা হয়ত অনেক শান্তিপ্রিয় দেশ, তারপরেও তারা আমাদের জন্যে অনেকগুলো বার্তা পৌছে দিয়েছে।
আমি নিউজিল্যান্ডের সাথে একটু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটের তুলনা করি। ‘বাংলাদেশ সৃষ্টিকর্তার অপরূপ সৌন্দর্য বেষ্টিত একটি দেশ, যেখানে রয়েছে সহজ সরল মানুষ আর তাদের একতা। তারা একতাবদ্ধ হয়ে এদেশ স্বাধীন করেছিল। তারা একে অপরের ভাই। তারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি;’। সত্যিই কি তাই! প্রশ্নটা সকল বাঙ্গালীর বিবেকের কাছে তোলা রইল। আমি শুধু কয়েকটি বিশেষ ঘটনার দিকে ইঙ্গিত টানতে চাই। সদ্য ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা, যে ঘটনার এক মাস পূর্ণ হল কেবল। ৭০জনেরো বেশী প্রান হারিয়ে গেল নিমিষেই, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতিরা কি করেছিল তাদের জন্যে? তাদের শোকে কতটুকু শোকাবহ হয়েছিল! বিষয়গুলো আমাদের চোখের সামনে পরিষ্কার। শোকাবহ হওয়ার আগেই এই শ্রেষ্ঠ জাতির কাছে অন্য একটি জাতীয় ইস্যু (বিমান ছিনতাই) এসে হাজির। এরপর আরো একটি জাতীয় ইস্যু (ডাকসু), এরপর আগমন ঘটল এই আন্তর্জাতিক ইস্যুটির। আমরা খুবই ব্যস্ত জাতি, খুব বেপরোয়া জাতি। একই সাথে খুব অলস জাতি, খুব অমানুষিক জাতি। আমাদের মনুষত্য দিন দিন লোপ পাচ্ছে। পেছনের ইতিহাস কিন্তু তাই বলে না, আমরা কিন্তু সত্যিই কাঁধে কাধ মিলিয়ে লড়াই করেছিলাম। আমরা একসাথে জীবন জীবিকা নির্বাহ করতাম। এসব কিছু যেন কীভাবে সব পরিবর্তন হয়ে গেল।
আমি আবারো নিউজিল্যান্ড প্রসঙ্গে ফিরতে চাচ্ছি। ৫০জন মুসলমান মারা গেল, আর শোকাবহ হল অন্য ধর্মের মানুষগুলো। ব্যাপারটা কি একবারো আপনাকে ভাবিয়ে তুলছে! রোহিঙ্গাদের হত্যায় আপনাদের প্রান কাঁদে, ফিলিস্তিনে হত্যায় প্রান কাঁদে, ভারতে মুসলমান নিধনে প্রান কাঁদে, আপনার পাশের হিন্দু বাড়িতে আগুনে আপনার প্রান কাঁদে! না, কাঁদে না। আপনি আলহামদুলিল্লাহ বলেন। আইএস কিংবা তালেবান যখন বাহিরের দেশের কোন সাধারণ মানুষকে হত্যা করে আপনি তখন সাদা চামড়ার বিধর্মী হত্যার কারনে আলহামদুলিল্লাহ বলেন। এদেশের অনেকেই আইএস, তালেবানদের কার্যক্রমকে মনের মধ্যে পালন করেন। আপনার ধর্ম কি আপনাকে এটাই শিক্ষা দিয়েছে! না, বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, আপনার ধর্ম আপনাকে শিক্ষা দিয়েছিল নিউজিল্যান্ডের মানুষগুলো যা করছে তাই।
আমরা মুসলমানরাই সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমন করছি, আমরা মুসলমানরাই এর প্রতিবাদ করছি না। জিহাদ কাকে বলে! বিধর্মীদের হত্যা করার নাম জিহাদ! নাকি অন্যায়কে প্রতিহত করার নাম জিহাদ! আপনার চোখে অন্যায় কি বিধর্মী হওয়াটাই! বিধর্মীদের পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার নেই! আপনার আছে তো! সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হল এটাই, আমরা সংখ্যালঘুদের আক্রমণে কেন ব্যাথীত হব যেখানে নিজের দেশের একজন মুসলমান হত্যা হলেও ব্যাথীত হইনা!
জাতিগতভাবে আমরা কোনভাবেই শ্রেষ্ঠ জাতি নই। নৈতিকতা এবং মানুষিকতার হিসেবে আমরা একটা উগ্র জাতি ছাড়া আর কিছুই পরিচয় বহন করি না। ১৭কোটি মানুষ। ৭০জন মরে গেল চকবাজারের অগ্নি দুর্ঘটনায়, ১৭কোটি শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালীর সুযোগ হল না তাদের সাহায্য করার, তাদের ছায়া হয়ে দাড়াবার। এই বিষয়গুলো জাতি হিসেবে আমাদের জন্যে অত্যান্ত লজ্জাজনক। ধর্মীয় অনুশাসন এইসব বিষয়গুলো কখনোই শিক্ষা দেয়না, উগ্রতা ছড়ায় না, অন্ধতা ছড়ায় না। শেখায় মনুষ্যত্ব, বিবেক আর সত্যের জন্যে সংগ্রাম। আফসোস, আমাদের যা শেখার কথা তাই শিখিনি, আর যা শেখার কথা না তাই মনে প্রানে ধারন করছি।
নিউজিল্যান্ড একটি ঘটনার মাধ্যমে আমাদের অনেকগুলো শিক্ষা দিয়ে গেল, আমরা তার কোনটিই গ্রহণ করিনি। শুধু তাদের পার্লামেন্টে কুরআন তিলওয়াত শুনে খুশি হয়েছি, মসজিদ পাহারা দেয়ার সংবাদ শুনে খুশি হয়েছি, হাজারো মানুষের শোকে মন ভরিয়েছি। শিক্ষা নেয়া হয়নি কিছুই। কারন আমরা বাঙ্গালী, আমরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি!
পাঠকের কলাম
সম্পাদকীয়, দৈনিক আজকালের খবর
২৫ মার্চ, ২০১৯
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই এপ্রিল, ২০১৯ রাত ১০:৪৫